নভেলা গল্প হলেও সত্যি-তে রাজদীপ ভট্টাচার্য – ধারাবাহিক (রু)

পঞ্চম পর্ব

ভোর ছটায় ঘুম ভেঙে গেছে পলাশের। উঠে জানলা খুলতেই তেরচা রোদ এসে পড়েছে ঘরের মেঝেয়। বাড়ির পাঁচিল পেরিয়ে দৃষ্টি ছুটে গেছে দূরে। চাষের ক্ষেত। ঘাসের বন। একটি দুটি করে কাশফুল মাথা তুলেছে। তারপর অজয়ের ধারা। হলুদ বালি আর ঝিরঝিরে জল উঁকি মারছে সেখানে।

বাথরুমের কাজ সেরে গুটি গুটি পায়ে নিচে নেমে এসেছে পলাশ। বাইরে বেরুতেই রতন দা’র সাথে মুখোমুখি দেখা। ও বলেছে — একটু চারপাশে ঘুরে আসছি দাদা। ইন্দ্রাণীকে বলে দেবেন।

রতন দা হেসে বলেছে– মেলা দেরি করবেন না যেন। চা জুড়িয়ে যাবে।

বর্ষার প্রায় শেষ এখন। আর মাসখানেক পরেই মা দুর্গা এসে পড়বে। প্রকৃতিও সেই সুরে সেজে উঠছে রোজ একটু একটু করে। মাঠে ধানের বুকে দুধ এসেছে। আকাশে ফিরোজা রঙের গালিচা পেতে দিয়েছে কারা। তার বুকে সাদা খরগোসের পালের মতো মেঘের দল চরে বেড়াচ্ছে। ফতুয়া আর পাজামা পরে এসেছে পলাশ। সকালের শিরশিরে হাওয়া আদর করে যাচ্ছে সারা গায়ে।

কাল রাতে বিছানায় শুয়ে কিছুতেই ঘুম আসছিল না। অমন অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতার জন্যই হোক কিংবা এই অপরিচিত পরিবেশের কারণে। অবশেষে একসময় ক্লান্তির কাছে স্নায়ু জবাব দিয়েছে। তার আগে অবধি বিছানায় শুয়ে শুয়ে ও ইন্দ্রাণীকে বুঝতে চেয়েছে। কী চাইছে সে?

সকালে ঘুরেফিরে এসে প্রথমে চা – বিস্কুট। খানিক পরে লুচি আর সাদা আলুর তরকারি। দশটা নাগাদ ইন্দ্রাণীর সাথে একতলার স্টুডিওতে অ্যাঁন্দ্রে আর রেমির ছবিগুলো এক দফা দেখা। অজস্র চারকোল স্কেচ আছে অ্যাঁন্দ্রের। চল্লিশ – পঞ্চাশ বছর আগের বোলপুর – শান্তিনিকেতনের চেহারা ভারি সুন্দর ভাবে ধরা পড়ে এই ছবিগুলোতে। ও তাই ইন্দ্রাণীকে বলছিল — এই স্কেচগুলো একসাথে করে একটা বই প্রকাশের কথা ভাবতে পারো তোমরা। তাতে সেই সময়ের পরিবেশ চমৎকার ধরা পড়বে আগ্রহীর চোখে।

গতকাল রাতের কোনো চিহ্ন আজ ইন্দ্রাণীর চেহারায় ছিলো না। বরং ওর কথায় ব্যবহারে মনে হচ্ছিল সবটাই পলাশের হ্যালুসিনেশন। পলাশকে সাথে নিয়ে গিয়ে অ্যাঁন্দ্রের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলো। যদিও ভদ্রলোক সেভাবে সাড়া দিতে পারলেন না। বয়স এবং দীর্ঘ রোগভোগ মানুষটাকে জীবনের শেষ প্রান্তে এনে দাঁড় করিয়েছে। তবু মৃদু হেসে সামান্য হাত নাড়ালেন। সাদা বিছানায় কাগজ-সাদা মানুষটিকে বড় অসহায় দেখাচ্ছিল। গাল বেয়ে গড়িয়ে আসা মুখরস যত্নে আঁচলে মুছিয়ে দিলো ইন্দ্রাণী। তখন ওকে এক শিশুর পাশে স্নেহময়ী মায়ের মতোই মনে হচ্ছিল।

দুপুরে বেশ গুরুভোজন হয়ে গেল। অনেক দিন পরে কচি পাঁঠার ঝোল এত আয়েস করে খাওয়া হল। কোলকাতায় পাঁঠার মাংস মানেই এখন রেওয়াজি থলথলে চর্বির ঘনঘটা। আজকের মাংসটা সেই ছোটবেলায় গ্রামে পিসির বাড়ির রান্নার কথা মনে করিয়ে দিলো।

ডাইনিং টেবিলে খেতে খেতে গল্প হল অনেক। ইন্দ্রাণীর ছোটবেলার কথা। পাঠভবন ও বিশ্বভারতীতে পড়াশুনার বিভিন্ন অনুষঙ্গ। নৃত্যনাট্য, রিহার্সাল, পৌষ মেলা, এখানকার গাছপালা – পাখি – ফুল ইত্যাদির হাজারো টুকরো টাকরা। উঠোনের চালতা গাছ থেকে পাকা চালতা পেড়ে তার টক করেছিল আজ। কতদিন পরে চালতায় বিট নুন ছড়িয়ে খেলো পলাশ। খুব ভালো লাগছিল এই সঙ্গ, এই আন্তরিক আবহাওয়া। মনে হচ্ছিল এই বাড়িতে যেন একদিন আসার কথাই ছিলো ওর। অনেক অনেক কাল আগে ও কথা দিয়েছিল আসবো। তা কয়েক হাজার বছর হবে। হয়তো তখন রেমি ছিলো এক গ্রিক তরুণ অশ্ব ব্যবসায়ী। ইন্দ্রাণী তার এদেশীয় প্রেমিকা। কোনো একদিন সূর্যাস্তকালে দুজনের দেখা হয়েছিল প্রাচীন উজ্জয়িনীর পথে। একটি সুলক্ষণযুক্ত সাদা ঘোড়া কিনতে এসে পলাশের সাথে তাদের পরিচয় হল। হাত ধরে বারবার নিজগৃহে নিয়ে যেতে চেয়েছিল যুগলে। সেদিন কি সে গেছিলো নাকি আর কিছুতেই যাওয়া হয়নি! আজ এত বছর পরে পথ চিনে চিনে পলাশ এসে দাঁড়িয়েছে তাদের উঠোনে। মাঝে অসংখ্য শীত – গ্রীষ্ম – বর্ষা পার হয়ে গেছে। তবু ভালোবাসার সেই উষ্ণ আহ্বান আজও অমলিন।

মাঝে মাঝে এমন হয় পলাশের। কোনো কোনো ঘটনা যখন ওর সাথে ঘটে তখন মনে হয় এ যেন পুনরাবৃত্তি। অনেক কাল আগে ঠিক এমনটাই ঘটেছিল। কিংবা এমন যে হবে তা অনেক আগেই যেন ওর জানা ছিল। তাই নিজের প্রতি সন্দেহ হয় যে এটা বুঝি কোনো মানসিক রোগ! যেমন মহুলিতে এসে অবধি ওর বারবার মনে হচ্ছে যে এই বাড়ি ওর চেনা। হয়তো আগেও এসেছে। তবে তা এই জন্মে নয়। অনেক অনেক আগের কোনো এক জীবনে। কুয়াশার ভিতর থেকে উঠে আসা স্মৃতি ভিড় করে থাকে পলাশের মনে। আর সেই স্মৃতির রহস্যের ভিতরে পাক খেতে খেতে একসময় ওর দু’চোখের পাতা কখন যেন লেগে গেছিলো।

ইন্দ্রাণীর ঠেলাঠেলিতে যখন ঘুম ভাঙল তখন ঘড়ির ছোটো কাঁটা পাঁচ পেরুচ্ছে। চোখ চাইতেই ইন্দ্রাণী বলল —- কাল রাতে কি একেবারেই ঘুম হয়নি পলাশ বাবুর? চারটের পরে এসে একবার দেখে গেলুম অঘোরে ঘুমাচ্ছ। এখন ঠেলে না তুললে রাত্রি অবধি টেনে দিতে বোধহয়। যাও মুখে-চোখে জল দিয়ে এসো। আমি চা ঢালছি।

পলাশ হাত মুখ ধুয়ে আসতে আসতে ইন্দ্রাণী সাদা কাপ প্লেটে চা – বিস্কুট সাজিয়ে বসেছে সামনের বারান্দার বেতের চেয়ারে। এখানে বসেও দূরে অজয়ের মৃদু বয়ে যাওয়া চোখে পড়ে। ঘাস আর কাশ বনের ভিড়ে কুয়াশা জমেছে পাতলা সরের মতো। ক্রমশ ফুরিয়ে আসা আলো নাছোড় ডিওডোরেন্টের ঘ্রাণ হয়ে এখনো লেগে আছে পৃথিবীর বুকে। পূর্ব আকাশের প্রথম তারাটি এইমাত্র জেগে উঠলো ওদের দুজনের চোখের নাগালে। পুরনো বাড়ির এখানে ওখানে পায়রার বাসা। তাদের মৃদু গুটুর গুটুর শোনা যাচ্ছে। ফাঁকা কাপ – প্লেট নিয়ে উঠে গেল ইন্দ্রাণী। যাবার সময় বলল — তুমি ঘরে গিয়ে বোসো। আমি নিচে রান্নাঘর থেকে ঘুরে আসি।

উঠতে ইচ্ছে করল না পলাশের। চুপ করে বসে রইল অনেকক্ষণ। এই তীব্র একাকীত্ব ভালো লাগছিলো। চিরকালের শহুরে ব্যস্ততার অতীত এই সময়ে নিজেকে খুঁজে পাওয়া যায় আবার। ওই দূরের তারা থেকে চুঁইয়ে আসা নীলাভ আলো যেন ওর জন্যই এতপথ বেয়ে এসেছে। সম্প্রতি জেমস্ ওয়েবের টেলিস্কোপে তোলা ছবিগুলো ওকে আবারও নতুন করে ভাবিয়েছে বেশ। সৃষ্টির শুরুতে সেই ব্রহ্মাণ্ড ফেটে গেল আর প্রতিটি কণা দানবীয় বিস্ফোরণে ছড়িয়ে গেল দূর হতে দূরে। আজও সেই দূরগামী পথ সচল রয়েছে। ক্রমশ সবাই আমরা যেন পরস্পরের কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছি।

ছোটবেলায় মা – বাবাকে ছেড়ে দূরে থাকার কথা শিশু ভাবতেও পারে না। পলাশের বেশ মনে আছে। তখন বছর তিন – চার বয়স হবে। মামারবাড়িতে ওকে দুপুরবেলা ঘুম পাড়িয়ে রেখে মা কখন মাসিদের সাথে সিনেমায় চলে গেছিল। ঘুম থেকে উঠে মা কে না দেখতে পেয়ে কেঁদে ভাসিয়েছিল পলাশ। বাড়ি ভর্তি লোকজনের কোনো সান্ত্বনাই সেদিন তাকে থামাতে পারেনি। অথচ আজ মা – বাবা কত দূরের গ্রহ হয়ে গেছে তার কাছে। এভাবেই সবাই প্রতিদিন একটু একটু করে শুধু দূরে সরে যায়। যত বড় হই আমরা তত একলা হয়ে যাই ভিতরে ভিতরে। নিজের খোলসের মধ্যে আরও গুটিয়ে বসে থাকি। একটা তীব্র মনখারাপ যেন জাপটে ধরছিল পলাশকে। সন্ধের চাপ চাপ অন্ধকার কখন চুপিচুপি নেমে এসে বসেছিল ওর মনখারাপের পাশে।

একটা কাচের বোউলে বেশ কিছু চিকেন পকোড়া, ঠান্ডা জলের বোতল আর কাচের গ্লাস নিয়ে নীরবে উঠে এসেছিল ইন্দ্রাণী। পলাশকে অন্ধকারে বসে থাকতে দেখে অবাক হল —- কী হয়েছে? বাড়ির কথা ভেবে মনকেমন করছে নাকি?

মৃদু হেসে ফেলল পলাশ। বলল — না, তেমন কিছু না। পুরনো কথা মনে পড়ছিল। ছোটবেলার স্মৃতি।

— বেশ। বোতলটা কি আস্তো আছে? থাকলে নিয়ে এসো। এখানেই বসি দুজনে। ঘরের চার দেওয়াল আর ভাল্লাগছে না।

— কিন্তু রতন দা চলে এলে যে খারাপ ভাববে।

— আরে না না। প্রথমত রতন দা এখন আর উপরে আসবে না। রাতে শুধু গোবিন্দভোগের খিচুড়ি আর বেগুনি হবে। সেসব বুঝিয়ে এসেছি। ওইটুকু রতন দাই করে ফেলবে। আর দ্বিতীয়ত এই বাড়িতে কারণবারির জন্য কোনো কারণ লাগে না। বাপ – ছেলে দুজনেই কারণে অকারণে জলচর হয়ে যায়। অবশ্য বাপ এখন রিটায়ার্ড হার্ট। সুরা থেকে সরে গেছে অসুস্থতার জন্য।

টেবিলের উপরে সব সাজিয়ে ফেলে ইন্দ্রাণী। সুদৃশ্য কাচের গ্লাসে ছোটো ছোটো পেগ বানায়। গ্লাসের পারস্পরিক উল্লাসে তরল চলকে ওঠে। পরপর তিনটে পেগ দ্রুত শেষ করে ইন্দ্রাণী। তখনও পলাশের দ্বিতীয় বারের সুধাপাত্র শেষ হয়নি। চোখ বন্ধ করে চেয়ারে হেলান দিয়ে থম মেরে কিছুক্ষণ বসে থাকে ইন্দ্রাণী। পলাশ বলে — এত দ্রুত খেও না।

— জানো, মা মারা যাওয়ার পরে কিছুদিন এলকোহলিক হয়ে গিয়েছিলাম। তখন মেয়ে ওর বোর্ডিং স্কুলে। বাড়িতে আমি পুরোপুরি একা। বাবার রেখে যাওয়া টাকা ভেঙে দিন কাটছে। শেষ হয়ে গেলে তারপর কী হবে জানি না। এইসময়ই রেমির সাথে প্রথম পরিচয়।

— মদ ছাড়লে কীভাবে?

— ভালোবাসা পেলে মানুষ সব নেশা কাটিয়ে উঠতে পারে। মদ তো একটা অছিলা ছিলো আমার কাছে।

কথা বলতে বলতে চতুর্থ পেগ শেষ করল ইন্দ্রাণী। মৃদু জড়ানো কন্ঠস্বরে বললো — আজ আবারও অনেক দিন পরে সোনালী তরলে ডুবে যেতে ইচ্ছে করছে।

— তোমার প্রথম বিয়ে ভাঙলো কেন? যদি বলতে না চাও তবে বোলো না। আমি কিছু মনে করব না তাতে।

হাত তুলে ওকে থামিয়ে দিলো ইন্দ্রাণী। একটু সময় নিয়ে গ্লাস শেষ করে নামিয়ে রাখলো। চেয়ারে মাথা এলিয়ে দিয়ে চোখ বুঁজে শুয়ে রইল খানিকক্ষণ। তারপর হঠাৎ নীরবতা ভেঙে বলে উঠল — বিভাস মানুষটা খারাপ ছিলো না জানো। বোলপুর এস বি আই তে চাকরি করত। তবে বড্ড পজেসিভ। শান্তিনিকেতনের খোলা হাওয়ায় বড় হয়ে এত বদ্ধ মনের কী করে হল কে জানে! কোনো পুরুষের সাথে আমাকে কথা বলতে দেখলেই ভিতরে ভিতরে উন্মাদ হয়ে যেত। অবশ্য বাইরে তার কোনো প্রকাশ ছিলো না। আগুন জমে থাকতো ভিতরে। ঘরে ফিরে অস্থির হয়ে উঠতো। যতক্ষণ না সবটা দিচ্ছি অপ্রকৃতস্থের মতো আচরণ করত। আসলে প্রতিবার আমাকে গিলে খাওয়ার মধ্যে দিয়ে ও নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চাইতো নতুন নতুন করে। ঘূর্ণিঝড়ের শেষে নিস্তব্ধ গ্রাম যেমন লন্ডভন্ড হয়ে যায় তেমন পড়ে থাকতাম আমি।

চুপ করে বসে শুনছিল পলাশ। এলকোহল কাজ করতে শুরু করেছে ততক্ষণে। স্নায়ু আলগা হয়ে গেছে। ইন্দ্রাণী আরও একটা পেগ ঝড়ের মতো শেষ করে মুখ খুলল আবার — কোথাও কোনো ভালোবাসা ছিলো না। প্রতিটি রাতে গামছার মতো নিঙড়ে নিতো আমাকে। বিয়ের পরে প্রথম প্রথম খুব উপভোগ করতাম এই আদর। তখন প্রথম শরীর চিনছি। প্রতিটি লুকোনো খাঁজে এত সুখ জমে থাকে বুঝিনি কোনোদিন। তারপর দিনের পর দিন এক রুটিনে সবকিছু চলতে চলতে একঘেয়ে হয়ে গেল। মানুষের মন তো কোনো যন্ত্র নয় যে একটা সুইচ টিপলেই আলো জ্বলে উঠবে। তাকে ভালোবেসে টিউন করতে হয়। সঠিক তারে যথাযথ ভাবে না বাঁধতে পারলে মহল জমে না। তখন মৃত্তিকা সবে হয়েছে। আমার শরীর বেশ দুর্বল। তাও প্রতি রাতের যন্ত্রণা সহ্য করতে হতো। রাগ করে কয়েকদিন ওকে ঠেকিয়ে রাখায় প্রায় সাইকো পেশেন্টের মতো আচরণ করতে লাগলো। আমার পিসতুতো দাদা, পাড়ার চেনা কাকু এরকম যাদের সাথে কখনো সখনো সামনাসামনি কিংবা ফোনে কথাবার্তা হতো তাদের সবার সঙ্গে আমার মনগড়া শরীরী সম্পর্কের কথা বলতে শুরু করল। এরপর আর থাকতে পারলাম না। মেয়েকে নিয়ে চলে গেলাম বাপের বাড়ি। সেখানে গিয়েও বিভাস বাবাকে মাকে অপমান করতে লাগলো। তখন আর কোনো উপায় ছিলো না আমার কাছে। সম্পর্ক ভেঙে গুঁড়ো করে ফেললাম নিজের হাতে।

একের পরে এক গ্লাস ফাঁকা করে ফেলছিল ইন্দ্রাণী। পলাশ সাবধান করল– আর খেও না। বিপদে পড়বে।

মৃদু হেসে গান ধরল ইন্দ্রাণী — বিপদে মোরে রক্ষা কর এ নহে মোর প্রার্থনা বিপদে আমি না যেন করি ভয়…
গাইতে গাইতে অনাবশ্যক ভাবে ঝুঁকে পড়ছে ইন্দ্রাণী। কন্ঠস্বর যেন গড়িয়ে যাচ্ছে পাহাড়শীর্ষ থেকে খাদে। আবার চড়াই বেয়ে উঠছে ধীরে ধীরে। ও তখন গাইছিল — সংসারেতে ঘটিলে ক্ষতি লভিলে শুধু বঞ্চনা নিজের মনে না যেন মানি ক্ষয়… অন্ধকারে তীব্র নিস্তব্ধতার মধ্যে দিয়ে যেন এক অজানা কন্ঠস্বর মুচড়ে মুচড়ে উঠছিল অযুত বছরের যন্ত্রণা নিঙড়ে দিতে দিতে।

মোবাইলে এক ঝলক দেখল পলাশ। সাড়ে নটা বেজে গেছে। এবার ডিনার সেরে ফেলা জরুরী। বলল ইন্দ্রাণীকে — চলো অনেক রাত হয়ে গেছে। খিচুড়ি টেস্ট করে আসি। নাহলে রতন দা বসে থাকবে।

জড়ানো গলায় ইন্দ্রাণী বলল — তুমি খেয়ে এসো। আমি আজ আর কিছু খাবো না। এখানেই বসে আছি ভালো লাগছে।

যাবে কী যাবে না এই নিয়ে দোনোমোনো করতে করতে ও নিচে গেল। রতন দা রান্না ঘরে ছিল না। ওর পায়ের শব্দে অ্যাঁন্দ্রের রুম থেকে বেরিয়ে এল। বলল — বৌদি আসবে না?

— না, ইন্দ্রাণী খাবে না বলল। আমাকে অল্প করে দিয়ে দাও। বেশি দিও না আবার।

সামান্য খিচুড়ি আর দুটো বেগুনি খেয়ে যখন পলাশ উপরে পৌঁছল দেখল ইন্দ্রাণী চেয়ারে ঘুমাচ্ছে। বোতল আরও কিছুটা খালি। ওকে ডাকতে হুঁ হ্যাঁ ছাড়া আর কিছু বলতে পারল না। রাত দশটা বেজে গেছে। এভাবে খোলা বারান্দায় থাকলে নিঃসন্দেহে শরীর খারাপ হবে। টেনে তোলার চেষ্টা করল। টানা হ্যাঁচড়ায় নেশা একটু কেটে গেল ইন্দ্রাণীর। বলল — উঠতে পারছি না। তুমি তুলে ঘরে দিয়ে এস।

— কিন্তু আমি এতটা নিয়ে যাব কী করে? তুমি তো ছোট বাচ্ছা নও!

নিজেই ওঠার চেষ্টা করতে গিয়ে প্রায় পড়ে যাচ্ছিল ও। ধরে ফেলল পলাশ। ওর ঘাড়ে ভর করে এক পা এগিয়েই বলল — তোমার ঘরেই শুইয়ে দাও আপাতত।

বিছানায় কোনোরকমে শুইয়ে দিতেই ছোট্ট বাচ্ছার মতো ঘুমিয়ে পড়ল ইন্দ্রাণী। ডাবল বেড ঠিকই তবু কেউ আলগোছে শুয়ে থাকলে পাশে আর কতটুকু জায়গা থাকে? দরজা আটকে সেখানেই যাহোক করে জায়গা করে নিল পলাশ।

গভীর ঘুমের মধ্যে দম আটকে আসছিল পলাশের। ইন্দ্রাণী পাশ ফিরে ঘুমের ভিতরেই জাপটে ধরেছে ওকে। ঠোঁট ডুবিয়ে দিয়েছে ওর ঠোঁটে। ইন্দ্রাণীর জিভ খেলা করছে ওর ভিতরে। গরম শ্বাস পড়ছে। পলাশের ঘুমের ঘোর বেশ কেটে গেছে। আর অস্বস্তি বেড়ে গেছে অনেকটা। নেশার ঘোরে ইন্দ্রাণী একটা ভুল করে ফেলছে, আর পলাশ সেই সুযোগ নিচ্ছে চুপচাপ। এক ঝটকায় মুখ সরিয়ে নেয় পলাশ। টিপসি স্বরে ইন্দ্রাণী বলে ওঠে — প্লিজ পলাশ। ফিরিয়ে দিও না। একদিনের জন্য অন্তত আমাকে সুখী হতে দাও।

তাহলে কি নেশা কেটে গেছে ওর — পলাশ মনে মনে ভাবে। ইন্দ্রাণী ততক্ষণে গড়িয়ে নেমে গেছে খাদে। দৃঢ় হয়ে ওঠা পলাশ ওর হাতের নিচে। এ অভিজ্ঞতা একেবারে নতুন তার কাছে। প্রথম নাগরদোলায় চড়া শিশুর মতো পলাশ আঁকড়ে ধরে আছে সঙ্গীকে। ইন্দ্রাণী ততক্ষণে নিজের ভিতরে ধারণ করেছে পলাশকে। প্রতিটি ধাক্কায় গভীর থেকে গভীরে চলে যাচ্ছে ওরা। আদুরে বেড়ালের মতো গরগর করছে ইন্দ্রাণী। পলাশের বুকের উপর উগরে দিচ্ছে দুর্বোধ্য ভিনদেশি শব্দমালা। এদিকে পলাশের হাতে সময় ফুরিয়ে আসছে দ্রুত। আর একটা রাতের রহস্যময় নিস্তব্ধ গাঢ় অন্ধকার ক্রমশ গিলে ফেলছে ওদের দুজনকে।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *