নভেলা গল্প হলেও সত্যি-তে রাজদীপ ভট্টাচার্য – ধারাবাহিক (রু)

শেষ পর্ব

রুনারা কাল আসছে। প্রান্তিকের কাছেই একটা হোম স্টে বুক করে রেখেছে পলাশ। অফিসে দুইদিনের ছুটি নিয়েছে আগেই। পৌষমেলা চলে এলো কিন্তু এখনো জমিয়ে শীত পড়েনি এখানে। তাও সকাল সাতটায় উঠে রেডি হয়ে মাঠপুকুর থেকে সেই প্রান্তিকে গিয়ে ওদের দলবলকে রিসিভ করা বেশ চাপের। নিজের ব্যাগপত্তর গুছিয়ে রেখেছে। যাতে সকালে হুড়োহুড়ি কিছুটা কমে। এই কয়েকমাসে অচেনা মেয়েটার সঙ্গে আলাপ ক্রমশ ঘন হয়েছে। খুবই পজিটিভ মনের মেয়ে রুনা। এখনো নিয়মিত পড়াশোনা করে। বিভিন্ন চাকরির পরীক্ষায় বসে সিরিয়াসলি। রোজ রাতে একবার কথা হয় প্রতিদিন। এরমধ্যে অবশ্য বারদুয়েক কোলকাতায় দেখাসাক্ষাৎ হয়েছে। মুখোমুখি কিছু বার্তা বিনিময়। আঙুলে-আঙুলে, হাতে-হাতে টেলিগ্রাফিক সংকেতের যাওয়া আসা। কিন্তু একটা জীবন কাটানোর জন্য এটুকু জানা যথেষ্ট নয়। এই কয়েকদিনে আরও কাছ থেকে দেখাশোনা হবে। ভিতরে ভিতরে বেশ একটা থ্রিলিং ব্যাপার অনুভব করছে পলাশ।

লাস্ট একমাসে ইন্দ্রাণী বা রেমির সাথে আর দেখা হয়নি। তবে ফোনে কথা হয়েছে কয়েকবার। ইন্দ্রাণী বেশ ভালো আছে। সবকিছু নর্মাল। আর রেমি ভীষণ খুশি। ও নিজেই একদিন ফোন করেছিল। প্রথমে খানিকটা অস্বস্তিতে পড়েছিল পলাশ। কিন্তু রেমি নিজেই কাটিয়ে দিয়েছে কথায় কথায়। পলাশ বলেছিল — প্লিজ তুমি অন্যরকম কিছু ভেবো না। ইট ওয়াজ জাস্ট অ্যান এক্সিডেন্ট!
রেমি উত্তর দিয়েছিল — বিগ ব্যাং ওয়াজ অলসো অ্যান এক্সিডেন্ট ব্রাদার। বাট নাও ইট্ ইজ দ্য কজ অফ এভরিথিং!

এই শীতকালে রাত ন’টা বাজলেই মাঠপুকুরে সব নিস্তব্ধ হয়ে যায়। উপরে সুমিরাও শুয়ে পড়ে দশটার মধ্যে। আগে তবু মাঝেমধ্যে ইন্দ্রাণী বা রেমিকে অকারণেই ফোন করা যেত। কিন্তু এই ঘটনার পরে ওর ভিতরে একটা অস্বস্তি হয়। রেমি যতই স্পোর্টিং মনোভাব দেখাক পলাশ বারবার ফোন করলে একটাসময় তার মনেও কিছু বালির দানা কচকচ করে ওঠাই স্বাভাবিক।

এই সময়টা পলাশের খুব একা লাগে মাঝেমাঝে। কাঁহাতক ফোন ঘেঁটে সময় নষ্ট করা যায়! বিভূতিভূষণ বড় প্রিয় লেখক ওর। রচনাবলীর পাতা ওল্টায় চুপচাপ।

স্মৃতির রেখা’র পাতায় ৩১ জানুয়ারি ১৯২৮ বিভূতিভূষণ লিখছেন — “অপূর্ব্ব জ্যোৎস্না রাত্রি!… চারধার নিস্তব্ধ, সামনের কাশবনের মাথায় দুগ্ধশুভ্র জ্যোৎস্নাধৌত আকাশে রহস্যময় তারার দল। শুধুই মনে পড়ে, জীবনটা কি বিচিত্র রহস্য —- যেদিকে যাওয়া যায়। চাঁপাপুকুরের সেই যে বাড়ীটাতে নিমন্ত্রণ করেছিল, আমাদের গ্রামের সেই দশ-বিঘা দানের বাঁশবন, বড় চারা আমতলায়, জাঙ্গিপাড়ার স্কুলের সামনের মাঠে —- এরকম জ্যোৎস্না পড়েছে আজ —- যখন এই সব বিভিন্ন স্থান ও তৎসংশ্লিষ্ট স্মৃতির কথা মনে ভাবি তখনই হঠাৎ জীবনের বিচিত্রতা প্রগাঢ় রহস্য আলোকে অভিভূত করে দেয়।”

এই অবধি পড়ে মুখ তুলে তাকায় পলাশ। দরজা খুলে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়। কালপুরুষের পায়ের কাছে জ্বলজ্বল করছে লুব্ধক। ওর মনে হয় এই লাজুক নক্ষত্রই এই মুহূর্তে আলো পাঠাচ্ছে ইন্দ্রাণীর দুই চোখে। এই নীলাভ আলো ছুঁয়ে যাচ্ছে রুনার নম্র চিবুক। হয়তো সুমির বিছানায় এককোনে চুপিচুপি শুয়ে আছে এই আলো। আর এই আলোর খোঁজেই প্রতিটি জীবন বুক ঘষে, গুঁড়ি মেরে, হেঁটে, দৌড়ে ছুটে চলেছে সময়ের এক মাইলস্টোন পেরিয়ে অপরটির দিকে। একটা জীবন মানে আসলে কিছু আলো ও অন্ধকারের লুকোচুরি মাত্র।

বিভূতিভূষণ লিখছেন — ” হাজার হাজার বর্ষ স্থায়ী বিচিত্র প্রেম তাদের জন্ম-জন্মান্তরের মধ্যে দিয়ে অনন্ত জীবন-মৃত্যু বিরহমিলনের ভিতরে অক্ষুণ্ণ, চির সঞ্জীব ধারায় বয়ে চলে — কত সভ্যতার উত্থান-পতনের মধ্যে দিয়ে, কত পৃথিবীর ধ্বংসসৃষ্টির তালে তালে।… আমি এই আকাশ, এই তারাদল, এই অপূর্ব্ব জ্যোৎস্নারাত্রি, এই নির্জ্জন মুক্ত জীবন ভালবাসি। প্রাণভরে ভালবাসি।”

ইন্দ্রাণীর আন্তরিক ভালোবাসা, উষ্ণতার বাষ্প পলাশের মনে ক্ষণিকের জন্য চলকে ওঠে। খোলামেলা রেমির একগাল হাসি যেন সহসা স্ফূর্তি আনে ওর বুকে। অপাপবিদ্ধ রুনার সরল সপাট কথাগুলো বেজে ওঠে মস্তিষ্কের পর্দায়। এসবই আলোর রকমফের। সারাটি যাপনজুড়ে শুধু এক আলো থেকে আরেক আলোর দিকে যাত্রা। মাঝের অন্ধকারগুলি থাকে বলেই গন্তব্য আরও প্রিয় আরও প্রেয় হয়ে ওঠে। মানুষ শেষ দমতক লড়ে যায় ওই গন্তব্য ছুঁয়ে ফেলার অন্তহীন প্রচেষ্টায়। আমরা প্রত্যেকেই তাই এই সমস্যাদীর্ণ, ক্লান্তিকর ছেঁড়াফাটা জীবনটিকেই শেষঅবধি ভালোবেসে ফেলি। বারবার ফিরে পেতে চাই হারানো সময়। হারিয়ে যাওয়া মানুষ ও মুহূর্ত।

হঠাৎই রিংটোন বেজে ওঠে। বালিশের নিচ থেকে ফোন বের করে আনে পলাশ। অরুন্ধতী মিত্রকে শুধু ‘রু’ নামে সেভ করে রেখেছিল ও। স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখে জ্বলজ্বল করছে —- রু কলিং!

কল রিসিভ করে পলাশ কানে নেয় ফোন। ‘রু’ মানে ‘আলো’। একটা আলোর দিকে অভিযাত্রা শুরু হচ্ছে ওর জীবনে। আগামীকাল।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *