।। ত্রিতাপহারিণী ২০২০।। T3 শারদ সংখ্যায় রূপক চট্টোপাধ্যায়

অহংকার

এই যে, হ্যাঁ আপনাকেই বলছি। দাঁড়ান একটু। কোথায় যাচ্ছেন? কোথায় গন্তব্য আপনার ? জানি আপনি উত্তর দিতে পারবেন না। একটা অদৃশ্য হ্যাঁ এর ভেতর দিয়ে হেঁটে চলা পথটার গন্তব্য যে কোথায়, তা আপনি কেনো কেউ বলতে পারে না। তবুও হাঁটতে হয়। বিবশ হয়ে, বশীভূত সাপের মতো ফণা নামিয়ে!
আপনিও হাঁটছেন তাই না? হ্যাঁ আপনারও একটা নাম আছে। অযুত নামের ভীড়ে আপনারও একটা নাম আছে। সবার যেমন থাকে আর কি। আর নামের শেষে বেশ মোজাইক করা চকচকে একটি পিতৃ প্রদত্ত
পদবি। সাজানো আছে ছোটো বেলা থেকেই। যেমন আপনার ভূতের মতো জীর্ণ দোতালার ছাদে সাজানো আছে টবে টবে পোষ মানা গোলাপ, রজনীগন্ধা, চন্দ্রমল্লিকা, আরও কত ক্যাকটাস। গীতোশ্রী তো রোজ জল দেয়। গীতোশ্রী আপনার স্ত্রী, আমি জানি। হাড়ের সন্ধিতে সন্ধিতে ইউরিক অ্যাসিড জমেছে, টন টন করে ব্যাথায়। হাই প্রেসার, রাতে ঘুম হয় না ঠিক ঠাক। সারা রাত দু জনে তো জেগে কাটান। একটা সময় শরীর জাগতো শরীরের টানে। এখন তো রোগ আপনাদের জাগিয়ে রাখে। তবু গীতোশ্রী সক্কাল বেলা ঘুম থেকে উঠেই ছাদে এসে গাছ গুলো তে জল দেয়। গোলাপ গাছ গুলো জল পেয়ে প্রগলভ কিশোরীর মতো কচি পাতা নাড়িয়ে গীতোশ্রী র সাথে গল্প করে। আপনি ওসব শুনতে পান না। একটু জল দিতে দেরি হলে পাশের টবের ক্যাকটাস টা কাঁটা ফুলিয়ে দাঁড়ায়। আপনি সায়েন্সের ছাত্র ছিলেন। জানি ওসব বুঝবেন না। জল দেওয়া শেষ হলে গীতোশ্রী ছাদ থেকে নেমে এসে বাথরুমে ঢুকে। সারা রাতে বার সাতেক পেচ্ছাপ ওঠেন আপনি। স্ফিংটার পেশী র কার্যক্ষমতা কমেছে। পেচ্ছাপ ধরে রাখতে পারেন না। বাথরুমে দুর্গন্ধ ওঠে। তীব্র ঝাঁঝালো গন্ধ। গীতোশ্রী নাখ চাপা নেয় না। অভ্যাস হয়ে গেছে। গন্ধ টা তার ভালো লাগে, এর মাঝেও গীতোশ্রী আপনার ভালোবাসা খুঁজে পায়। বাথরুম সাফ হলে। গত রাতের আপনার পোষাক কাচে। খেতে গেলে তো জামাতে ঝোল, সব্জী র কাই, কত কি পড়ে যায়। গীতোশ্রী সব ডিটারজেন্ট দিয়ে সাফ করে। তার পর স্নান। এখনো কাঁচা পাকা চুল খুলে দিলে কোমর ছুঁয়ে যায়। কপালে গোল সিঁন্দুরের টিপ পরলে দেবী দুর্গার মতো লাগে। আপনি দেখেন। মনে মনে আপনার অহংকার হয়। গীতোশ্রী আপনার। গীতোশ্রী ছিলো সে সময় কার রাধামাধব কলেজে র ডাক সাইটে র সুন্দরী। কত ছেলে ডুবে তলিয়ে গেছে।
শেষে আপনার মতো পাগল ভোলানাথ। নিতান্তই কেরানী র জীবন। তবুও প্রেমে পড়ে ছিলো আপনারা।
অনুর পরে ইতু। অনুকে তো গ্রামের বাড়ি বিক্রি করে ডাক্তারি পড়িয়েছেন। এখন বৌ নিয়ে সিডনি তে স্যাটেল হয়েছে। বছর সাত আগে এসেছিলো। বলে ছিলো বাবা বাড়ি টা বেচে ওল্ডেজ হোমে চলে যাও। সব খরচা ও দেবে। আপনি শুনেন নি। চিরকালই আপনি জেদী লোক। গীতোশ্রী বলে তোমার ওই জেদ টুকু ছাড়া আর কোনো গুন নেই। চলুন এবার আপনার মেয়ে র কথায় আসি। চেন্নাই এ থাকে জামাই বড়ো ঠিকাদার। টাকা ওড়ে। বড়ো বাংলো।
মদ ক্যাসিনো কি নেই। ইতু আর খবর রাখে না। আপনার অমতে পালিয়ে বিয়ে। আপনিও খবর রাখেন না। পেনশন র টাকায় দাঁত কামড়ে পড়ে আছেন। জেদ আর কাকে বলে। এখন মাঝে মধ্যে বুকে র বাঁ দিকটা চিন চিন করে। কেনো জানেন?
হার্টের সমস্যা না কি অসফল পিতৃত্বের যন্ত্রণা।
ব্যাগে কি নিয়েছেন। ও সব্জী আর বাটা পোনা। গীতোশ্রী খুব ভালো বাসে বাটা মাছ। ওটা কি?
এমা লিপস্টিক ! কার জন্যে? এই সত্তর বছর বয়সে
স্ত্রীর জন্য লিপস্টিক নিয়ে যাচ্ছেন। ও কি বললেন? আজ বিবাহের চল্লিশ টা বসন্ত পার হলো। ও আজ তবে গীতোশ্রী শ্যাম্পু করবে তাঁর সাদা কালো চুলে, গুঁজবে গোলাপ কুঁড়ি। ঠোঁটে দেবে আপনার দেওয়া ভালবাসার উপহার। আর আপনি আপনার বুকের বাঁ পাশে র চিন চিনে ব্যথা টা চেপে ধরে গীতোশ্রী র কানে কানে বলবে -তুমি আমার অহংকার! স্যাঁতসেতে ঘরটার দেওয়াল গুলো টলমল করে উঠবে তখন।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।