সম্পাদিকা উবাচ

লতা মঙ্গেশকর মানেই একটা গোটা অধ্যায়। সাত দশক পরে সেই অধ্যায়ের অবসান ঘটল। রবিবার (৬ ফেব্রুয়ারি) সুরসম্রাজ্ঞী লতা মঙ্গেশকর প্রয়াত হয়েছেন। তাঁর নশ্বর দেহটাই শুধু হারিয়ে গেছ কালের গর্ভে তার সৃষ্টি চিরকাল অবিনশ্বর হয়ে থাকবে হৃদয়ের অন্তর মহলে৷

লতাজীর প্রথম প্লেব্যাক গান চলচ্চিত্র থেকে বাতিল হয়েছিল। ১৯৪২ সালে মারাঠি ছবির জন্য ‘নাচু ইয়া গাদে-খেলু শারি মানি হাউস ভরি’ নামে একটি গান গেয়েছিলেন লতা। এটাই তাঁর জীবণে গাওয়া প্রথম প্লেব্যাক। তবে দুর্ভাগ্যের যে ওই ছবি থেকে এই গানটি বাদ দেওয়া হয়েছিল। অথচ তারপরের লতাজী কিংবদন্তী! লতাজীর সঙ্গীতের এই যাত্রা আর একবার প্রমাণ করে দিল সাধনার কোন বিকল্প নেই৷

লতা মঙ্গেশকরের প্রথম নাম হেমা। ১৯২৮ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর মারাঠি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন লতা। একটি পত্রিকার খবর অনুযায়ী তার বাবার নাম দীননাথ মঙ্গেশকর, যিনি একজন নাট্য অভিনেতা ও গায়ক ছিলেন।
আগের নাম হেমা থাকলেও বাবার “ভাব বন্ধন” নাটকে “লতিকার” চরিত্রে প্রভাবিত হয়ে হেমার নাম বদল করে রাখা হয় লতা।

লতা মঙ্গেশকর তাঁর জীবনে শুধু একদিনের জন্যই স্কুলে গিয়েছেন। কথিত আছে স্কুলে নিজের ছোট বোন আশা ভোসলেকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন লতা। তারপর ক্লাসের মধ্যেই নিজের সহপাঠীদের গান শেখানো শুরু করেন তিনি। স্কুলের শিক্ষকরা এ কারণে তাকে শাসন করলে অভিমান করে স্কুলে যাওয়া ছেড়ে দেন লতা।জ

লতাজির প্রথম উপার্জন ছিল ২৫ টাকা । প্রথম বার মঞ্চে গাওয়ার জন্য লতা ২৫ টাকা উপার্জন করেছিলেন।লতা ১৯৪৪ সালে মারাঠি ছবি ‘কিটি হাসাল’ এর জন্য প্রথম গান গেয়েছিলেন।

১৯৯৯-এর ২২ সেপ্টেম্বর থেকে ২০০৬ সালের ২১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত রাজ্যসভার সাংসদ ছিলেন লতা মঙ্গেশকর। সাংসদ থাকাকালীন কোনও পারিশ্রমিকই নেননি লতা মঙ্গেশকর। তবে তিনি বলেছিলেন, সংসদ তাঁর জন্য নয়। সাংসদ পদ থেকে ইস্তফার ইচ্ছা প্রকাশও করেছিলেন।

গিনেস বুক অফ রেকর্ডসে নাম উঠেছিল লতা মঙ্গেশকরের। ১৯৭৪ সালের সংস্করণে লতা মঙ্গেশকরকে সর্বাধিক রেকর্ড করা শিল্পী হিসাবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছিল। তবে সর্বাধিক রেকর্ড করা শিল্পীর তালিকায় ছিল রফির নামও। লতার পাশপাশি রফির নামও ছিল গিনেস রেকর্ড বুকে।

লতা মঙ্গেশকর কখনো ওপি নায়ারের সঙ্গে কাজ করেননি। ভারতের বিখ্যাত সব সঙ্গীত ও চলচ্চিত্র পরিচালকদের সঙ্গে কাজ করলেও কাজ করা হয়নি ওপি নায়ারের সঙ্গে।

শুধু দেশ নয়, বিদেশেও সমান সমাদৃত লতা মঙ্গেশকরের গান। লতাই প্রথম ভারতীয় যিনি লন্ডনের রয়্যাল অ্যালবার্ট হলে গান গেয়েছেন। ২০০৭ সালে ফ্রান্স সরকার তাদের দেশের সর্বোচ্চ অসামরিক পুরস্কার অফিসার অফ দি লেজিয়ান অফ অনার সম্মানে লতা মঙ্গেশকরকে সম্মানিত করেছেন।

যতীন মিশ্রর বই, “লতা সুর গাথা”তে লতাজি বলেছেন, “প্রায়ই রেকর্ডিং করতে করতে ভীষণ ক্লান্ত হয়ে পড়তাম আমি আর ভীষণ খিদে পেত আমার। তখন রেকর্ডিং স্টুডিওতে ক্যান্টিন থাকতো, তবে নানা রকম খাবার পাওয়া যেত কি না? সে বিষয়ে আমার মনে নেই। তবে চা-বিস্কুট খুঁজে পাওয়া যেত তা বেশ মনে আছে। সারাদিনে এক কাপ চা আর দু চারটে বিস্কুট খেয়েই সারাদিন কেটে যেত। এমনও দিন গেছে যে দিন শুধু জল খেয়ে সারাদিন রেকর্ডিং করছি , কাজের ফাঁকে মনেই আসেনি যে ক্যান্টিনে গিয়ে কিছু খাবার খেয়ে আসতে পারি। সারাক্ষণ মাথায় এটাই ঘুরতো যেভাবে হোক নিজের পরিবারের পাশে দাঁড়াতে হবে আমাকে।”

ক্রিকেটের প্রতি তাঁর ভালোবাসার কথা আজ আর কারোর কাছে অজানা নয়। ২০১১ সালের ক্রিকেট বিশ্বকাপে ভারত যখন সেমিফাইনাল ম্যাচে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে খেলতে নেমেছিল, তখন গোটা দিন উপোস করে কাটিয়েছিলেন ভারতের নাইটিঙ্গেল।

ভারতীয় ক্রিকেট দলের প্রাক্তন অধিনায়ক মহেন্দ্র সিং ধোনির গুণমুগ্ধ ভক্ত ছিলেন লতা। ২০১৯ সালের ক্রিকেট বিশ্বকাপ থেকে ভারত যখন ছিটকে গিয়েছিল, সেই সময় গুঞ্জন উঠতে শুরু করেছিল যে ধোনি বোধহয় অবসর গ্রহণ করে নেবেন। আর এই খবর শুনে কার্যত দুঃখে ভেঙে পড়েছিলেন লতা। তিনি ক্যাপ্টেন কুলকে টুইট করে নিজের মনের কথাও জানিয়েছিলেন।

তিনি লিখেছিলেন: “প্রিয় ধোনি’জি, গত কয়েকদিন ধরেই আমি শুনতে পাচ্ছি যে আপনি ক্রিকেট থেকে অবসর নেওয়ার চিন্তাভাবনা করছেন। দয়া করে এমন চিন্তাভাবনা করবেন না। আপনাকে এবং আপনার অবদানের দরকার রয়েছে এই দেশের। ফলে এখনই অবসর নেওয়ার কথা চিন্তাভাবনা করবেন না।”

১৯৬৩ সালের ২৭ জানুয়ারি ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুর সামনে ভারত-চীনের সীমান্তে চলা যুদ্ধের কিছুকাল পরেই এক অনুষ্ঠানে গান করেন লতা। তাঁর কন্ঠে ‘এ মেরে ওয়াতান কে লোগো” গানটি শুনে কেঁদে দেন প্রধানমন্ত্রী নেহেরু।

“मेरी आवाज ही मेरी पहचान है” এই অমোঘ সত্য সৃষ্টির অন্তিম লগ্ন পর্যন্ত লতাজীর পরিচয় হয়ে আমাদের হৃদয়ে থেকে যাবে৷
ভারতের নাইটিঙ্গেলকে অপার শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করলাম সামান্য কিছু শব্দের মধ্যে দিয়ে৷ প্রণাম নেবেন৷

রাজশ্রী বন্দ্যোপাধ্যায়

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।