কর্ণফুলির গল্প বলা সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে রবীন জাকারিয়া (পর্ব – ২)

(এই ধারাবাহিক গল্পের প্রত্যেকটি পর্বই স্বতন্ত্র৷ বলা যায় একেকটি গল্প৷ তাই একটি পর্বের পর অন্য পর্ব না পড়লেও পাঠকদের অসুবিধা হবেনা৷ তবে প্রত্যেকটি পর্ব পাঠ করলে একটা উপন্যাসের স্বাদ পাবেন বলে আশা করি৷)

ভাই

আমার বড়দা জেলা শহরে পড়তে যাওয়ায় মা অনেক খুশি৷ তিনি ভাবেন তাঁর লালিত স্বপ্নগুলো পূরণ হতে চলেছে৷ ছেলে দু’টি অনেক মেধাবী৷ নিশ্চয় মানুষের মত মানুষ হবে ইনশা’আল্লাহ্৷ কিন্ত মনের ভেতর চাঁপা বেদনা৷ ওদের জন্য কিছুই করতে পারছেন না৷ না দিতে পারলেন ভাল খাবার-দাবার৷ আর না ভাল জামা কাপড়৷ এতটুকু বয়স থেকেই ওরা শুধু কষ্টই করে গেল৷ পিতৃহীন এই দু’টি ছেলেকে সহায়তা করতে কেউ এগিয়ে এলো না৷ এমন কি চাচা-ফুফু, মামা-খালা কেউ নয়৷ যতদূর এগিয়েছে৷ ওদের নিজস্ব যোগ্যতা আর কঠোর পরিশ্রমে৷ খুব কষ্ট হয়৷ মা হয়ে এর চেয়ে কষ্ট আর কী আছে? বুক চিড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসে৷
ক’দিন থেকে মাকে খুব মলিন মনে হচ্ছে৷ চোখগুলো লালটে বর্ণের৷ মাকে কাছে ডেকে বলি, “কী হয়েছে মা? আমায় খুলে বলতো?” কিছু না বলে মা এড়িয়ে যায়৷ আমি অভিমান করে বলি যদি না বলো তাহলে কিছু খাবোনা৷ আমার জেদ দেখে মা মলিন একটা হাসি দিয়ে খুলে বললো সাজুটাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছেরে বাবা৷ বলেই আমাকে জড়িয়ে ধরে ছেলেমানুষের কাঁদতে শুরু করলো৷ তাঁকে সান্তনা দিতে না পেরে আমিও কাঁদতে লাগলাম৷ আমার সব সহ্য হয়৷ কিন্ত মায়ের কান্না দেখলে নিজের কান্না রোধ করতে পারিনা৷ তাছাড়া মা’র এখন বয়স হয়ে যাচ্ছে৷ আগের মতো মামাদের সংসারের সব কাজ করতে পারে না৷ তাই মামারা এখন আমাদেরকে পরিত্যাগ করেছে৷ আমরা এখন আলাদা থাকি৷ নানাজান বোধ হয় জীবদ্দশায় তাঁর সন্তানদের চরিত্র বুঝতে পেরেছিলেন৷ তাই মৃত্যুর পূর্বে সম্পত্তি বাটোয়ারা করে গেছেন৷ পৈত্রিকভাবে প্রাপ্ত মায়ের অংশে নতুন বাড়ি করেছি৷ এবার আর খড়ের ঘর নয়৷ টিনের ঘর বানিয়েছি৷ আমি এইটেও স্কলারশীপ পেয়েছি৷ আমাদের দু’ভাইয়ের বৃত্তির টাকা, বড়দার মত আমারও টিউশনির টাকা দিয়ে বাড়ি বানিয়েছি৷ আর কোনভাবেও আমরা মাকে আর দাসী বানাতে দেব না৷ এটা আমাদের প্রতিজ্ঞা৷
বড়দা ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে বায়ো কেমিস্ট্রিতে পড়ছে৷ থার্ড ইয়ার৷ আর কিছুদিনের মধ্যে ও বের হয়ে আসবে৷ ওর যে মেধা আমি নিশ্চিত ও ভাল একটা চাকুরি পেয়ে যাবে৷ মাকে বোঝাই আর ক’টা দিন অপেক্ষা করো৷ তোমার স্বপ্নের দিন এলো বলে৷ কথা শুনে মা হাসে৷ বলে ছোটরে তুই এখনো ছোটই থেকে গেলি৷ আমি কপট রাগ দেখাই৷ বলি দেখ মা আমি আর মোটেও ছোট না৷ এবার এসএসসি দিব৷ তারপর বড়দার মতো আমিও শহরের ভাল কলেজে পড়াশুনা করবো৷ আমাকে যে ডাক্তার হতে হবে মা৷ অনেক বড় হতে হবে৷ তোমার স্বপ্ন পূরণ করতে হবে৷
একথা শুনে মা খুব রিএক্ট করলো৷ মুখটা কাল করে কাঁদো কাঁদো স্বরে বললো৷ তুইও যদি শহরে চলে যাস৷ তাহলে আমি এখানে কাকে নিয়ে থাকবো?
মা’র কথা শুনে আমারও বোধোদয় ঘটলো৷ আসলেতো মা-তো কার সাথে থাকবে? এখানেতো তাঁকে রাখা ঠিক হবে না৷ তাছাড়া শরীরের অবস্থাও ভাল নয়৷ খেতে পারে না৷ শরীরটা ফোলা ফোলা মনে হয়৷ ভাল ডাক্তার দেখানো দরকার৷ বড়দাকে আসতে বলি৷ কিছুদিন পর বড়দা চিঠি পাঠায়৷ গ্রামেতো ভাল ডাক্তার নেই৷ তাই মাকে নিয়ে আমাকে ঢাকায় আসতে বললো৷ ঢাকায় যাওয়ার কথা শুনে আমিতো ভীষণ খুশি৷ কখনো সেখানে যাইনি৷ বন্ধুদের কাছে কত গল্প শুনেছি৷ কত বড় আর সুন্দর শহর৷ কিন্ত মনের আশা মনেই চেঁপে রেখেছি৷ এখন সুযোগ এসেছে বলে খুশি লাগছে৷ কিন্ত মা যেতে চাচ্ছে না৷ তাঁর নাকি ভয় লাগে৷
কিছুদিন পর মাকে নিয়ে ঢাকায় গেলাম৷ বড়দা ডাক্তার দেখালো৷ অনেক টেস্ট করানো হলো৷ রিপোর্ট দেখে ডাক্তার মাকে হাসপাতালে এডমিট করতে বললেন৷ আমরা দু’ভাই ভয়ে অস্থির৷ কী হয়েছে মায়ের? কিডনী জনীত রোগ৷ কিছুদিন ডাক্তাররা দেখবেন অসুধে কাজ হয় কী-না! তা নাহলে কিডনী প্রতিস্থাপন করতে হবে৷ কী ভয়ংকর ব্যাপার! আমরা এত টাকা পাবো কই? তাছাড়া কিডনীই বা কে দেবে? হাসপাতালের বেডে মায়ের মলীন মুখ দেখতে ইচ্ছে করে না৷ কান্না পায়৷ মা বুঝে গেছে সে আর বেশিদিন বাঁচবে না৷ তাই দু’ভাইকে ডেকে বললো, ” বাবা কেউই চিরকাল বেঁচে থাকে না৷ মরে যেতে আমার একটুও ভয় নেইরে সোনা৷ আমিতো মরে গেছি সেদিনই, যেদিন তোদের বাবা মরে গেছে৷ মানুষটার অনেক স্বপ্ন ছিল তোদেরকে মস্ত মানুষ বানানোর৷ দেখে যেতে পারেনি৷ আমিতো বেঁচে আছি শুধু ওঁর স্বপ্ন পূরণের জন্য৷ আর আমাকে বাঁচতেই হবে৷ তোরা আমাকে নিয়ে চিন্তা করিস না বাবারা৷”
মায়ের এসব কথা শুনে বুকে মোচড় দিয়ে উঠে৷ কিন্ত মুখে হাসি হাসি মুখটা ধরে রাখি৷ মা যেন কিছুই বুঝতে না পারে৷
দুই ভাই ভীষণ চিন্তা করছি৷ কী হবে! মাকে কীভাবে বাঁচাবো! কিডনী কেনার মত টাকা নেই৷ হঠাৎ মনে হলো আচ্ছা আমার চেক আপটা করে দেখি না? যদি ম্যাচ করে? ভাই ও মাকে গোপন করে আমি ডাক্তারের সাথে কথা বললাম৷ তিনি চেক আপের পর হতাশ করলেন৷ ম্যাচ করেনি৷ ভীষণ কান্না পাচ্ছে৷ কাঁদতে পারছি না৷ শেষে মা-ভাইয়ের কাছে ধরা খাই৷
পরেরদিন বড়দা হঠাৎ করে এসে বললো কিডনী পাওয়া গেছে৷ একজন মৃত্যুপথযাত্রী ব্যক্তি নাকি নিজের অঙ্গ দান করেছেন৷ কিন্ত নিজের পরিচয় গোপন করতে চান৷ বড়দা’র কাছে এসব কথা শুনে দু’ভাই দু’জনকে জড়িয়ে ধরলাম৷ কিছুক্ষণ চিৎকার করে হাসলাম৷ তারপর কেন যেন কান্না চলে এলো৷ নিজেদের সামলাতে পারলাম না৷ কাঁদতে কাঁদতেই আল্লাহ্’র দরবারে শুকরিয়া জানিয়ে বললাম আলহামদুলিল্লাহ্৷
ক’দিন পর বড়দা বললো মায়ের অপারেশনের দিন সে থাকতে পারবে না৷ তাকে সপ্তাহখানিকের জন্য বাহিরে যেতে হবে৷ যে লোক কিডনী দিচ্ছে৷ তার গ্রামের বাড়ি৷
বড়দা ছাড়া আমার অনেক দৌড় ছুট করতে হলো৷ তবুও অবশেষে মায়ের অপারেশনটা সাকসেসফুল হলো৷ ধীরে ধীরে মা সুস্থ্য হয়ে উঠলো৷ কিন্ত বড়দা’র কোন পাত্তা নেই৷ একদিকে ওর উপর রাগ জন্মাচ্ছে৷ অন্যদিকে চিন্তাও হচ্ছে৷ ওর খারাপ কিছু ঘটলো নাতো? কী-যে করি! মাথা আউলায় যাচ্ছে৷
অবশেষে সমস্ত চিন্তার অবসান ঘটিয়ে একদিন বড়দা এসে হাজির৷ ওকে পেয়ে মা আর আমি যেন প্রাণ ফিরে পেলাম৷ কিন্ত ওকে দেখতে কেমন ফ্যাকাসে আর অসুস্থ মনে হচ্ছে৷ বিষয়টা কী? জানতে চাইলে বললো, অচেনা জায়গা আর গ্রামের পরিবেশটা নাকি ওকে স্যুট করেনি৷ তাই কিছুদিন অসুস্থ্য হয়ে পড়েছিল৷ এখন ভাল৷” যাক বাবা সব কিছুই ভালই ভালই হয়ে গেল৷ ভীষণ একটা শান্তির বাতাস যেন শরীর আর মনকে চাঙ্গা করে দিল৷ ভুলেই গেলাম কতটা দিন না ঘুমে, না খেয়ে কাটিয়ে দিলাম৷ শুধু মায়ের সেবা করেই৷
আজ মাকে রিলিজ দিয়েছে৷ মাকে নিয়ে দু’ভাই বাড়ি ফিরছি৷ মাঝখানে মা বসে আছে৷ তার দুই দিকে আমরা দু’ভাই৷ ভাড়া মাইক্রোবাসটা শহর পেরিয়ে এখন আমাদের গ্রামের মেঠোপথ বেয়ে চলছে৷ চারিদিকে ধুলোর মেঘ৷ ভাল করে দেখা যাচ্ছেনা কিছুই৷ পিছনে চিৎকার আর চেচামেচির শব্দ বলে দেয় গাড়ি দেখে গ্রাম্য কিশোরদের দূরন্তপনার কথা৷ উইন্ডশীল্ডের ভেতর দিয়ে নেমে আসে শেষ বিকেলের সূর্য্যের রক্তিম আলোচ্ছটা৷ আজকের সূর্য্যটাকে কেন যেন বড্ড মায়াবী আর সুন্দর লাগছে৷ না কি এভাবে কখনো দেখা হয়নি প্রকৃতি? এখনো মা তার দুই হাত দিয়ে ধরে রেখেছে দুই ছেলের হাত৷ শক্ত করে৷ মাথাটা ঘুরিয়ে তাদের দিকে তাকাই৷ আরো গভীর ভাবে দেখি৷ অনুভব করি ঐ সূর্য্যটার চেয়ে অনেক অ-নে-ক বেশী সুন্দর আর মায়াবী আমার বড়দা এবং মা৷

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।