গুচ্ছকবিতায় প্রভাত মণ্ডল

১। ক্ষমা কর দ্বিরদ

নিভে গেছে মানুষের চেতনার দীপ, পৃথিবীর বুক জুড়ে
বোবা কান্না, মহামারী তাণ্ডব তুফানের সমাবেশ তবুও
কাঁপেনি হাত দ্বিরদের প্রাণ নিতে।
ভাবি! মৃত পৃথিবীর মাঝে খুঁজে নেব একফালি চাঁদ, পুঁতে
দেব গাছেদের সারি, নীড় হারা পাখিরাও বুকে পাবে
আশা, সুমধুর কলতানে সাজাবে পৃথিবী নবরূপে।
মরুময় প্রান্তরে সাজাবো সবুজের বন, নিঃসীম স্বর্গ এনে
দেব পৃথিবীর বুকে, যদি তুমি হাতে রাখ হাত, মানবতা
সাথে নিয়ে পশুপ্রাণে খুঁজে নাও প্রাণ।
নিসর্গ মায়াজাল এঁকে দেবে দুটি চোখে স্বপ্ন, শাশ্বত প্রেমই
শুধু বাঁচাতে পারে এ বসুধা, ক্ষমা করো দ্বিরদ, মানবতা
ফিরে পাক এ নিঠুর সমাজ।

২। ব‍্যথার আলো

তোমার দরজায় নতুন আলো এল,মহামারী শেষে এমনই তপ্ত ক্লান্ত ভোর,ঝিরিঝিরি পাতার শব্দে অনাবিল হাসি,
আকাঁড়া চাল গৃহবধূর চোখে নেশা ধরায়।
বহুদিন পর স্বপ্নে দেখা সকাল,হাঁড়িতে ফুটন্ত ভাতের গন্ধ
সারা বাড়িটা জুড়ে,খোকার গলার শব্দ এ বাড়িতে নেই,
ও তো পরিযায়ী আজ দূরদেশে।
এখন সে দেশে তারাদের মেলা,ভিজে তুলোর মত মেঘেদের সারি,ওখানেও বাতাস বয় চাঁদটাও রোজ ওঠে,
শুধু জোনাকিরা আলো দেয় না।
শত আলোকবর্ষের ব‍্যবধান,শোনা যায় না ওর গলার আওয়াজ,ফুটন্ত ভাতের হাঁড়িটায় নোনা জল পড়ে,
মায়ের চোখে ব‍্যথার আলো আসে।

৩। ব‍্যথা নেই তাতে

হয়তো আবার সামলে নেবো ঠিক, শত ছিন্ন পাতারাও মাথা
তুলতে শুরু করবে, মাজা ভাঙা গাছে নতুন ডাল গজাবে,
ততক্ষণে ঝরে পড়বে হলুদ পাতারা।
হয়তো আবার স্বপ্ন দেখব ঠিক, প্লাজমায় গড়ে উঠবে
মহামারীর প্রতিরোধ ক্ষমতা, আক্রান্ত হয়েও বেঁচে যাবে যারা,
ততক্ষণে ঘটে যাবে মৃত্যুর মিছিল।
হয়তো! হয়তো আবারও সেই শত চেনা মুখ, পুড়ে যাবে
চিতার আগুনে, কিংবা কবরের সারি গুনে গুনে ক্লান্ত হব রোজ,
হয়তো আমিও যাব ঝরে।
ব‍্যথা নেই তাতে, যদি ঝরে যায়, শুধু একটা পৃথিবী চাই
যেখানে অহং নেই, নেই কোনো ধর্ম ও রাজা, মানবতা সাথে নিয়ে,
সেখানে থাকবে শুধু প্রজা।

৪। স্বপ্ন জাল

বৃষ্টি ভেজা রাত নিঝুম পৃথিবী, তবুও স্বপ্নেরা উত্তাল
সমুদ্রের মতো ছুটে চলে, দিক হতে দিগন্তে ডানা মেলে,
মাথা ঠুকে মরে বাস্তবের তটভূমিতে।
মহামারী সাথে আমফান হানা, উড়তে চলেছে স্বপ্নদের
ঘরের চাল, স্মিতমুখে হাসছে নরখাদক কখনোবা অট্টরোলে,
ক্ষুধার্তের ত্রাণ চুরি করে গড়বে রাজপ্রাসাদ।
নির্নিমেষ কতগুলো চোখ, বিভোর স্বপ্ন জাল বুকে নিয়ে
চেয়ে থাকে শূণ‍্যের দিকে, পরিত্রাণ পেতে চায় ওরা, রাজনীতির
করাল গ্ৰাসে আবদ্ধমান এ সমাজ থেকে।
কখনোকি আসবে সুদিন! মরুবুকে ফুটবে কি ফুল ?
মানবতা সাথে নিয়ে পৃথিবীর প্রতিকোনে স্বপ্নরা গড়বে প্রাসাদ,
ভেঙে যাবে সব অবসাদ।

৫। ঈশ্বর

এখনো নষ্ট চাঁদ আলো দেয়, ঊষার আলো ফুটতে না
ফুটতেই কাকেরা ডেকে ওঠে, ল‍্যাংটা ছোঁড়াটা পথে হাঁটে
না, শুধু চেয়ে থাকে করুণ নয়নে পথের দিকে।
সারারাত জেগে জেগে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল পূর্ণিমার
চাঁদের দিকে, ও ঈশ্বর খুঁজেছিল, ও বহুদিন দেখেনি ঈশ্বর,
মাখেনি দুহাতে ভাতের গন্ধ।
আজ উজানের স্রোত, ওর উদর জুড়ে বয়ে চলে আগুন,
বনগাঁ লোকালের অসহ্য ভিড় আর সয়তে হয় না, তাইতো
কোনও ঈশ্বর আসে না উদরাগ্নি নেভাতে।
ও দেখেনি বাইবেল, খোঁজেনি কোরান কিংবা ভাগবত,
বোঝেনি কখনো কোনও ধর্ম, বুঝতেও চায়নি, ও ঈশ্বর
দেখেছে এই মাটির স্বর্গ জুড়ে।
ওর শীর্ণ দেহ জুড়ে মাছি ভনভন করে, দৃষ্টি শক্তিও ক্রমশ
ক্ষীণ হয়ে আসে, তবুও রোজ কান পেতে থাকে, লোকাল
ট্রেনের সাই-রেন শুনবে বলে, যদি ঈশ্বর দেখা পায়।

৬। মাটি

এ মাটি ধুলোর পরে দেখেছি স্বর্গ সুখ
বিরহের কেনাবেচা ভালোবাসা সাথে,
বেদনার মিছিলেতে হাসিরাও পা মেলায়
অভিমান সাথে নিয়ে প্রিয়জন বাঁচে।
একদিন হবে জানি আবার নতুন ভোর
পাখিদের কলতানে ভেঙে যাবে ঘুম,
ফুটবে শিউলি গাঁদা চিরচেনা আঙিনায়
ব‍্যথাতুর নিশীথের হবে অবসান।
বাইবে জীবন খেয়া জীবন নাউয়ের মাঝি
মহামারী হবে শেষ দৃঢ় প্রত‍্যয়,
পৃথিবীর রূপ রস মেখে নিয়ে হাতে মুখে
হারিয়ে ফিরতে চাই পৃথিবীরই বুকে।

 

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।