সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে রঞ্জন চক্রবর্তী (পর্ব – ৯)

উপন্যাসের বহুমাত্রিক রূপ

কালের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সমাজবাস্তবতাও পরিবর্তিত হয় যাকে ঔপন্যাসিক সাহিত্যরূপ দান করেন। সুতরাং বাস্তবতার সঙ্গে উপন্যাসের সম্পর্ক বহুমাত্রিক। উপন্যাসে যেসব ঘটনা ও চরিত্র উপস্থাপিত হয় সেগুলি অতীত বা বর্তমানের বাস্তবজীবন থেকে উঠে আসে। ঔপন্যাসিক যে কেবল একটি আদর্শ নৈব্যক্তিক মানুষ গড়েন তাই নয়, আসলে তিনি নিজের সত্ত্বার একটি implied version সৃষ্টি করেন।লেখকের সৃষ্ট চরিত্রের মাধ্যমে সমাজ এবং তার রাজনৈতিক. অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ইত্যাদি বিভিন্ন দিকগুলি উপন্যাসে তুলে ধরা হয়। উপন্যাস তাই জীবনের সমগ্রতা, নরনারীর সম্পর্ক ও বাস্তবের জমিতে দাঁড়িয়ে জীবনসংগ্রামের মহাকাব্যিক কথাভাষ্য। কোথাও তা জীবনের বহিরঙ্গের বর্ণনা, আবার কোথাও তা জীবনের অন্তরঙ্গ বিশ্লেষণ।
উপন্যাস বাস্তব জীবনের সঙ্গে সম্পর্কিত এবং জীবনায়নের মূলকথা হল চরিত্রগুলির মনোজগতের জটিলতার বিশ্লেষণ। নিত্যদিনের জীবনের ঘটনাপ্রবাহের সাবলীলতার বর্ণনার মধ্যে দিয়ে পরিচিত সত্যকে উপন্যাসের পাতায় শিল্পরূপ দেওয়ার মধ্যে লেখকের জীবনবোধ ও অন্তদৃষ্টি কাজ করে। উপন্যাসের ঘটনাবলীর সংলগ্নতা, উপাদানসমূহের মধ্যে সামঞ্জস্য এবং প্রতিনিধিস্থানীয় চরিত্রগুলির মধ্যে সম্পর্ক নির্ভর করে ঔপন্যাসিকের ঐক্য চেতনার উপর। রচনায় কৃত্তিমতা, আকস্মিকতা বা অতিনাটকীয়তা আরোপিত হলে উপন্যাসের শিল্পরূপ ক্ষুন্ন হয়। সমাজ ও জীবনের বাস্তবতা রূপায়ণের ক্ষেত্রে লেখকের পরিমিতিবোধ অত্যন্ত জরুরী।
কালের প্রবাহের সঙ্গে তাল মিলিয়ে জীবনও গতিশীল হওয়ায় জীবন সম্পর্কে লেখকের দৃষ্টিভঙ্গীও পরিবর্তনশীল। সমকালীন সমাজের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য ও ব্যক্তিমানুষের চরিত্র লেখকের নিজস্ব মূল্যবোধের নিরিখে উপন্যাসে রূপায়িত হয়। এই রূপায়ণের সার্থকতা নির্ভর করে লেখকের বাস্তবতাবোধ, জীবনবোধ ও পরিমিতিবোধের উপর।উপন্যাসে লেখকের বিষয়বস্তুর জ্ঞান, উপলব্ধির গভীরতাও বাস্তববোধ মিশে থাকার ফলে তা জীবনের সামগ্রিক রূপ প্রকাশ করতে পারে। তাত্ত্বিক বিচারে এই প্রকাশক্ষমতাই লেখকের জীবনদর্শন। এটা ঘটনা ও চরিত্রের বিশ্লেষণের মাধ্যমে উপলব্ধ জীবন সম্পর্কে তাঁর ধারণার বিন্যাস থেকে বুঝতে পারা যায়। বাস্তবতাবোধের সঙ্গে জীবনদর্শন মিশে থাকে বলেই উপন্যাসে লোকসমাজ ও মানবজীবনের ভাষাচিত্র অঙ্কণ করা যায়। এক অর্থে আমরা সকল ঔপন্যাসিককেই মানবজীবনের দার্শনিক বলে অভিহিত করতে পারি, যাঁর প্রকাশমাধ্যম হল সাহিত্যের ভাষা।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।