Cafe কলামে রাজদীপ ভট্টাচার্য – ১

প্যাস্টেল কালার – ১

আছি

কালিম্পং এর এই পাহাড়ি অরণ্যে ঘেরা হোম-স্টেতে সারা রাত বিছানায় শুয়ে শুনি ঝিঁঝিঁর অন্তহীন ধ্বনি। মাঝে মাঝে কাছে-দূরে কুকুরের আওয়াজ। আর থেকে থেকে একটা অচেনা পাখির ডাক। এই থমকে থাকা প্রকৃতির মধ্যে ঝিঁঝির কিনকিনে ধ্বনিতরঙ্গ যেন দূরের গুম্ফা থেকে ভেসে আসা মায়াবী ঘন্টাধ্বনির মতো শোনায়। যেন আমরা সকলে অপেক্ষায় আছি, এবার সমবেত আরাধনা শুরু হবে। চোখ বন্ধ করলে ভেসে আসে রহস্যময় পাহাড়ি ধূপের গন্ধ।
দিনের বেলাতেও ঝিঁঝির এই ধ্বনিতরঙ্গ নেভে না, আদুরে নদীর মতো বাজতেই থাকে, বইতেই থাকে। মূল রাস্তা ছেড়ে আমি অরণ্যের গভীরে ঢুকে যেতে চাই। আঁকাবাঁকা পাথুরে রাস্তা। কখনো মৃদু ঢালু, আবার কখনো ধাপে ধাপে খাড়া নেমে গেছে খাদের দিকে। পাইনের পাশাপাশি পূর্ব হিমালয়ের অরণ্যে ঘন বাঁশের বন বেশ দেখা যায়। ভোরের নির্জন পথে কট্ কট্ শব্দ বাজে থেকে থেকে। দুপাশের গাছপালা, ইলেকট্রিকের তার থেকে ঝুলে থাকে নধর স্কোয়াশ। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এভোকাডো গাছ থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে সবুজ ফল।
সারাদিনের চড়াই ভেঙে ক্লান্ত শরীর বিছানায় এলিয়ে দেওয়া মাত্র গদির নরমে আমাকে টেনে নিতে থাকে। নিবিড় অন্ধকার রাতে জানলার শার্সি পেরিয়ে চোখে পড়ে ডেলো পাহাড়ের গুঁড়ো গুঁড়ো আলো। আরও আরও দূরে তরঙ্গের মতো ছড়িয়ে থাকা পূর্ব হিমালয়ের অসংখ্য রেঞ্জের বুকে দিনের বেলা লুকিয়ে থাকা নগণ্য জনপদগুলিও রাতের অন্ধকারে মূর্ত হয়ে ওঠে। সমগ্র দিকচক্রবাল জুড়ে ছড়িয়ে যাওয়া চুমকিচূর্ণের মতো আলোর কণিকা জেগে থাকে। পরিষ্কার রাতের আকাশে তারা সব মিশে যায় বহুদূরের নক্ষত্র বিন্দুদের সাথে। আর গভীর রাতে সেই রহস্যময় পরিবেশে সহসা ডেকে ওঠে নাম না জানা পাখি- ঈইইই…ঈইইই…ঈইইই। চোখ বন্ধ করে বিছানায় শুয়ে মনে হয় যেন সে পাখি জানান দেয়, ইয়া..ইয়া..ইয়া। আছি..আছি..আছি। আমিও একান্তে নিজেকে বলি, আছি..আছি..আছি..।
এই থাকাটুকুই আসল। আমি যতক্ষণ আছি, ততক্ষণ এই পৃথিবী, সূর্য, চাঁদ, নক্ষত্রজগত, প্রকৃতি, সংসার, সৌন্দর্য, আনন্দ-দুঃখ-বিষাদ, ভালোবাসা-ঘৃণা…সব, সব সত্যি। আর আমি না থাকলে সকল বোধই অতীত। ঘুমের মধ্যে চেতনার পর্দায় টোকা মারে পাখির স্বর। অস্ফুটে বলে উঠি, আছি..আছি..আছি..।

চলবে

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।