রবীন্দ্রনাথের শৈশবের জীবনকাহিনী তাঁর সাহিত্যে প্রতিভাসিত হয়েছে “ডাকঘর”এর অমল চরিত্রের মধ্যে। শিশু অমল শিশু রবিরই নাট্যসংকেত। “ডাকঘরে”র শিশু অমল “নষ্টনীড়ে” কৈশোর উত্তীর্ণ অমল বলে অনুমান করা অসঙ্গত হবে না।
বৌঠান চারুলতার প্রেরণায় তার পিসতুত দেওর অমলের কবিত্ব উন্মেষই “নষ্টনীড়” গল্পের উপজীব্য।
কবির একটি বিশেষ অন্তরঙ্গ অভিজ্ঞতা তাঁর সৃষ্টিলোকে প্রতিফলিত হয়ে জীবনলব্ধ সত্যকেই শৈল্পিক সুষমা দিয়ে আরো বেশি সত্যি করে তুলেছে ‘নষ্টনীড়ে’ । বাস্তবের বৌঠান শিল্পসত্যে বিকশিত হয়ে ‘নষ্টনীড়ে’র চারুলতায় প্রতিভাসিত হয়েছে।
……..চারুলতার স্বামী ভূপতির প্রচুর টাকা ছিল। তখন দেশের পরিস্থিতিও ছিল গরম। আর ভাগ্যবশতঃ ভূপতি কাজের লোক হয়েই জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর মত ধনী লোককে দলে পাবার লোভে তাঁর উৎসাহদাতার অভাব ছিল না। ভূপতি হলেন সংবাদপত্রের সম্পাদক। সম্পাদকি নেশা আর রাজনৈতিক নেশা তাঁকে অত্যন্ত জোর করেই ধরেছিল। তাই ” যে সময়ে স্বামী – স্ত্রী প্রমোন্মেষের প্রথম অরুণালোকে পরস্পরের কাছে অপরূপ মহিমায় চিরনূতন বলিয়া প্রতিভাত হয়, দাম্পত্যের সেই স্বর্ণপ্রভামন্ডিত প্রত্যুষকাল অচেতন অবস্থায় কখন অতীত হইয়া গেল কেহ জানিতে পারিল না।” ভূপতির সংসারে তাঁর বালিকাবধূ চারুলতা ধীরে ধীরে যৌবনে পদার্পণ করল।
লেখাপড়ায় চারুর স্বাভাবিক ঝোঁক ছিল বলে সে নিজের চেষ্টায় নানা কৌশলে পড়ার ব্যবস্থা করে নিয়েছিল। ভূপতির পিসতুতো ভাই অমলকে ধরে সে পড়া করে নিত। তার বদলে অমলের অনেক আবদার তাকে সহ্য করতে হত। ভূপতি চারুলতার কাছে কোনো দাবি করত না, কিন্তু সামান্য একটু পড়িয়ে দিয়ে অমলের দাবির অন্ত ছিল না। সংসারে চারুর কাছে কেউ কিছু চায়না, অমল চায় – সেই একমাত্র প্রার্থীর প্রার্থনা পূরন না করে চারু থাকতে পারে না। এইসব ছোটোখাটো শখের খাটুনিতে তার হৃদয়বৃত্তির
চর্চা এবং চরিতার্থতা লাভকরে ধন্যহয়।
ভূপতির অন্তঃপুরে একখন্ড জমি ছিল। তাকে বাগান করে তোলার জন্য চারু এবং অমল ছবি এঁকে,প্ল্যান করে, মহা উৎসাহে একটা বাগানের কল্পনা ফলাও করে তুলেছে।….
… তাদের এই সব পরিকল্পনার মূল সুখ এবং গৌরব এই ছিল যে, সেগুলি তাদের দুজনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ।
তাদের স্বপ্ন অন্য কেউ যাতে না জানতে পারে তাই চারু অমলকে গল্প লেখার অনুরোধ জানায়। ইচ্ছে এই যে, তাদের স্বপ্নকামনা ভাষা পাবে, অথচ তারা দুজন ছাড়া অন্য কেউ তা বুঝতে পারবে না।তবে
….. “সেদিন সেই গাছের তলায় অমল সাহিত্যের মাদকরস প্রথম পান করিল।…
অমলের লেখাই এখন তাদের আলোচনার প্রধান বিষয় হয়ে উঠল। অমলের সাহিত্যরচনা এবং চারুকে তা পড়ে শোনানো – এই হল দুজনার রোজকার কাজ আর এই সৃষ্টি নিয়েই শুরু হল দুজনার মান – অভিমানের পালা। নতুন এক লেখকের লেখার প্রশংসা করে চারু অমলের মনে ঈর্ষা সৃষ্টি করতে লাগল। এরপর একদিন সাময়িক পত্রিকায় অমলের আত্মপ্রকাশ। সেই ছাপার লেখা দেখিয়ে বৌদিকে অবাক করে দেবার জন্যে অমল যখন উন্মুখ তখন এক অজানা দুঃখে চারুর মন ব্যথিত হল।
অমলের লেখা তাদের দুজনের ব্যক্তিগত সম্পত্তি। গোপনীয়তা তাদের লেখার প্রধান রস। সে লেখা সবাই পড়বে এবং প্রশংসা করবে এটা কোনও মতেই মানতে পারেনা চারু। কিন্তু লেখক এখন আর একজন পাঠকে সন্তুষ্ট হতে পারে না। অনেক ভক্তের চিঠিও আসতে লাগলো। অমলকে লেখায় উৎসাহ দেবার জন্যে চারুর আর প্রয়োজন রইল না। তাদের দুজনার মাঝে ভক্তের অনুরাগ ব্যবধান রচনা করে দিল। বৌঠানের স্নেহের পরশে গড়ে ওঠা সুখনীড় বহু অনুরাগীর প্রশংসার জোয়ারে ভেসে নষ্ট হয়ে গেল।
———– তথ্যসূত্র :- ‘নষ্টনীড়’, ‘গল্পগুচ্ছ’ দ্বিতীয় খণ্ড। ‘কবিমানসী’ জগদীশ ভট্টাচার্য।