|| শাম্ভবী সংখ্যা ২০২১ || T3 শারদ সংখ্যায় প্রশস্তি পন্ডিত

‘লাভ/লাইক’ বিভ্রাট

কদিন ধরেই রমলাদেবীর মনটা খুব খারাপ। না এমনিতে রমলাদেবী দিব্যি হাসিখুশি। অকারণে মুখ ব্যাজার বা মন খারাপ করার পাত্রী তিনি নন। স্বামী সুশোভনকে নিয়ে উত্তর কলকাতার এক পাড়ায় তার ছোট্ট সংসার। সুশোভন শান্ত নির্বিবাদী মানুষ। সারাজীবন সরকারি চাকরির কলম পিষে এখন রিটার্মেন্ট লাইফ কাটাচ্ছেন। চাহিদা তেমন কিছুই নেই, তবে তিনি খুব একটা মিশুকে নন, বরাবর একলা নির্বিবাদী থাকতেই পছন্দ করেন। তবে রমলা দেবী আবার কারুর সাথে কথা না বলে, না মিশে মোটেই থাকতে পারেননা। তাই মোটামুটি সারা পাড়ার লোকই সুশোভন বাবুকে না চিনলেও রমলা দেবীকে একডাকে চেনে। এই তো সেদিন পিওন বাড়ি না খুঁজে পেয়ে পাড়ার চায়ের দোকানে সুশোভনবাবুর কথা বলতে সবাই মুখ চাওয়া চাওয়ি করছে, তারপর যেই বাড়ির ঠিকানা বলা অমনি বিল্টু হেসে বলে উঠল, ‘ও রমলা কাকিমার বাড়ি? আগে বলবেন তো। ঐ গলিটা দিয়ে আরও এগিয়ে দুটো বাড়ি পরে/ ‘
রমলাদেবীর এহেন জনপ্রিয়তার কথা সুশোভনবাবুর অজানা নয়। প্রায়ই দেখেন কেউ না কেউ বাড়িতে আসছে। এই তো সেদিন পাশের বাড়ির মিঠু এসছিল বাটি ফিরত দিতে,’ উফফ কাকিমা, আমসত্ত্বর আচারটা যা হয়েছিল না, কি বলব, এখনও মুখে লেগে আছে।’ রমলা দেবী অমনি হেসে বলে ওঠে, ‘আর বলিসনা, তোর কাকুকে কবে থেকে বলছি একটু কুল আনতে, কাকু আনলেই কুলের আচার করে দেব।’
এই কুল আনার কথা সুশোভন তখনই প্রথম শুনল! এরপর রমলা এসে বলবে, বাচ্চা মেয়েটা বুঝলে খুব আচার খেতে ভালবাসে, আমি কিন্তু বলে দিয়েছি তুমি কুল আনলেই আচার করে দেব। একটু নিয়ে এস, আমাদের বুড়োবুড়ির আর কি আছে, এই বাচ্চাগুলো একটু খেয়ে আনন্দ পায়, তাতেই আনন্দ।
সুশোভন জানেন নিঃসন্তান রমলা এই পুরো পাড়াটাকেই তার সংসার বানিয়ে ফেলেছে। সবাইকে নিয়ে ছোট ছোট আনন্দে মেতে থাকে। তারাও রমলা কাকিমা বলতে অজ্ঞান। কার স্কুলে সেলাইয়ের আসন জমা দিতে হবে, কাদের বাড়ি হঠাৎ আত্মীয় চলে এসেছে, একটু রান্নাতে হেল্প লাগবে, কার ফাংশানে সাজিয়ে দিতে হবে, সবার মুখে একটাই নাম আসবে, রমলা কাকিমা।
কদিন আগেই রমলার উদ্যোগে ছোটরা সবাই মিলে রবীন্দ্র জয়ন্তীর অনুষ্ঠান করল। প্যান্ডেল সাজানো, রিহার্সাল করা, হহহই করে কাটলো কদিন। রিহার্সাল সব রমলা তার বাড়িতেই করত, তারপর টুকিটাকি খাওয়ানো ভালোই চলছিল। সুশোভনের এত লোকজন খুব একটা ভালো না লাগলেও বোঝেন, নিঃসন্তান রমলাদেবী এদের আকঁড়ে ধরেই ভালো থাকতে চান।
এহেন সদালাপী, সদাহাস্যময়ী, রমলাদেবী আজকাল কদিন ধরেই কেন যে মনমরা সুশোভনবাবু কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছেননা। কদিন বাজার থেকে যেচেই, কুল, আমসত্ত্ব নিয়ে এসে নিজেই বললেন, কুলের আচার কবে মিঠুকে দেবে? এ কথা শুনে হঠাৎ তাকে অবাক করে রমলাদেবী বললেন, ধুর, কিচ্ছু করবনা। আর পেরে উঠিনা এ বয়সে।
সুশোভন রীতমত অবাক। রমলার মত প্রাণচ্ছোল মহিলার মুখে এমন হতাশাজনক বয়সের কথা ভীষণরকম বেমানান! ভাবছিল শরীর খারাপ কিনা, তবে সেরকম কোন লক্ষন দেখা না গেলেও মন যে খারাপ তা বেশ বুঝতে পারছিলেন, কোনদিন সকালের চা হচ্ছে নোনতা, তো ডাল মিষ্টি!
নির্বিবাদী সুশোভনও এবার অতিষ্ঠ হয়ে বলে উঠলেন, আচ্ছা, কি হয়েছে বলতো!? কদিন ধরেই দেখছি মনমরা হয়ে বসে আছ, রান্নাতে নুনের জায়গায় চিনি, চিনির জায়গায় নুন দিচ্ছ, বাচ্চাগুলোকেও খুব একটা ডাকছনা বাড়িতে, কি ব্যাপার বল দেখি?
রমলাদেবী আর থাকতে না পেরে অভিমান ভরা গলায় বলে উঠলেন, ডাকলেই যেন আসছে! কদিন ধরে তো মিঠু ঠিক করে কথাই বলছেনা। কাল টিউশান থেকে ফিরছিল, বারান্দা থেকে ডেকে বললাম পিঁয়াজি ভাজছি খেয়ে যা। ওমা, কেমন অচেনার মত করে বলল, আমার এখন খিদে নেই, বলেই গট গট করে হেঁটে বেড়িয়ে গেল। এদিকে দেখলাম বন্ধুদের সাথে পাড়ার মোড়ে ফুচকা খাওয়ার ছবি দিয়েছে!
সুশোভন জানতে চাইলেন, ছবি দিয়েছে মানে? তোমায় এসে ছবি দিয়ে গেছে?
রমলাদেবী বললেন, আরে আমাকে দেবে কেন? ফেসবুকে দিয়েছে/
ফেসবুকটা ঠিক কি বস্তু সুশোভন ভাল জানেননা! তবে আজকাল অনেকের মুখেই এর নাম শুনেছেন। নিজে স্মার্ট ফোন ব্যবহার না করলেও আগের মাসে রমলা অনেক শখ করে নিজেই টাকা জমিয়ে কমদামি একটা স্মার্ট ফোন কিনে এনেছিলেন। তারপর সেই স্মার্টফোন শেখা নিয়ে বাড়িতে কদিন মিঠু, বিল্টুদের সাথে বিশাল হইহই হল।
তা এই বিল্টুই প্রথম রমলা কাকিমাকে ফেসবুকে আক্যাউন্ট খুলে দেয়। পাড়ার সবাইকে নাকি এখানে ‘ফ্রেন্ড’ করা যাবে। তাঁর স্কুলের পুরোনো বন্ধুদের যাদের ফোন নাম্বার নেই, তাদেরও নাকি পাওয়া যেতে পারে আর সত্যিই স্কুল ও কলেজের কিছু বন্ধুর নাম বিল্টু খুঁজে বার করেছিল। সামনিসামনি দেখা নেই বহুবছর, তবে ফেসবুকের দৌলতে যে আবার পুরোন বন্ধুদের খুঁজে পাবেন তা ভাবতেই পারেননি রমলাদেবী। কদিন বেশ আনন্দেই কাটল।
তারপর একদিন তার বন্ধু মৃদুলা দার্জিলিং এ বেড়ানোর কিছু যাবার ছবি ফেসবুকে দিয়েছিল, তাই দেখে রমলা দেবী ফোন করে বান্ধবীকে বললেন, কি সুন্দর ছবিগুল মৃদুলা, আর তুই এখনও কি সুন্দর দেখতে আছিস! চল একদিন আমরা দুই বন্ধু কোথাও দেখা করি, কতদিন দেখা নেই, কত গল্প জমে আছে।
ওপার থেকে মৃদুলা বলে উঠল, হ্যাঁ চল, কফি হাউস যাই, তারপর সেলফি তুলে ফেসবুকে দেব! আর হ্যাঁ আমার দার্জিলিং এর ছবিগুলো ভাললাগলে লাইক করে দিস প্লিস। এখন রাখছি রে, আমার ছবিতে অলরেডি চোদ্দখানা কমেন্ট হয়ে গেছি, বুঝলি, রিপ্লাই করে দিই, তোর সাথে পরে কথা বলব। বলেই, মৃদুলা ফোন কেটে দেয়। রমলাদেবী এই কনভারসেশানের হাফ কথা বোঝেননি। যেমন কফিহাউস গিয়ে সেলফি তোলাটা কি জিনিস! আর ছবিতে লাইক আবার আলাদা করে কিকরে বোঝান হয়!
অগত্যা আবার বিল্টুর শরণাপন্ন হন রমলাদেবী। বিল্টু সব শুনে প্রথমে হেসে গড়াগড়ি খেল খানিক। তারপর বলল তুমি সেলফি জাননা! এই তো কদিন আগে রবীন্দ্রজয়ন্তীতে আমরা মিঠুদির ফোনে সেলফি তুললাম, তুমিও তো ওই ছবিতে আছ!
এতক্ষণে রমলাদেবী বুঝলেন যে সেবারে মিঠু অনুষ্ঠান শেষে সবাইকে সামনের ফোনের দিকে মুখ বাড়িয়ে নিয়ে যে ছবিটা তুলেছিল সেটা সেলফি। যদিও তিনি ক্যামেরা কোথায় প্রথমে বুঝতেই পারছিলেননা। তারপর বুঝলেন, এই ছবিতে আয়নার মত নিজেকেই দেখে ছবি তোলা যায়। যদিও মৃদুলা দেখা করে কলেজের গল্প ছেড়ে কেন যে হঠাৎ সেলফি তুলবে বলে এত খুশি হল, সেটা রমলাদেবীর মাথায় ঢোকেনি।
তার চিন্তার মাঝেই হঠাৎ বিল্টু বলে উঠল, কাকিমা স্মার্ট ফোন কিনলে শুধু হবেনা, তোমাকেও স্মার্ট হতে হবে। রমলাদেবী কখনও চাকরি না করলেও সংসারের টুকিটাকি বাজার দোকান, নিজের পছন্দের কেনাকাটা নিজেই করে ফেলতে পারেন, তাই সে অর্থে তাকে আনস্মার্ট খুব একটা বলা চলে না। তবে তিনি তাও বিল্টুর থেকে জানতে চাইলেন, সেটা আবার কিরকম করে হব?
বিল্টু শুরু করল এই ফোনের ফিচার্স গুলো ভালো করে জেনে নাও। আর হ্যাঁ, ফেসবুকে লাইক, কমেন্ট করে ইন্টার‍্যাক্ট কর, দেখবে খুব স্মার্ট হয়ে যাবে! যেমন তোমার বন্ধু হয়ে গেছে।
রমলাদেবী বুঝলেন, তিনি বড়ই আনস্মার্ট! তাড়াতাড়ি বিল্টুর থেকে, ফেসবুকের ব্লু বাটন ক্লিক করে কিভাবে লাইক করতে হয়, শিখে নিয়ে মৃদুলার সবকটা ছবিতে লাইক করে দিলেন। মৃদুলা আবার কিচ্ছুক্ষনের মধ্যেই মেসেঞ্জারে জানাল, আমাদের কফিহাউসের প্ল্যানটা করিস, ফেসবুকে দেব!

তা কদিনধরে এইভাবেই রমলাদেবী ধীরে ধীরে ‘স্মার্ট’ হয়ে উঠছিলেন। এখন তিনি লাইকের সাথে সাথে কমেন্টও করতে পারেন। তবে কিছুদিন হল আবার একটু মুশকিলে পড়েছেন। আগে বিল্টুর দেখানো ব্লু বাটন চাপলেই লাইক হয়ে যেত, এখন কদিন ধরে ব্লু বাটন চাপার সাথে সাথে হাজার রকমের নীল, লাল, হলুদ, কমলা, কিসব উঠে আসছে, উনি কিছু বুঝতে পারছেননা, যেভাবে হোক কিছু একটা চিপে দিয়ে সবাইকে ‘লাইক’ দিচ্ছেন। বিল্টুকে ডাকা হয়নি, কদিন আগে দোকান থেকে ফেরার সময় মাঠের পাশে বিল্টুকে সিগারেট খেতে দেখে খুব একচোট বকুনি দিয়েছিলেন। মনে মনে ভেবে রেখেছেন ছেলেটাকে একদিন ডেকে ওর পছন্দের চাউমিন খাওয়াবেন সাথে এই নতুন ব্যাপারটা কি শিখে নেবেন। কিন্তু কদিন ধরে তার সবথেকে আদরের মিঠু এমন অচেনার মত ব্যবহার করছে কেন এটা ভেবেই উনি ভীষণ মনমরা হয়ে পড়েছিলেন। যদিও সুশোভন বলেন পরের ছেলেমেয়েকে নিয়ে এত জড়িও না, এখনকার ছেলেমেয়েরা নিজের বাবামাকেই ভুলে যায় আর তুমি তাদের নিয়ে পড়ে আছ। সুশোভনের কথা কোনদিন গায়ে মাখেননি রমলা। ছোটদের সাথে নিয়ে আনন্দ করতে চিরকালই ভালবাসেন, আর তিনি জানেন তারাও ওঁকে ভালবাসে। কিন্তু কেন জানিনা আজ তারও মনে হচ্ছে সুশোভনই হয়ত তাহলে ঠিক।
যাইহোক, রমলাদেবী ভাবলেন বিল্টুটাও রেগে আছে ওকে ডাকি আজ সন্ধ্যে চাউমিন বানাব, নিজে গিয়ে ডেকে আনব, না করবেনা নিশ্চয়ই। তা বিল্টু একটুও রেগেছিল না, দিব্যি খুশিমনে সন্ধ্যেবেলা এসেছিল। রমলাদেবী চাউমিন নিয়ে এসে বিল্টুকে বললেন, হ্যাঁরে বিল্টু, মিঠুদিদির সাথে তোর দেখা হয়? ওর শরীর ঠিক আছে তো? আমার বাড়িতে অনেকদিন আসেনি, তাই ভাবছিলাম।
বিল্টু কাঁটাচামচে একদলা চাউমিন গেঁথে মুখে পুরে বলল, হ্যাঁ মিঠুদিদি ভালোই আছে, তবে তোমার ওপর খুব রেগে গেছে।
এটাই রমলাদেবী আশঙ্কা করছিলেন। কিন্তু কেন মিঠু রেগে গেছে তাই উনি কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছিলেননা/ বিল্টু যদি বা বকুনি খাবার জন্য রাগত তাও বুঝতেন, কিন্তু মিঠুকে তিনি কোনদিন বকেছেন বলেও মনে পড়ছেনা।
তিনি বিল্টুর থেকে জানতে চাইলেন, আচ্ছা মিঠু কেন আমার ওপর রেগে গেছে, তোকে কিছু বলেছে?
বিল্টু মুখ ভর্তি চাউমিন নিয়ে অম্লানবদনে বলল, আরে, এতে বলার কি আছে, আমিও তো দেখলাম, তুমি মিঠুদির দুখানা ছবিতে পরপর দুবার তুমি ‘অ্যাঁংগরি রিয়্যাক্ট’ করেছ, ওর জায়গায় আমি থাকলে আমিও রেগে যেতাম। আচ্ছা কেন হঠাৎ ‘অ্যাঁংগরি রিয়্যাক্ট’ করতে গেলে বলত!?
রমলাদেবীর মাথা কিছুই ঢুকছেনা! ‘অ্যাঁংগরি রিয়্যাক্ট’ টা কি ভীষণ সাংঘাতিক জিনিস যার জন্য মিঠু তার এতদিনের প্রিয় কাকিমার ওপর এমন রেগে গেল!
বিল্টুর কাছে জানতে চাইলে বিল্টু তাকে এবার বোঝাল ফেসবুকে ‘লাইক’ করতে গিয়ে এইযে কদিন বিভিন্ন রঙের কিসব আসছিল, সেগুলো এক একটা ইমশোনের সিম্বল। যেগুলো তিনি এতদিন না দেখেই টপাটপ টিপে যাচ্ছিলেন!
রমলাদেবী এখনও মানতে পারছেননা যে এই কারণে, তার এত আদরের মিঠু তার ওপর রেগে অচেনার মত ব্যবহার করছে! যেটা তিনি তার সম্পূর্ণ অজ্ঞতা থেকে করেছেন। কোথায় তিনি ভাবছিলেন বিল্টু বকুনি খেয়ে তার ওপর অভিমান করে থাকবে, সেখানে মিঠু এই সামান্য কারণে তার ওপর রেগে গেছে! সেকথা বিল্টুকে বলতেই বিল্টু বলে উঠল, না না আমি কেন রাগব, তুমি তো আমার ছবিতে ‘লাভ’ দিয়েছ।
রমলাদেবী এত অবাক হয়েগেছেন যে তার মুখটা হাঁ হয়ে গেছে!
মনের ইমশোনগুলোকে তিনি এখনও সোশ্যাল মিডিয়ার ‘রিয়্যাক্টের’ সাথে এক করে ফেলতে পারেননি, নাঃ তিনি এখনও ‘আনস্মার্ট’ই রয়ে গেলেন!

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।