সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে প্রদীপ গুপ্ত (পর্ব – ২)

বাউল রাজা

তৃতীয় খণ্ড (দ্বিতীয় পর্ব)

এতোদিন ধরে প্রত্যেকদিন ট্রাকের পর ট্রাক পাথরকুঁচি বোঝাই করে এসে, মুনসুবা মোড়ের লাল্টুর ধাবায় গামছাটাকে কোমড়ে জড়িয়ে নিয়ে লোটার পর লোটা জল ঢেলে যেতে কোনোরকম সংকোচ বোধ করিনি। কমদামী লাক্স সাবানের ফেনায় ভুরভুর করে উঠেছে সারা শরীর, মাথার চুল থেকে শুরু করে আগাপাছতলা। কিন্তু কোনোদিনও এতোটুকুও লাজ এসে লজ্জাবোধে ছেয়ে ফেলেনি।
আজ বাউলনির অপাপবিদ্ধ চোখের চাউনির সামনে কেন জানি না খুব সংকোচ বোধ হচ্ছে। অথচ এখানে অন্ততপক্ষে দুতিন জন মহিলা আছেন, যারা বাসন মাজেন, কয়লা ভাঙেন। একজন সদ্য যুবতীও এখানে প্রায় দিনই লটারির টিকিট বিক্রি করতে আসেন। এছাড়াও যেহেতু এই ধাবাটা স্টেট হাইওয়ের ওপর, সে কারণেই অনেক পথচলতি গাড়িও এখানে চা খেতে আসেন। সেসব গাড়িতে শহুরে মহিলাদের আনাগোনাতেও কোনোদিন তো আমার কোনোরকম সংকোচ বোধ হয়নি। তাহলে আজই কেন?
মাথার থেকে সাবানের ফেনা ধুয়ে ফেলতে লোটাভরা জল মাথায় ঢালতেই সমস্ত ফেনারা চোখে এসে আশ্রয় নিলো।
দুচোখ জ্বালা করছে। হে ভগবান, কি করি এখন? কোমড়ের গামছাটাও বোধহয় বেইমানি করবে বলে ভাবছে। হাত থেকে এলুমিনিয়ামের ঘটিটাকে নীচে ফেলে চৌবাচ্চা থেকে একহাতে জল নিয়ে চোখে ছেটাতে ছেটাতেই অন্য হাত দিয়ে গামছাটাকে আঁকড়ে ধরলাম। সারাগায়ে সাবানের ফেনাগুলো শুকিয়ে চিড়বিড় চিড়বিড় করছে। এমন সময় যেন স্বয়ং ভগবান এসে একটা বালতি করে গায়ের ভেতর জল ঢেলে দিলেন। তাকিয়ে দেখি অরুণ খিলখিল করে হেসে লুটোপুটি খাচ্ছে।
আজ যে লড়িটাতে মাল বোঝাই করেছি তার খালাসি অরুন। খুব বুদ্ধিমান আর চৌকস ছেলে। বেশকিছুটা পড়াশোনাও করেছে।
— কী হইঞ্চে কি গ তুমার পদীপদাদা?
— কোথায়? কিছু হয়নি তো, চোখের ভেতর সাবানজল ঢুকে গেছিলো।
— অ, সেইটো বলো কেনে। আমি ত ভাইবলাম বুঝি উ বাউলানিটোকে দেইখে তুমার —
মিচকি হাসির দোলায় দুলতে দুলতে একটা খাটিয়ায় গিয়ে গা এলিয়ে দিলো অরুণ।

— তুমি কি আজই ফিরে যাবে নাকি গো ঠাকুর?
স্নান সেরে পাজামা আর গেঞ্জীটাকে গায়ে গলিয়ে কৃষ্ণভামার পাশে এসে বসেছি।
— কেন?
— কতোদিন পর তোমায় দেকলাম বলো দেকি?
— হুম
— এতোদিন ভুলে রইলে কীভাবে? পুরুষমানুষদের কি সত্যিই কোনো মন নাই নাকি গো ঠাকুর?
— মনের খবর রাখার দায় তো মনের গো বাউলদিদি। মনই কি আর মনের নাগাল পায় গো?
— তাই বলে —
— তুমি কী বলো? আজ থাকবো?

কৃষ্ণভামার দু’চোখে যে কি অদ্ভুত সুন্দর একটা আর্তি প্রকাশ পেলো সে প্রকাশ করার সাধ্য আমার নেই। জীবন হঠাৎ করে এতোটা রুক্ষ্ম হয়ে উঠেছে যে এই ছ বছর ধরে একটা গল্প উপন্যাস তো দূরের কথা, একটা কবিতার বইও এহাতে তুলতে পারিনি।
— কানাইদার খবর কী বাউলদিদি? শরীর ঠিক আছে তো বাউলদাদার?
— আচ্ছা ঠাকুর, একটা সত্যি কতা কইবে?
কৃষ্ণভামার এই ধরণটা আমার খুব চেনা। এখনই সে এমন কিছু বলবে যে আমি আটকে যাবো। চোখের ইশারায় বললাম, কি কথা শুনতে চাও বলো…
— আমারে না হয় ভুলে গেলে, কিন্তু তুমি ওই মানুষটাকে কি করে ভুলে থাকতে পারলে কও দেকি! অতচ মানুষটা যে কীভাবে তোমার কতা জনে জনে শুধোয় সে তুমি জানোনা গো ঠাকুর। মনে হয় যেন গোঁসাই না গো, ওটা একটা চাতক পাকি, তোমার অদশ্যনে সে পাকির গলা শুইকে কাঠ হয়ে আচে।

আমার মনে সত্যিই অনুশোচনা ঘর বাঁধে। সত্যিই তো আমি… , নাহ, এটা সত্যিই আমার উচিত হয় নি। এমন তো না, যে আমি এখানে, এই ধাবায় কখনও রাত কাটাইনি, রাতের পর রাত কাটিয়েছি। কিন্তু শুধু কানাইদাই বা কেন? আশ্রমের গুরুপদবাবার কাছেও তো আমি একদিনও যাইনি। বাউলনি যেন হঠাৎ করে এসে এক ঝটকায় আমার মনের ওপর ঢাকা দেওয়া পর্দাটাকে একটানে খুলে ফেললো।
— সত্যি করে বলতে কি, কখনোই যে ভাবি নি সেটা নয়, কিন্তু প্রত্যেক কাজেরই কিছু বাধ্যবাধকতা থাকে গো বাউলদিদি, যে বাধ্যবাধকতা তাকে অনেক দায়দায়িত্ব থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যায়। আমি আমার অন্যায়টা…

হঠাৎ স্থানকালপাত্র ভুলে গিয়ে কৃষ্ণভামার ডানহাতের দুটো আঙুল এসে আমার ঠোঁটের ওপর চেপে বসলো।

— ঠাকুর, আমায় ক্ষমা করে দাও। বিশ্বাস করো আমি তোমায় এতোটুকুও দুঃখ দিতে চাইনি গো।

ক্রমশ

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।