সাপ্তাহিক ধারাবাহিক কথা সাগরে প্রদীপ গুপ্ত

বাউল রাজা

দ্বিতীয় খন্ড (ষট্ চত্বারিংশ পর্ব)

এখন আর নূপুরের শব্দ শোনা যাচ্ছে না। কিন্তু সে তীব্র হাওয়া যেন আমাকে ধাক্কা দিতে দিতে তাড়িয়ে নিয়ে চললো। ” তুমি একন এসো, সে পোড়াকপালি তোমার পত চেয়ে ঠাঁয় দাঁইড়ে আচে গো ” কথাটা যেন কানের কাছে চক্রাকারে ঘুরে যাচ্ছে। একটা ভাবনাই আমাকে অপরাধী করে তুলেছে। আমি যদি তার টানেই এসে থাকি তাহলে সারাটাদিন আমি তাকে ভুলে থাকলাম কীভাবে? তাহলে, আমার অহং কি আমাকে দূরে ঠেলে রেখেছে বাউলনির অমোঘ আকর্ষণের থেকে? রবিঠাকুরের কথা মনে পড়ছে, উপনিষদে বলেছে ” আত্মা আর অহংএর ভেতর এক চরম বৈপরীত্য আছে। আত্মা দানশীল, ব্যাপক, অহং সংগ্রহণবাদী, ক্ষুদ্র। অহং প্রাত্যহিক প্রয়োজনীয়তা ও ভেদবুদ্ধির দ্বারা আবৃত, ক্লিন্ন ও মলিন। ভেদাত্মক আত্মকেন্দ্রিকতা থেকেই পাপের জন্ম, সত্যের মুখোমুখি দাঁড়াতে বাধাদানকারী শক্তিই অহং।”
আকাশে কার্তিকী শুক্লা নবমীর চাঁদ। জগৎ-সংসারের মোহ থেকে বেরিয়ে আসার মায়াভরা জোৎস্না উজাড় করে দিয়েছে। হাল্কা পেঁজা তুলোর মতো মেঘগুলো যেন উদাসীন হয়ে ভেসে চলেছে অজানায়। মা জগদ্ধাত্রী সত্ত্বগুণনিধি। এ সময়ে নাকি মন ঊর্ধ্বগামী হয়। জাগতিক সুখ, স্বাচ্ছন্দ্য, কাম, লোভ, মোহ, মাৎসর্য, দুঃখের অনুভূতির ঊর্ধে উঠে মন দেবাভিমুখী হয়ে ওঠে। কিন্তু তাহলে সন্ধ্যাবেলা আমার শরীরে কামভাবের আশ্রয় হয়েছিলো কেন? নদীর কথানুযায়ী সে ভাব নাকি আমার ছিলো না, আমার শরীরকে সে ভাব আশ্রয় করেছিলো। সে কে? সে কি বাউলনি? এটা হতে পারে ভেবেই কি আমার অহং আমাকে দূরে সরিয়ে নিয়ে গেছিলো কৃষ্ণভামার সান্নিধ্য থেকে? কিন্তু অহং তো তমোভাবাশ্রয়ী। তাহলে সে কেন রজোগুণ থেকে আমাকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যাবে? সে তো বরং…।
আমার সবকিছু কেমন যেন গুলিয়ে যাচ্ছে। একদিকে এই চন্দ্রিমার আলোয় আর আনমনা মেঘের চলাফেরায় মনে সত্ত্বগুণের জন্ম নিচ্ছে, ওদিকে তামসিক প্রবৃত্তির বশে কামভাব এসে আশ্রয় নিচ্ছে শরীরে, অথচ রজোগুণ আমায় তারিত করছে তমোগুণের থেকে, এক জটিল গোলকধাঁধা যেন আমায় ঘিরে ধরছে। এটাই কি মানবধর্ম ? এই তিনগুণের আধারে আধারিত শরীরই কি মানবশরীর ?
নদী যেখানে বাঁক নিয়ে কানাইদার আখড়ার দিকে এগিয়ে গেছে, সেই বাঁকের মুখে যে কদমগাছটা শেষ দু’চারটা ফুলের তীব্র সুগন্ধ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, সে গাছের পাতার ফাঁক গলে যেন গানটা ভেসে এলো…
” বিশ্বসাথে যোগে যেথায় বিহারো
সেইখানে যোগ তোমার সাথে আমারও
নয়কো বনে, নয় বিজনে, নয়কো আমার আপনমনে
সবার যেথায় আপন তুমি হে প্রিয়
সেথায় আপন আমারও।
গোপনে প্রেম রয় না ঘরে, আলোর মতো ছড়িয়ে পড়ে
সবার তুমি আনন্দধন, হে প্রিয়
আনন্দ সেই আমারও “
উঠোন আলো করে কানাইদা বসে আছেন। উঠোনে পাতা চাটাইয়ের এক প্রান্তে বসে আছেন সেই দীর্ঘদেহী শুভ্রবর্ণ, হিমালয়ের গুহাবাসী তপস্বী। আর অন্য প্রান্তে ধ্রুবদা। তুলসীতলার পিদিম তখনও জ্বলে আছে। দাওয়ার এককোণে ছুটকি উদোম গায়ে বসে আছে, আর…
ও কে? এ কী চেহারা হয়েছে বাউলনির! একদিনে যেন চোখমুখ বসে গেছে, আলুলায়িত অবিন্যস্ত চুলে হাত পড়েনি, শাড়ির আঁচল খসে মাটিতে লুটোচ্ছে, বিষাদপ্রতিমার মতো দাওয়ার এককোণে একটা বাঁশের খুঁটি ধরে দাঁড়িয়ে আছে।
— ” তাকে উপলব্ধি করাই আসল ধর্ম গো বাউল। সে তুমি আপনি নিজে যেখানেই থাকো না কেন? গৃহে, অরণ্যে, গিরিশিখরে, তাঁর মতো আপনার জনকে খুঁজে ফেরাই তো ধর্মের মূল। ”
— “এইডা এক্কেবারে মনের মতোন কথা কইসেন সাধুবাবা। হ্যারে খুঁইজ্যা বাইর করতে হইবো না, হ্যায় আপনেই আইস্যা ধরা দেওয়ার লিগ্যা পাগল হইয়া রইসে। ”
–” দেখুন ধ্রুববাবু, আসল বিষয় হলো আত্মা আর পরমব্রহ্মর ভেতর প্রেম। দু’জনেই দু’জনকে খুঁজে ফিরছেন। যতক্ষণ পর্যন্ত না একে অন্যের খবর পাচ্ছেন ততক্ষণই আত্মা বিভিন্ন গুণের কারক হন। তমচারী, রজোচারীতে, আর রজোচারী সত্ত্বচারীর আকর্ষণে ভ্রমণ করতে থাকেন। ”
কানাইদার মুখ আকাশের দিকে তোলা। শুক্লা নবমীর চাঁদ যেন আজ শুধুমাত্র কানাই বাউলের মুখকে আলোর বানে ভাসিয়ে দেওয়ার জন্যই উঠেছে।
আমার যে তখন কী অবস্থা, সেটা একমাত্র আমিই জানি। এতক্ষণ ধরে যে কথাগুলো আমাকে নিয়ে খেলে বেড়িয়েছে, এখানেও সেই একই শব্দের পুনরাবৃত্তি। এরা সবাই মিলে কি আমায় নিয়ে কোনো গভীর ষড়যন্ত্রে মেতেছে? কেন যে এবার আসতে গেলাম এখানে!
–” ছান্দোগ্য উপনিষদে আত্মা আর ব্রহ্ম সম্পর্কে খুব সুন্দর ব্যাখ্যা আছে, বুঝলে ধ্রুববাবু, আত্মাও এক আর অখন্ড, ব্রহ্মও তাই। একক আত্মা,একক ব্রহ্মের রূপকে উপলব্ধি করার জন্যই জন্মগ্রহণ করে। ”
–” আপনেগো কথা বুঝতে হইলে তো আমারও হেইরকম জ্ঞানী হইতে হইবো। ”
–” এরচেয়ে সোজা কতা আর কী হতে পারে কও দেকি ধুবদাদা, রবিঠাকুরের গান শুনলেই তো সব উপনিষদ এসে তোমার মনে জলের মতো সেইদে যাপে গো। ”
আমি আর কতক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে থাকবো? চাটাইয়ের এক কোণে গিয়ে বসলাম। কানাইদার মতো একজন মানুষের সান্নিধ্যে থেকে কৃষ্ণভামাও নিশ্চয়ই নিজের ভেতর পরম ব্রহ্মকে খুঁজে পেয়েছে। রবীন্দ্রনাথকে যে লোকটা এতোটা অসাধারণভাবে উপলব্ধি করেছেন, তার কথা না শুনলে পাপ হবে।
–” যিনি সর্বকর্মা, সর্বকাম, সর্বগন্ধ, সর্বরস… যিনি এ সবকিছু জুড়ে আছেন, যিনি বাকরহিত – উদাসীন — তিনিই আমার আত্মা, তিনিই আমার হৃদয়ের ভেতরে বাসকারী — অনন্ত পরমব্রহ্ম। সারা সৃষ্টি এক ও অভিন্ন, অখন্ড। এই এককে উপলব্ধি করার জন্যই আত্মার সৃষ্টি। মানবজন্মের লক্ষ্য। এই এককে জানলেই সবকিছু জানা হয়ে যায়, এই জানার ভেতরেই রয়েছে অমরার দ্বারের খোঁজ। ”
মনে পড়ে যাচ্ছে সেই গান —
” জগৎ জুড়ে উদার সুরে
আনন্দগান বাজে
সে গান কবে গভীর রবে
বাজবে হিয়ামাঝে “
ভাবতে ভাবতেই কানাই বাউল সুর তুলেছে —
–” সুরের আলো ভুবন ফেলে ছেয়ে
সুরের হাওয়া চলে গগন বেয়ে
পাষাণ টুটে ব্যাকুল বেগে ধেয়ে
বহিয়া যায় সুরের সুরধুনী
তুমি কেমন করে গান করো হে গুণী… “

চলবে

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।