হৈচৈ ধারাবাহিক কিশোর উপন্যাসে রাজকুমার ঘোষ

বিট্টুর সঙ্গী
বিট্টু প্রায় অনেকটাই সুস্থ। হরিকৃষ্ণবাবু তার নিজের বাড়িতে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। কিন্তু কিভাবে বলবেন বিট্টুকে… তারপর…
বিট্টু অনেকটাই সুস্থ ও স্বাভাবিক হয়ে গেছে। হরিকৃষ্ণবাবু এবার কমলকে বললেন,
“কমল, বাবা এবার আমাকে যে ফিরে যেতে হবে। মাস খানেকের ওপরে আমি বাড়িছাড়া আছি। তোমার কাকিমা অসুস্থ। তার পাশে আমাকে থাকতে হবে। এখন বিট্টু অনেকটাই সুস্থ হয়ে উঠেছে। সে স্কুলেও যাচ্ছে”
“খুবই স্বাভাবিক কাকাবাবু। আমি আর আটকাবো না আপনাকে। যেভাবে এই দুর্দিনে আমাদের পাশে থেকেছেন, তারজন্য আপনার কাছে কৃতিজ্ঞতার শেষ নেই”
“ওভাবে বলো না বাবা। বিট্টুকে দেখে আমি যেতে পারিনি। তোমার বাবার কাছ থেকে আমি সবই খবর পেতাম। তার মৃত্যু আমার কাছে ভীষণ কষ্টের। যাই হোক, বিট্টুর খেয়াল রাখার চেষ্টা করো”
হরিদাদুকে বিট্টু কিছুতেই কাছছাড়া করতে চাইছিলেন না। তার বাড়ি ফিরে যাওয়া নিয়ে বিট্টু খুব কান্নাকাটি করছিল। তার মা, দাদুর অভাব এই মাস খানেক হরিদাদু অনেকটাই ভুলিয়ে দিয়েছিলেন। বিট্টুকে আদর করে, ওকে বিভিন্ন গল্প শুনিয়ে আনন্দে রেখেছিলেন। বাড়ি ফিরে যাবার সময় বিট্টু তার হরিদাদুকে জড়িয়ে ধরে খুব কান্নাকাটি করছিল,
“হরিদাদু, তুমি চলে গেলে আমাকে কে গল্প শোনাবে? আমি কিভাবে থাকব?”
“আমি আবার আসব বিট্টুসোনা। আমার বাড়িতে তোমার আর এক ঠাম্মা আছে। তার ভীষণ শরীর খারাপ। সে আমাকে ছাড়া কি করে থাকবে বলো”
হরিদাদুরও এক সন্তান, চাকরিসূত্রে সে বিদেশে থাকে। সে তার স্ত্রী, পুত্রকে নিয়েই বিদেশে থাকে। বাড়িতে তার স্ত্রী অনেকদিন একাই আছেন। কাজের লোক আছে দেখাশোনা করার। বাড়ির কর্ত্তা দীর্ঘদিন বাড়ির বাইরে থাকায় খুবই অসুবিধা। কাজেই স্ত্রীর দেখাশোনার জন্য হরিকৃষ্ণবাবু বাড়ি ফিরে গেলেন। বিট্টুর চোখের জল থামতে চাইছিল না। হরিদাদু বিট্টুকে খুব আদর করে বলেছিলেন,
“তুমি একদম কাঁদবে না বিট্টুসোনা। যখনই একা থাকবে, আমার বলা কাহিনিগুলো নিয়ে ভাববে। আমি জাহাজে থেকে কিভাবে একা একা এক দেশ থেকে অন্যদেশে ঘুরেছি। সেসব গল্প মনে করবে, দেখবে মনে অনেক সাহস পাবে। এই পৃথিবীতে একাই চলতে হবে। আশেপাশে তোমাকে সাহায্য করার জন্য অনেককেই পেয়ে যাবে, একদম চিন্তা করবে না। রবিঠাকুরের একটা গান সবসময় মনে রাখবে, “যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে”
ছোট্ট বিট্টুর মাথায় গানটির সারমর্ম ঢুকলো কিনা জানা নেই। তবে হরিদাদুর টোটকায় বিট্টু নিজের মনকে শক্ত রাখার রসদ খুঁজে পেয়ে গেল। সে অল্প বয়সেই বুঝে গেছে। মা ছাড়া তাকে এই দুনিয়ায় একাই চলতে হবে। বিশেষ করে মেরিন ইঞ্জিনিয়ার হরিদাদুর জাহাজে করে বিশ্বভ্রমণ তার অনুপ্রেরণা। হরিদাদু বলেছেন,
“মাঝসমুদ্রে একটা বিশাল জাহাজ এগিয়ে চলেছে। হঠাৎ প্রবল ঝড় ঝঞ্ঝা, বিশাল বিশাল ঢেউ জাহাজের বুকে আছড়ে পড়েছে। আমি ছাড়াও এই বিশাল মালবাহী জাহেজে আরও অনেক নাবিক আছে। প্রত্যেকের চোখে মুখে আতঙ্ক গ্রাস করেছে। কিন্তু ভয় পেলে চলবে না। এই দুরন্ত জলরাশিকে অতিক্রম করেই সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। মৃত্যু সম্মুখে উপস্থিত। তবুও সেই মৃত্যুর চোখে চোখ রেখে বাঁচার শেষ চেষ্টা করে যেতেই হবে। সাহসীরাই প্রকৃত জীবন যুদ্ধে জয়ী হয়”
বিট্টুর ছোট মাথায় এই কথাগুলো গেঁথে গিয়েছিল। হরিদাদু বাড়ি ফিরে গেলেও ওনার মূল্যবান কথাটি বিট্টুর চিরকালের সঙ্গী হয়ে আছে এবং থাকবে…
রত্নার মনোবাঞ্ছা যেন পূর্ণ হয়েছে। সে প্রথম থেকেই তার জ্যেঠতুতো দিদি তন্দ্রার অমঙ্গল কামনা করত। বিট্টুর জন্মদিনে তন্দ্রার শ্বশুরবাড়িতে এসে সবকিছু দেখে নিয়েছে। কমলের অগাধ সম্পত্তি দেখে তার লোভ বেড়েছিল, তা বলাই বাহুল্য। বিট্টুকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানানোর পরিবর্তে সে তন্দ্রার শ্বশুরবাড়ির সুখের সংসারের বিনাশ কামনা করেছিল। তার এই কামনাও কিভাবে ফলে গেল। তন্দ্রার এক আত্মীয়ের বাড়ির নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে গিয়ে এক সড়ক দুর্ঘটনা কমলের পরিবারে চরম বিপর্যয় নেমে এসেছিল। একসাথে তন্দ্রা ও ওর শ্বশুর-শাশুড়ীর মৃত্যু ঘটল। তাদের এই বিপর্যয়ে যখন তোলপাড় ওদের পরিবারসহ আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে, তখন রত্না মুচকি হেসেছিল। সে নিজের মনেই বিড়বিড় করে বলেছিল,
“এই তো শুরু… এবার আমার ওই বাড়িতে আগমনের রাস্তা পরিস্কার হল। ঐ বিপুল সম্পত্তির মালিক হব আমি। আমার এতদিনের অপেক্ষা এবার বোধ হয় শেষ হবে”
হরিদাদু চলে যাওয়ার পর কমল একপ্রকার চঞ্চল হয়ে উঠেছিল। বাড়িতে ছোট্ট বিট্টুকে কাজের লোকেদের জিম্মায় রেখে নিজের কোম্পানীর কাজে তাকে বিভিন্ন জায়গায় চলে যেতে হয়। বিট্টুও ক্রমশ সাহসী হয়ে উঠেছে। সে বাড়ির কাজের লোকেদের কথা একদম শোনেনা। দিনরাত শুধু মা, দাদু কখনো হরিদাদুর কথা বলে। কমলের প্রতিও তার মনোভাব তলানীতে ঠেকেছে। কমল মাঝে মাঝে রেগে গিয়ে বিট্টুকে বকাঝকা করে। ক্রমশই বাড়ির পরিবেশ অশান্তিতে পরিপূর্ণ হয়ে উঠছে। তন্দ্রার বাবা-মাও মাঝে মাঝে আসে কিন্তু তাদের কথাও বিট্টু শোনেনা। তখন তারা একপ্রকার সিদ্ধান্তে এলেন, কমলকে বললেন,
“বলছি কমল, তুমি আরেকটা বিয়ে করো। বিট্টুকে দেখাশোনা করবে এমন কাউকে বাড়ির বৌ করে নিয়ে এস। বিট্টুর ভবিষ্যতের কথা ভেবেই আমরা একথা বলছি”
“আপনারা যা ভালো বোঝেন, তাই করুন। আমার অনেক কাজ। আমি বিট্টুর প্রতি মনোযোগ দিতে গেলে আমার বিশাল কর্মকান্ড নষ্ট হয়ে যাবে। আমার অনেক দায়িত্ব, বুঝতেই পারছেন”
“ঠিক আছে। আমরা না হয় উপযুক্ত কাউকে খুঁজে দেখছি”
তন্দ্রার বাবা-মা তার জামাইয়ের জন্য মেয়ে খুঁজতে লাগল। বিট্টুকে দেখাশোনা করতে হবে এই শর্তে অনেক পাত্রীর বাড়িতে খোঁজ করা শুরু করেদিল, কিন্তু মনের মত কাউকে খুঁজে পেলো না। অনেকের অবান্তর জিজ্ঞাসা এই সমাধানকে ক্রমশ পিছিয়ে দিচ্ছিল। তখনই রত্না এসে তার জেঠু জেঠিমার কাছে কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল,
“আমি জানি তোমরা আমাকে তন্দ্রাদির জায়গায় কখনোই বসাতে পারবে না। তবুও বলছি, আমি তন্দ্রাদির বোন। বিট্টুর কষ্ট আমি বুঝি। তার মাকে ছাড়া জীবন অন্ধকার। আমি কি ওর অন্ধকার জীবনে আলো হয়ে আসতে পারি! যদি তোমরা রাজি থাকো, তাহলে আমি জিজুকে বিয়ে করতে পারি”
রত্নার কথা শুনে তারা যারপরনাই অবাক। রত্না একি বলছে? বিট্টুর কথা ভেবে সে কমলকে বিয়ে করতে রাজি হয়ে গেল! সে যথেষ্ট সাবলম্বী। নিজের বাবার ব্যবসা একার হাতে সামলাচ্ছে। রত্নার বাবা-মাকে তারা জিজ্ঞাসা করল,
“তোদের মেয়ে কি বলছে? সে নাকি কমলকে বিয়ে করবে। বলছে বিট্টুকে একমাত্র ওই দেখাশোনা করতে পারবে”
তারা রত্নার মনের ইচ্ছা আগে থেকেই জানত। সেক্ষেত্রে, তারা মত দিল। তন্দ্রার বাবা-মা কমলের কাছে রত্নাকে বিয়ে করার প্রস্তাব দিল। কমল বেশ অবাক হলেও বলল,
“যদি বিট্টুর এই বিয়েতে ভালো হয়, তাহলে আমার রত্নাকে বিয়ে করতে আপত্তি নেই”
কিন্তু বিট্টু বেঁকে বসল। সে রত্নাকে প্রথম দেখা থেকেই পছন্দ করত না। যখনই শুনল, রত্না ওর বাড়িতে নতুন মা হয়ে আসবে, ও বলল,
“কি, ওই দুষ্টু মেয়েটা আমাদের বাড়িতে আসবে? আমার মা হতে চাইছে। কখনোই আমি ওই মেয়েটাকে আমি মা বলে ডাকব না”
সবাই ভাবল, বিট্টু ছোট ছেলে। ও আর এমন কি বুঝবে।! তার এমন মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক। ধীরে ধীরে সব ঠিক হয়ে যাবে। রত্নাও ঠিক বিট্টুকে আপন করে নেবে। হাজার হোক, নিজের মায়েরই বোন, হোক না সে খুড়তুতো বোন। রত্নার এই সিদ্ধান্তকে সকলেই সাধুবাদ দিল। হঠাৎ করে রত্না সকলের কাছে আপন হয়ে উঠল। তন্দ্রার বাবা-মা বিট্টুর কথা ভেবে রত্নাকেই ভরসা করল। কমলও রত্নার প্রতি সহানুভূতীশীল হয়ে বিয়ের জন্য রাজি হয়ে গেল। সে ভাবল, রত্না প্রকৃতই ভালো মেয়ে। বিট্টুর কথা ভেবে নিজের ভালোমন্দ সবকিছু তুচ্ছ মনে করে তাদের পরিবারকে আপন করে নিচ্ছে। এমন মহানুভব কজনেরই বা হয়? কমলের রত্নাকে বেশ ভালো লাগল। কমল একদিন রত্নার সাথে যোগাযোগ করে ভবিষ্যৎ জীবন গড়ে তোলা ও বিট্টুকে দেখাশোনার ব্যাপারে কথা বলতে চাইল। রত্না শুধু কমলের সাথে ঘর বাঁধা ও সম্পত্তি পাবার আকাঙ্খায় বিভোর ছিল। বিট্টুর দেখাশোনার ব্যাপারে সে…
———–
বিট্টুকে দেখাশোনার ব্যাপারে রত্না কি বলল? পড়ুন পরের পর্বে