কর্ণফুলির গল্প বলায় রবীন জাকারিয়া

আয়াতের তেলওয়াতে আয়াত

আমাদের একমাত্র সন্তান৷ আয়াত৷ ভীষণ দুষ্টু৷ চঞ্চল৷ সারাদিন শুধু ছোটাছুটি৷ অভিমানী আর অস্থির৷ এত অস্থির যে ওর Aim in lifeও পরিবর্তন করে ফেলে প্রতিনিয়ত৷ কোন সময় সে ডাক্তার হতে চায়৷ কখনো ইঞ্জিনিয়ার৷ ফিল্মের একশন দেখলে হিরো হবে৷ টিভির খবরে পুলিশের একশন দেখলে বলবে সে পুলিশ অফিসার হবে৷ আমি বললাম তুই আসলে কী হতে চাস? ও বললো পুলিশ অফিসার৷ কেন? জানতে চাইলে বললো সব ক্রিমিনালকে ইচ্ছেমতো মারতে পারবো৷ আমি বললাম ঠিক আছে৷ কিছুদিন পর বললো বাবা “আমি আর্মি অফিসার হবো”৷ জানতে চাইলাম কেন? ও বললো, টিভিতে দেখলাম মায়ানমারে ওরা যেভাবে মানুষ খুন করছে৷ তাই আমি আর্মি অফিসার হয়ে ওদের সাথে যুদ্ধ করবো৷ আমি আবারো বললাম ঠিক আছে৷ কিন্ত যা-ই হতে চাসনা কেন ভাল করে লেখাপড়া করতে হবে৷ ঠিক আছে বলে ও চলে গেল৷ আমরা ওকে কিছুই বলি না৷ ওর সিদ্ধান্ত ও-ই নিক৷ কোন কিছু চাপিয়ে দেয়ার পক্ষে নই৷ শুধু প্রার্থণা করি ও যেই হোকনা কেন প্রথমে আল্লাহ্ যেন ওকে ভাল মানুষ বানায় এবং দীর্ঘজীবি করে৷ কেননা ওই আমাদের স্বপ্নের একমাত্র বাতিঘর৷
আমাদের বিয়ের পর দু”বছর সন্তান নেয়ার চেষ্টা করিনি৷ যদিও লেট ম্যারেজ৷ এরপর কোনভাবেই সন্তান হচ্ছিল না৷ জেলার বড় বড় ডাক্তার দেখালাম৷ পরিক্ষা করলো উভয়ের৷ রিপোর্ট দেখে বললো কোন সমস্যা নেই৷ চিকিৎসা করলে সব ঠিক হয়ে যাবে৷ আশান্বিত হয়ে চিকিৎসা চালাতে থাকলাম৷ তিন বছর হয়ে গেল৷ কিছু হলো না৷
ঢাকায় গেলাম৷ বড় বড় ডাক্তার আর ক্লিনিকে ছুটে বেরালাম৷ জলের মত টাকা খরচ হতে থাকলো৷ একটা সামান্য চাকুরিজীবির জন্য যা কল্পনাতীত৷ ঢাকাতে চার বছর চিকিৎসাতেও ব্যর্থ হলাম৷ যদিও ঢাকায় নতুন করে পরীক্ষা করে জানা গেল সমস্যাটা আমার৷ কিন্ত ইতিমধ্যে আমার স্ত্রী হতাশ হয়ে পড়লো৷ কিছুটা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেললো৷ হতাশা তাকে আত্মহত্যার পথ দেখাতে থাকলো৷ ইতিমধ্যে সে দু-দু’বার আত্মহত্যার চেষ্টা করে ফেললো৷ ভাগ্যিস একান্নবর্তি পরিবার তাই বেঁচে গেছে৷ চাকরির কারনে আমি বাহিরে থাকি৷ সপ্তাহে কিংবা পনেরো দিন পর পর বাড়ি আসতে পারি৷
বাড়ির সকলে রাগারাগি করলো৷ বললো তোর বৌয়ের রিস্ক কে নেবে? তুই বাড়িতে থাকিস না৷ এরমধ্যে যদি কোন অঘটন ঘটে যায়? এর দায় কে নেবে? পুলিশ’ আইন-আদালত সকলেতো আমাদেরকে জেলে ভরাবে৷ তারচেয়ে তুই তোর বৌকে সাথে নিয়ে যা কিংবা শশুর বাড়ি পাঠিয়ে দে৷ কথাগুলো শুনে এবং আমার স্ত্রীর Mental stress এর অবস্থা ভেবে খারাপ লাগলো৷ বুকটা হাহাকার করলো৷ খুব কান্না পেল৷ কিন্ত প্রচন্ড ব্যথায় কখনো কান্না আসে না৷
সিদ্ধান্ত নিলাম ওকে আমার সাথেই নিয়ে যাব৷ কেননা বৌকে বাপের বাড়ি রাখার জন্য বিয়ে করিনি৷ আর যেভাবেই হোক টাকা যোগাড় করে ইন্ডিয়াতে চিকিৎসা করবো৷ সেখানে মেডিকেল সাইন্স অনেক উন্নত৷ বরং এখন আফসোস হচ্ছে দেশে কতিপয় কসাই ডাক্তারের পিছনে সময় নষ্ট ও অর্থ না করে প্রথমেই ইন্ডিয়াতে যাওয়া উচিৎ ছিল৷ কিন্ত এত টাকা পাবো কোথায়? আত্মীয়-স্বজন, কলিগ এমনকি শশুর বাড়ির পক্ষের বিত্তবান বড়ভাই-শ্যালক কারো কাছেই কোন ইতিবাচক সাড়া পেলাম না৷
অবশেষে পৈত্রিকভাবে প্রাপ্ত জমিখানা বিক্রি করে ইন্ডিয়া চলে গেলাম৷ সেখানে তিন বছর চিকিৎসার ফলস্বরুপ আল্লাহ্ অবশেষে আমাদেরকে একটি সন্তান দিলেন৷ সেই হলো আমাদের আদরের ধন৷ আয়াত৷ ওর জন্মটাই আমাদের জীবন পাল্টে দিল৷ বহু বছর বেঁচে থাকার সাধ যোগাল৷ তাই ওর কোন কিছুতেই আমরা বাঁধা দেই না৷ ও হাসলে আমরা হাসি৷ ও কাঁদলে আমরা কাঁদি৷ কেন জানিনা৷
তবে আয়াত লেখাপড়ায় তুখোড়৷ প্রচন্ড মেধাবি৷ ওর বিশেষত্ব হলো৷ যখন যেটা করবে সেটা মনোযোগ আর অধ্যাবসায়ের সাথে করবে৷ তাই স্বাভাবিকভাবেই সে ক্ল্যাশের শুধু নয় ওর স্কুলেরও ট্যালেন্ট শিক্ষার্থি৷ শুধু লেখাপড়ায় নয়৷ স্কুলের ক্রিড়া ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগীতাতেও সে বরাবরের ন্যায় সেরাদের সেরা৷ ইতিমধ্যে সে অনেক পুরস্কার অর্জন করেছে৷ আমি ওকে একটা শোকেস কিনে দিয়েছি৷ সেখানে সে তার প্রাপ্ত অর্জনগুলো সাজিয়ে রেখেছে৷ কেউ বেড়াতে আসলে সেগুলো দেখিয়ে সে আনন্দ পায়৷ আমি দোয়া করি ওর এই আনন্দগুলো থাক চির অম্লান৷
ও যে প্রাইভেট স্কুলে পড়ে৷ সারাদেশব্যাপি ওদের শাখা৷ গতমাসে ওর স্কুল কর্তৃপক্ষ দেশব্যাপি অনলাইন ভোটের মাধ্যমে শ্রেণিভিত্তিক কবিতা আবৃর্ত্তির আয়োজন করে৷ আয়াত সেখানে বিশাল ভোটের ব্যাবধানে প্রথম হয়ে চূড়ান্ত পর্যায়ের উম্মুক্ত পর্বের সেরা পাঁচের লড়াইয়ে অবতির্ণ হয়৷ আনন্দের বিষয় হলো চূড়ান্ত পর্বের সেরা পাঁচের লড়াইয়ে সে সেরাদের সেরা অর্থাৎ প্রথম স্থান দখল করে৷ এটা যে কত আনন্দের তা বোঝানো মুশকিল৷
করোনার কারণে এখন লক ডাউন৷ তাই স্কুল বন্ধ৷ বাড়ির বাহিরে যাওয়া নিষেধ৷ চতুর্থ শ্রেণিতে পড়া একটা শিশুর জন্য এর চেয়ে বড় শাস্তি কী হতে পারে৷ তাই সারাদিন মোবাইলে গেম খেলে৷ কম্পিউটারে কার্টুন দেখে৷ টিভি দেখে৷ এভাবে আর কতদিন কাটে? দূরন্ত-চঞ্চল ছেলে এটা মানতে পারে না হয়তো৷
একদিন অফিস থেকে একটু তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরলাম৷ গ্রিলের দরজায় নক করলাম৷ কিন্ত আয়াত গেট খুলতে আসে না৷ বিষয়টা কী? ওতো আমার নক বুঝতে পারে৷ কেননা আমি গেটে পরপর তিনবার টোকা দেই৷ এটা শুনলে ও যেখানে থাক এমনকি গোসলরত থাকলেও সে নেংটু অবস্থায় এসে গেট খুলে আমাকে জড়িয়ে ধরে চুমু দিবে৷ কিন্ত এখনো ওর কোন খবর নেই৷ ওর মা গেট খুলে দিল৷ বললাম বেটা কোথায়? ও বললো খাটের নীচে৷ মানে কী? মানে কিছু নয়৷ তোমার ছেলের Aim in life আবার চেঞ্জ হয়েছে৷ আমাকে কিছু না বলে নিজে গিয়ে দেখ সে এখন কী হতে চায়! ঘরে ঢুকে ওকে ডাকলাম৷ খাটের নীচ থেকে সে বললো বাবা আস্তে কথা বলো৷ নাহলে খরগোশটা পালিয়ে যাবে৷ তখন খাবার সংকটে পড়বো৷ আমি রাগ হয়ে বললাম তুই আগে বের হয়ে আয়৷ তারপর তোর গল্প শুনবো৷ নাহলে শুনবো না৷ কিছুক্ষণ পর ও খাটের নীচ থেকে বেরিয়ে এলো৷ দেখলাম সারা শরীরে ধুলো, মাকড়সার জাল৷ নোংরা আর বিদঘুটে লাগছে৷ কাধে একটা ব্যাকপ্যাক৷ মাথায় ক্যাপ৷ একহাতে একটা ছোট টর্চলাইট অন্যহাতে পর্দা লাগানোর এলুমিনিয়ামের চিকণ পাইপ৷ মুখে একটু কালি লাগানো৷ বললাম বিষয়টা খুলে বল৷ ও যেটা বললো তার সারমর্ম হলো এখন ওর স্বপ্ন হলো বড় হয়ে সে বিয়ার গ্রিল হবে৷ আমি বললাম এটা কি ফাইনাল? একটু ভেবে বললো না বাবা আরো চেঞ্জ হতে পারে৷ আমি হাসতে হাসতে বললাম যা আগে গোসল করে আয়৷ তখন রসিয়ে রসিয়ে তোর কাহিনী শোনা যাবে৷ ও গোসলে গেলে আমি স্ত্রীকে বললাম ছুটির এই সময়টাতে ওকে একজন আরবী শিক্ষক দাও৷ কোরআন শিক্ষা দেয়াটাও আমাদের কর্তব্য৷ তাছাড়া সামনে রমজান আসার পূর্বে ও কোরআন খতম দিতে পারবে৷
ক’দিন এক হুজুর কোরআন তা’লিম দেয়া শুরু করলেন৷ ওর আগ্রহ আর মনোযোগের প্রশংসা করে বললেন৷ ও খুব তাড়াতাড়ি রপ্ত করতে পারবে৷ তাছাড়া ওর তাল-লয় ও সুর খুবই সুন্দর৷ হুজুরের কথাকে সত্যি প্রমাণিত করে ও দ্রুত সময়ের মধ্যেই সাবলীলভাবে কোরআন শরীফের আয়াতে তেলওয়াত শিখে গেল৷ কম সময়ে কোরআন শিক্ষা, হুজুরের প্রশংসা আর সুমধুর আয়াতে তেলওয়াতের কারণে সকলের কাছে ওর সুনাম আর গুরুত্ব বেড়ে গেল৷ কিছুদিন আগে ওকে দেখলে যারা কবিতা আবৃর্ত্তি শুনতে চাইতো৷ তারাই এখন শুনতে চায় আয়াতের তেলওয়াতে আয়াত৷
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।