সাপ্তাহিক ধারাবাহিক কথা সাগরে প্রদীপ গুপ্ত

বাউল রাজা

দ্বিতীয় খন্ড (ত্রয়োশ্চত্বারিংশ পর্ব)

খাওয়াদাওয়া শেষ হতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল। সোনাদার হাতের যাদুকে চেটেপুটে খেয়ে নিয়ে উঠলাম।
খাওয়ার পর নাগাবাবা, সোনাদার ঘরেই এককোণে একটু কাৎ হলেন। ধ্রুবদা সেই যে মাথা নীচু করেছেন, এখনও মুখ তুলে একটা শব্দও উচ্চারণ করেন নি।
–” তোমরা তালে পর একটু গইড়ে নাও, নাকি গো পদীপদাদা? আমি বরং একটু বাড়ির তেকে একপাক মেইরে আসি। ”
–” খাড়াও, আমিও যামু। ”
ধ্রুবদা মুখ তুললেন। সারাটা মুখে যেন অমাবস্যার কালো ছায়াকে ধরে রেখেছেন।
তিনজন মানুষ হেঁটে যাচ্ছে, কিন্তু একজনের মুখেও এতটুকু শব্দ নেই। এমনকি কাশির আওয়াজও নয়। কানাইদার মতো একজন সদালাপী মানুষ যে এরকম মূক হয়ে যেতে পারেন, সেটা ভাবাও যায় না। ধ্রুবদা প্যান্টের কোমরের দিকে হাতের পাঞ্জাটা গলিয়ে দিয়ে মাথা নীচু করে একটু খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলেছেন। ইদানীং ধ্রুবদার পায়ের ব্যথাটা একটু বেড়েছে মনে হচ্ছে।
আমি একটু পিছিয়ে এলাম। ইচ্ছে করেই ওদের থেকে কুড়ি পঁচিশ পা পেছনে হাঁটছি। আমার বাঁদিকে নদী। ওর সাথে একটু গল্প করতে খুব ইচ্ছে করছে। কিন্তু নদীর মুখে কোন টুঁ শব্দটি নেই, অন্য সময় কুলু কুলু শব্দটুকু অন্তত থাকে। এখন সে শব্দটুকুও নেই। জলের দিকে তাকিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে গেলাম। একদম নিথর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে নদী। যেন পাথর জমে আছে ওর সর্বাঙ্গে। একটা অজানা ভয়ে বুকটা কেঁপে উঠল। তাহলে কি…!
পাড়ের রাস্তা থেকে নীচে নেমে গেলাম। নীচু হয়ে ওর জল ছুঁলাম। যেন একটা অনূঢ়া কিশোরীর মতো কেঁপে উঠলো নদীর শরীর।
—” কী হয়েছে নদী! কোনো অঘটন ঘটে নি তো?”
কোনো উত্তর নেই, নদী চুপ করে রইলো।
–” কী হলো? কথা বলো নদী, আমার বাউলনি ঠিক আছে তো ? ”
নিশ্চুপ, নিঃশব্দ, নিস্পন্দ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো নদী।
–” বলবে তো? ঠিক আছে তো ? কিছু হয় নি তো আমার কৃষ্ণভামার? ”
হঠাৎ একটা হো হো করে হাসির আওয়াজ আমায় চমকে দিলো।
–” তোমার কৃষ্ণভামা ! তোমার বাউলনি! এ কতাগুলো বলতে তোমার এতোটুকুও লজ্জা করলো না? করবেই বা কেন, তুমিও তো পুরুষমানুষ। “
হঠাৎ করে এরকম কথায় আমার মুখে কোনো কথা জোগালো না। কী বলবো, কী উত্তর দেবো, এসব ভাবছি, এমন সময় ফের নদীর স্রোত চালু হলো। কিন্তু কি আশ্চর্য শব্দহীন সে চলা!
— ” দেখো নদী, তুমি কিন্তু অযথাই আমাকে দোষারোপ করছো, আমি কী ভাবে দায়ী হলাম বলো দেখি? ”
–” সত্যি কতা বলপো? রাগ করপে না তো? তোমাদের তো আবার কতায় কতায় রাগ। ”
–” আমাকে কবে রাগ করতে দেখেছো শুনি? ”
–” আমার সই কি সত্যিকারের তোমার মনের মানুষ? ”
এ কথার কী উত্তর দেবো? মনের মানুষ কারে কয়? সেই যে রবি বাউল লিখে রেখে গেছেন — ” আমার প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে, তাই হেরি তায় সকলখানে, আছে সে নয়নতারায় –” সত্যিই কি বাউলনি আমার নয়নতারায় বাস করে? যদি তাই করতো, তাহলে তাকে ভুলে এই সারাটাদিন তাকে না দেখে আমি রইলাম কী করে? আমার মনেই বা যদি তার বসত হতো, তাহলে সারাদিন তাকে আমার মনেই বা পড়লো না কেন?
–‘ কী হলো গো ঠাকুর? উত্তর নেই কেন গো? তোমার মনরে হাতড়ে বেড়াও দেকি, খোঁজ করো আঁতিপাঁতি করে, তালে পরেই উত্তর পেয়ে যাবে গো ঠাকুর। “
আমার মনে ঘুরেফিরে সেই রবিঠাকুর গুনগুন করে চলেছেন, –” আমি তার মুখের কথা, শুনবো বলে গেলাম কোথা, শোনা হলো না, হলো না… ”
সত্যিই তো, তার কথা সারাদিনে একবারের জন্যও কি মনে এলো? কই এলো না তো? তাহলে তো নদীর কথাই ঠিক। আমি কিসের জোরে বলতে পারি আমার বাউলনি, আমার কৃষ্ণভামা ! সে আমার মনের মানুষ, আমার মনের ঘরে তার বসত, আমার হৃদয়ে তার ভালোবাসার আসন পাতা?

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।