নভেলা গল্প হলেও সত্যি-তে রাজদীপ ভট্টাচার্য – ধারাবাহিক (রু)

অষ্টম পর্ব
পুজোর পরে মাঠপুকুরে ফিরে অফিসে জয়েন করেছে পলাশ। কদিন ছুটির পরে এখন কাজের পাহাড়। বাধ্য হয়ে ফাইল বাসায় নিয়ে এসে সন্ধেবেলাও ঘাড় গুঁজে বসতে হচ্ছে। সেদিন বিছানায় বসে ওই কাজই করছিল এমন সময় সুমি এসে ডাকলো পলাশকে — পলাশ দা, একটু ওপরে চলুন। মায়ের শরীর খারাপ লাগছে। বাবা ডাকছে আপনাকে।
দুজনে দৌড়ে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠলো। মাসীমা কেমন নেতিয়ে পড়েছেন। রেসপন্স করছেন না। দেখে একদম ভালো মনে হল না পলাশের। বলল — মাসীমাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে এখুনি। আমি অ্যাম্বুলেন্স ডেকে আনছি।
মাঠপুকুরে বিডিও অফিসের পাশে প্রগতি সংঘ ক্লাব। সেখানে একটা মারুতি এইট হান্ড্রেডকেই অ্যাম্বুলেন্স হিসেবে কাজে লাগানো হয়। দ্রুত সেটাকে ডেকে আনলো পলাশ। তারপর সবাই মিলে মিনতি চট্টরাজকে তোলা হল তাতে। সোজা বর্ধমান হাসপাতালে।
যা ভেবেছিল পলাশ ঠিক তাই – সেরিব্রাল অ্যাটাক। খুব দ্রুত হাসপাতালে দেওয়ায় রক্ষে। সারারাত সেখানেই কাটলো। পরদিন অফিসে ফেরার সময় পলাশের সাথে সুমি বাড়ি ফিরে এলো। সমীর বাবু হাসপাতালেই রয়ে গেলেন।
অফিস থেকে অন্যদিনের তুলনায় একটু আগেই ফিরে এলো পলাশ। বাড়িতে সুমি একা, তাছাড়া মাসীমার খোঁজখবর নেওয়াও জরুরী। ঢুকতেই সুমি জানালো — বাবা ফোন করেছিল। ডাক্তাররা বলছে এখন ভয়ের কিছু নেই। অল্পের উপর দিয়ে গেছে।
— যাক বাবা, খুব টেনশন হচ্ছিল সারাদিন।
— তবে মায়ের বাঁদিকটা প্যারালাইজড হয়ে আছে। পুরো সেরে উঠতে কিছুদিন সময় লাগবে।
— ও নিয়ে চিন্তা কোরো না। মাসীমা ঠিক মাসখানেকের মধ্যে ফিট হয়ে যাবেন।
পাশের বাড়ির এক কাকিমা এতক্ষণ ছিলেন সুমির সাথে। তিনি এবার বাড়ি ফিরে যাবেন তাই বলে গেলেন — দাদা না এলে আমাকে জানাস সুমি। তাহলে আমি রাতে শুতে আসবো।
বাড়িতে আর কেউ নেই। ফলে সুমি নিচে পলাশের সাথেই রয়ে গেল। ব্যাপারটা অস্বস্তিকর, কিন্তু মানিয়ে নেওয়া ছাড়া আর কিছুই করার নেই। উপর থেকে চানাচুর নিয়ে এসে মুড়ি মাখলো সুমি। তাই খেতে খেতে ঠিক হল রাতে চালে – ডালে ফুটিয়ে নেওয়া হবে যাহোক। সমীর বাবুও ফোন করে জানালেন যে আজ রাতে আসছেন না। কথায় কথায় সময় বইতে লাগলো।
যতই হোক মায়ের অসুস্থতা মেয়ের উপর প্রভাব ফেলেই। কি আর বয়স সুমির! পলাশ কথা ঘুরিয়ে যতই অন্য প্রসঙ্গে যায় সুমি সেই উদ্বেগের কথাতেই ফিরে আসে। বারবার বলে — এটা প্রথমবার বলে হয়তো মা বেঁচে গেল। এমনটা আবার যদি হয় তাহলে কী হবে!
ওর চোখে জল টলটল করে। সাধ্যমতো সান্ত্বনা দেয় পলাশ। তবু ভবি ভোলবার নয়। বাধ্য হয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত করে মেয়েটাকে। লতানে গাছের মতো পলাশকে অবলম্বন করে ভেঙে পড়ে সুমি। যেন পলাশ পরিত্রাতা।
সুমির ভিতরে এতদিন পলাশের প্রতি তিল তিল করে জমে ওঠা নির্ভরতা যেন দলা পাকিয়ে ওঠে। ফোঁপাতে থাকা মেয়েটিকে পোষ মানানোর কোনো উপায় খুঁজে পায় না পলাশ। দুই বাহু ধরে ওকে তুলে ধরার চেষ্টা করতেই সুমি ওর বুকে মুখ ঘষতে থাকে ঘোরের মতো। পলাশ বুঝতে পারে উদ্বেগ উত্তেজনা মেয়েটিকে ঠিক – ভুল, শোভন – অশোভনের পাঁচিল পার করে দিচ্ছে। কিন্তু পরিত্রাণের উপায় পায় না কোনো। সুমি মুখ তুলে নিমেষে খুঁজে নেয় পলাশের ঠোঁট। পাগলের মতো চুমু খেতে থাকে ওকে। জেগে উঠতে উঠতে শেষ সীমায় পোঁছে পলাশ কোনোক্রমে নিজেকে আলাদা করতে পারে। বিছানায় উপুড় হয়ে পড়ে সুমি। ঘর ছেড়ে বাইরের বারান্দায় এসে দাঁড়ায় পলাশ। চোখে পড়ে বেশ ধারালো একটা হলুদ চাঁদ উঠেছে পূর্বাকাশে দূরে তাল গাছের সারির পিছনে।