সাপ্তাহিক ধারাবাহিক কথা সাগরে প্রদীপ গুপ্ত

বাউল রাজা

দ্বিতীয় খন্ড (ষটিত্রিংশ পর্ব)

শেষের কথাগুলো কত সরল সোজা ভাবেই না বললেন অন্ধ বাউল !
— কী দেখিতে পাইতেছো?
— মাছের চোখ।
অর্থাৎ মনঃসংযোগ, যে কোনো কাজেই পারদর্শী হতে গেলে প্রথমেই যে জিনিসটার প্রয়োজন হয়, সেই একাগ্রতা। অভীষ্টর প্রতি নিবিষ্টতা।
মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে খেরোর খাতা খোলা মানে, নিবেদনে খামতি রাখতে নেই। মায়ের মুখ দেখতে গিয়ে যারা সংসারের অলিগলিতে নিত্যদিনের সুখের খোঁজখবর নিতে ব্যস্ত থাকেন, তাদের দিকে মায়েরও নজর থাকে না। এই আত্মনিবেদনের একাগ্রতাই সিদ্ধিলাভের পথ খুলে দেয়।
–” ঠিকই ভাবছো গো ঠাকুর। তবে সিদ্দিলাব কতাটার ভেন্ন ভেন্ন রূপ আচে গো। জেবনে চলার পতে, যে কোনো পরীক্কায় পাশ করাটাই সিদ্দিলাব গো। সে ইস্কুল কলেজের পরীক্কাই হোক, বা দরো গে তোমার পেমিকার মন পাবার পরীক্কা। যারা দরো গে গান গাইবে, সেকেনেও গানকেও ঈশ্বরের আসনে বইসে পূজা করতি অপে। তুমি দু’বেলা তোমার জন্মদাত্রীর পাদোদক খেলে, আর ভাইবলে বুজি তুমি তেনাকে তারাজ্ঞানে পূজা করতিচো, তালে পর ভুল চিন্তার রাস্তায় হাইটলে গো। তোমার মায়ের সুক – দুক্ক, অবাব – অবিযোগ, ভালোলাগা – মন্দলাগা সবকিচুর দিকে তুমি যদি নজর দিতি পারো, তাহলেই না… ”
–” আচ্ছা কানাইদা, একটা কথা জিজ্ঞাসা করবো? কিছু মনে করবে না তো? ”
— ” তোমার কোন কতাটা আমি মনে দইরে রেকেচি বলো দিকি? ”
–” মা তারার সামনে দাঁড়িয়ে আমি কখনো মায়ের মুখ, কখনো বাউলনির মুখ দেখতে পাই, এর মানে কি আমার মনও তাহলে… “
মন্দিরের চাতাল পেরিয়ে আমরা সিঁড়িতে পা রেখেছিলাম। এই সিঁড়ির পর প্রায় কুড়ি ফুট নীচেই লাল মোরামের রাস্তা চলে গেছে ডাইনে বাঁয়ে দু’দিকে। কানাইদা হঠাৎ করে দাঁড়িয়ে গেলেন। মাথাটা ঈষৎ নাড়লেন। তারপর… তারপর এক অদ্ভুত দৃশ্য। কানাইদার দু-চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রুধারা, আমাকে দু’বাহুর বাঁধনে বেঁধে তিনি যেন শিশুর মতো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন।
বেশ কিছুটা সময় আমরা ওইভাবে সেই সিঁড়ির ওপর দাঁড়িয়ে আছি। সিঁড়ির নীচে পাদুকা রাখার জন্য একজন বুড়িমা বসেছিলেন। তার কাছেই জুতোজোড়া জমা রেখে মন্দিরে ঢুকেছি। রোদ্দুরে শানবাঁধানো সিঁড়ি আগুনের মতো তেতে আছে। খালি পায়ে সেই তপ্ত শানের ওপর দাঁড়িয়ে আছি।
আমি পরিষ্কার বুঝছিলাম, কানাইদা আমাকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে ঠিকই , কিন্তু তাঁর শরীরের কোনো ভার ভাব নেই। একেবারে পালকের মতো হালকা শরীর। পরে বাউলনির থেকে শুনেছিলাম, আত্মা যখন পরমাত্মার সাথে মিলনে মাতে তখন শরীরের কোনো ভার ( ওজন ) থাকে না। আর আরও একটা বিষয় আশ্চর্যের সাথে লক্ষ্য করলাম, যে মুহূর্তে আমার পায়ের দহনজ্বালা অনুভূত হয়েছিলো, ঠিক সেই মুহূর্ত থেকেই কেউ বুঝি পায়ের তলায় শীতল প্রস্রবণ বইয়ে দিচ্ছিলো।
–” আমি যে আমার গভ্যদারিনীকে চোকেই দেকলাম না কোনোদিনও, কী অন্যায় আমি করেচিলাম বলো তো পদীপদাদা! এ লিচ্চয় আমার পূব্ব জন্মের পাপ হপে গো! আমি ঠিক বিচার কইরে উটতি পারচি না গো , তুমি পুণ্যবান না তোমার গভ্যদারিনী পুণ্যবতী নাকি মা তারা? আমি তেনাকে শুদুলুম, তা তিনি তো খিলখিল কইরে হেসেই অস্তির। তবে এটুকু বুজলুম তোমার একেনে আসাটা ঠিক হচ্ছে না গো। ”
সিঁড়ি দিয়ে একপা দু’পা করে নামছি। কানাইদা ফের বলে উঠলেন,
–” দ্যাকো দিকিনি, ফের একটা মস্ত বড়ো ভুল কইরে ফেললুম। যে তুমি, তিন পেমের আদারকে একাঙ্গী কইরে ফেলার মতো ক্ষেমতা রাকো, সেই তোমাকে আমি কি বোকার মতো জ্ঞানবাক্যি শুইন্যে দিলাম৷! আমার এ কতা তুমি যেন মনে নিও না গো ঠাকুর। তোমারে পত নিদ্দেশ দেওয়ার ক্ষেমতা আর যারই থাকুক না কেনে আমার নেই গো। “
–” যো হ্যায় উও দেখতা নেহি, যো দেখতা উও হ্যায় নেহি। ”
আমরা যখন সিঁড়ির মাঝামাঝি, তখন এই কথাটা ভেসে এলো। তাকিয়ে দেখে চমকে উঠলাম। সারাগায়ে ভস্মমাখা, সম্পূর্ণ উলঙ্গ, যৌনাঙ্গে গাঁথা রয়েছে একটা লোহার শিকল, আর সেই শিকলের শেষে একটা তালা, সেই শিকল সিঁড়ির ধাপে ধাপে লেগে একটা ধাতব সুর তুলেছে। মাথা নীচু করে লোকটা উপরে উঠছে। আমরা দু’জনেই থমকে দাঁড়িয়ে গেছি। আমাদের ঠিক নীচের ধাপে এসে আমার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসলেন সেই মানুষটি।
–” কে গো নাগাবাবা নাকি? ”
–” সহি সমঝা বাউলবাবা। লেকিন ইয়ে লেড়কা কৌন? ”
— ” কলকেতা তেকে এয়েচেন গো। বড় ভালো মানুষ। খুব ভালো গান করেন গো বাবা। ”
–” হুম। ”
বলেই ফের মাথা নীচু করে সিঁড়ি ভাঙতে লাগলেন মানুষটি। আমরাও নীচের দিকে পা বাড়ালাম। সিঁড়ির ধাপে ধাপে সেই লোহার ধাতব সুর বাজতে বাজতে চললো। রাস্তায় পা দিয়ে যখন পেছন ফিরে চাইলাম, ততক্ষণে তিনি চাতালে অদৃশ্য হয়েছেন।

চলবে

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।