সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে প্রদীপ গুপ্ত (পর্ব – ২৯)

পদচিহ্ন

” ময়নার কথা ”

প্রত্যকের জীবনেই এমন কিছু অন্ধকারময় দিন আসে যে অন্ধকারের বুকে লুকোনো থাকে উজ্জ্বল আলোর আধার। আমার জীবনেও এরকম কিছু অন্ধকারময় দিন এসেছিলো, যে দিনগুলো আমায় উপহার দিয়েছে আমার বর্তমানের আলোয় উজ্জ্বল দিনগুলো। সেই গল্পই আজ আমি আপনাদের শোনাতে এসেছি।
জন্মলগ্নে আমি এমন একটা পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলাম আক্ষরিক অর্থেই যে পরিবারে নুন আনতে পান্তা ফুরোনোর অবস্থা ছিলো। অথচ সেই পরিবারের কর্তার ছিলো দুচোখ ভরা স্বপ্ন, সে স্বপ্ন আর্ত, দরিদ্র, পীড়িত, নিরন্ন মানুষের পাশে দাঁড়ানোর আকাঙ্ক্ষায় পূর্ণ। বিষয়টা অদ্ভুত। এভাবে বললে যে কেউ এ কথা নিয়ে আড়ালে আবডালে হাসাহাসি করবেন। কিন্তু আমরা যারা সেই পরিবারে মানুষ হয়েছি তারা এর মর্মার্থ বুঝতে পারি। তিনবোন ও মাকে নিয়ে ছিলো বাবার সংসার। বাবা যে খুব একটা উচ্চশিক্ষিত ছিলেন, সেরকমটা না, তিনিও জন্মেছিলেন মোটামুটি একটি হা – দরিদ্র পরিবারে।
এই পরিবারের মানুষ হয়েও কিন্তু আমার বাবা বলরাম করণের বিষয়সম্পত্তি বিষয়ে কোনদিনই কোনোরকম আগ্রহ ছিলো না, তার যাবতীয় আগ্রহ ছিলো মানবহিতৈসি কাজকর্মের দিকে। কী খাওয়াবেন সেই সংস্থান নেই অথচ তার মনে রোখ চেপেছিলো গরীব, অসহায় অনাথদের জীবনে ভালোবাসার আলো জ্বেলে তাদের জীবনযুদ্ধে লড়াই করার মতো উপযুক্ত করে গড়ে তুলবেন। বাড়িতে খাবার নেই, পরিবারের সদস্যরা হয়তো অভুক্ত হয়ে আছেন, সে অবস্থায় তিনি সেসবের খেয়াল না রেখেই পথ থেকে কুড়িয়ে নিয়ে আসতেন পথে ফেলে যাওয়া স্পন্দনকে। আমরা বাবার এই মানবিক গুণাবলীর সমর্থক ছিলাম ও বাবার সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করতাম।
তখন আমি সম্ভবত ক্লাশ সেভেন কি এইটে পড়ি। বাবা একদিন আমায় কাছে ডাকলেন। ডেকে মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে বললেন — মা রে, দেখিসই তো আমাদের সংসারের হাল কী, তার চাইতে আমি বলি কি, কলকাতায় এক দম্পতি একজন মেয়েকে দত্তক নিতে চাইছিলেন, আমি তোর কথাই ভাবছিলাম। কলকাতার ভবানীপুরের পদ্মপুকুরে ওদের বাড়ি। ভদ্রমহিলা একজন বিশিষ্ট ডাক্তার। তাঁর ইচ্ছা তিনিও যাকে মেয়ে হিসেবে গ্রহণ করবেন তাকেও ডাক্তারি পড়াবেন। আমি তোর কথা ভেবে রেখেছি, তুই না করিস না, খুব ভালো থাকবি। মাঝেমাঝে আমার কাছে আসবি থাকবি, সে বিষয়ে আশাকরি তিনি বারণ করবেন না।

কেন জানিনা, আমি ছেলেবেলা থেকেই বাবা-মাকে ভীষণভাবে বিশ্বাস করতাম। তাই বাবা মাথায় হাত দিয়ে বোঝানো মাত্রই আমার মন বলে উঠলো — আমি যাবো। বাবা যখন বলছেন ওখানে গেলে আমার ভালো হবে তখন সেটাই ঠিক। আমি মনে মনে কলকাতা যাওয়ার জন্য নিজেকে তৈরী করে নিলাম।

অবশেষে চললাম কলকাতা। যাওয়ার সময় কিন্তু সবাইকে ছেড়ে যেতে মন ভারী হয়ে উঠলো। নদী, বাড়ির উঠোন, আমাদের ঘরবাড়ি, ততোদিনে আমাদের স্কুলে প্রায় একুশজন ছাত্রছাত্রী যাদের ভেতর আটজন আবাসিক বা আশ্রমিক শিশুকিশোর। ওদের ছেড়ে যেতেও খুব কষ্ট হচ্ছিলো, তবুও নিজেকে নিজে শক্ত করলাম। বোঝালাম ফের তো ফিরে আসবোই। সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাড়ির বাইরে পা রাখলাম। আর সেই মুহূর্তেই আমার ভেতরে জন্ম নিলো একজন নতুন ময়না করণ। যে আগের চাইতে অনেক ধীরস্থির ও প্রত্যয়ী।

কলকাতা — কলকাতা — একজন গ্রাম্য কিশোরী পা রেখেছে কলকাতার বুকে। অমন চওড়া চওড়া রাজপথ। দোতলা বাস, ট্রাম, গাড়ির মিছিল, নদীর স্রোতের মতো মানুষ হেঁটে চলেছে পথে পথে, আকাশছোঁয়া বাড়িঘর… আমি হাঁ করে দেখতে লাগলাম। মনের ভেতরে এক অজানা ভয় করতে লাগলো। নিজের বুকের শব্দ নিজে শুনতে পেলাম। আঁকড়ে ধরলাম বাবাকে। বাবা বুঝলেন বিষয়টা। মাথায় হাত রাখলেন — বুঝলি ময়না, এই হচ্ছে কলকাতা। আমাদের রাজ্যের রাজধানী, ভারতবর্ষের প্রধান শহরদের ভেতরে সেরা। মানুষ পাহাড় জয় করে, নদী সাঁতরে পেরোয়। তোকেও এই শহরকে জয় করতে হবে। এই শহরের বুকে সাঁতার কাটতে হবে।
আমি দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরলাম। মনে মনে বললাম আমি পারবো বাবা। আমাকে পারতেই হবে।

বাবার সাথে যে বাড়িতে গিয়ে উঠলাম সেটা একটা তিনতলা বাড়ি। যাওয়ার সময় বাবা সমস্ত রাস্তার নাম বলেছিলেন কিন্তু কোনো নামই মাথায় রাখতে পারিনি। শুধু যেটা মনে ছিলো সেটা হলো — ভবানীপুর আর পদ্মপুকুর।
একটুবাদে এলেন একজন প্রৌঢ়া। বাবার ইশারায় আমি তাঁকে ও বাবাকে প্রণাম করলাম। তিনি আমার থুঁতনি ছুঁয়ে আদর করলেন। সামান্য দুএকটা কথা ও চা জলখাবারের পর বাবা রওনা দিলেন। যাওয়ার সময় ফের মাথায় হাত দিয়ে বলে গেলেন — ভালোভাবে থেকো মা, তোমার মায়ের ( পালিকা মা) সবকথা শুনে চলবে কেমন? আমার নতুন মা আমাকে নিয়ে তিনতলায় আমার ঘরে নিয়ে এলেন। পরবর্তী সময়ে জেনেছিলাম যে ভদ্রমহিলা একজন লব্ধপ্রতিষ্ঠ হোমিওপ্যাথি ডাক্তার। ওঁর স্বামী শচীন্দ্রনাথ দাস প্রয়াত হওয়ায় তিনি একা হয়ে যান। নতুন মায়ের সাথে বাবার যে কথা হয়েছিলো সেটা ছিলো তিনি আমাকে তিনমাস রেখে দেখবেন। এই তিনমাসে আমি যদি তার মনোমতো করে নিজেকে গড়ে নিতে পারি তাহলে তিনি আমায় রাখবেন নইলে বাড়ি পাঠিয়ে দেবেন।
সত্যি বলতে কি, বাবা চলে যাওয়ার পর তিনি যখন আমায় আমার ঘরে ছেড়ে দিলেন তখন আমি জীবনে প্রথমবার স্বজন হারানোর শোকে ভেঙে পড়েছিলাম। আমার মনে হচ্ছিলো বাবা কেন এতো নিষ্ঠুর হলেন?
পরে বাবা আমাকে বলেছিলেন যে তিনি আশ্রমিকদের ভরণপোষণের যোগাড় করতে এতোটাই নাজেহাল ছিলেন যে তিনি যেহেতু নিজেই অন্যদের আশ্রয়দান করেছেন তখন তাদের হাত ধরে বিদায় দিতে পারেন নি। বরঞ্চ নিজের মেয়েকে অন্যকে দত্তক দেওয়ার মধ্যে তিনি নিজের মানবিকতার প্রশ্রয় পেয়েছিলেন।

সেদিনটা আমি জীবনেও ভুলবো না, যেদিন আমার তিনমাস পূর্ণ হলো সেদিন নতুন মা আমার ঘরে এসে বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরে আমাকে — ” আজ থেকে আমার মেয়ে হলি তুই ” বললেন। নিজের বাড়ি ছেড়ে এসেছি তিনমাস হলো। এই তিনমাস তিনি যেরকম আমাকে কোনোভাবে উত্যক্তও করেননি সেরকমই কোনোরকমভাবে প্রশ্রয়ও দেন নি। সেদিন আমার স্নেহহীন ছোট্ট হৃদয়টা যেন এক অপূর্ব স্বর্গীয় ভালোলাগায় ভরে গেলো। আমি আমার নতুন মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে বুকে মুখ গুঁজে ফুপিয়ে কেঁদে উঠলাম। কিন্তু আমার যেরকম পোড়াকপাল আমার এই সুখও দীর্ঘস্থায়ী হলো না। নতুন মায়ের দুটো কিডনিই ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত অবস্থায় ধরা পড়লো। এতোটাই ক্ষতি হয়ে গেছিলো যে কোনোরকম অস্ত্রপোচারও করা সম্ভব হলোনা। মাত্র বছর তিনেকের মাথায় তিনি আমাকে ছেড়ে অমৃতলোকে যাত্রা করলেন।

অন্ধকারের বুকেও অন্ধকার এসে জমা হয় কখনও কখনও। আমরা সাধারণ চোখে দেখিনা, কিন্তু যাদের বুকে এসে আঁধার জমা হয় তারা উপলব্ধি করতে পারেন।
বাবা-মাকে ছেড়ে চলে এসেছিলাম আমার সদ্য কিশোরী বেলায় আর নতুন মা যখন আমায় ছেড়ে চলে গেলেন তখন আমি কৈশোরকাল ছেড়ে রওনা হয়েছি যৌবনের দিকে। অন্ধকারটা যখন ফিকে হয়ে আসছিলো ঠিক তখুনি ফের এক চাপবাঁধা অন্ধকার এসে ঝাঁপিয়ে পড়লো আমার জীবনে।
আজ এই বিগতযৌবনকালে এসে বুঝতে পারি এই অন্ধকারগুলোই আসলে ছিলো আলোর সংকেত।

ফের যখন আমি এসে ঝাঁপিয়ে পড়লাম বাবার কর্মযজ্ঞে ততোক্ষণে বাবা অনেকটাই এগিয়ে গেছেন তার সাধনার সিদ্ধিলাভের দিকে। দুহাজার সাত সালে আমি সিদ্ধান্ত নিলাম বাবার সাধনযজ্ঞে আমি নিজেকে নিয়োজিত করবো একজন সাধিকা হিসেবে। এতদিন পর্যন্ত যেসমস্ত আশ্রমিকদের দিদি ছিলাম আমি এখন থেকে তাদের মা হয়ে ওঠার সাধনায় মগ্ন হবো।

শ্রদ্ধেয় বলরাম করণ সমাজসেবার কর্মযজ্ঞের যে বীজটি রোপন করেছিলেন খুশীর কথা সেই বীজটি আজ মহীরুহে পরিনত হয়েছে। আর আমার খুশী এজন্য যে আমার বাবা তার পুত্রকন্যাদেরও একইসাথে যোগ্য করে তুলেছেন তার পাশে দাঁড়ানোর জন্য। আজ পাঁউশি অন্তোদয় অনাথ আশ্রম বলরাম করণের পারিবারিক গন্ডীকে ছাড়িয়ে এক বিরাট বড়ো পরিবারের জন্ম দিয়েছে, যে পরিবারে শুধু আশ্রমিক ও তার পরিচালকেরাই নন সারা ভারতবর্ষ ও তার বাইরেও সহৃদয় সদস্যরা বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়ে শাখাপ্রশাখার বিস্তার ঘটিয়েছেন। সেখানে আমার সৌভাগ্য এই যে, আমিও সেই পরিবারের একজন গৌরবান্বিত সদস্য।

ক্রমশ

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।