T3 || অবিস্মরণীয় নজরুল || বিশেষ সংখ্যায় পূর্বা দাস
by
·
Published
· Updated
তোমার বিনা – তারের গীতি
মোমের পুতুল মমীর দেশের মেয়ে…
আমাদের ছোট্ট স্কুলের ছোট একটা ফাংশনে একটা ক্ষুদে মেয়ে মোমের পুতুলের মত নেচে যাচ্ছিল। সেসময় আমি মাত্র সাত বছরের, প্রাইমারি স্কুলের গন্ডি পেরোইনি। সবাই মুগ্ধদৃষ্টিতে নাচ দেখছিল। কি সাবলীল ভঙ্গি… কি সুন্দর সেজেছে ও। আমার চোখের সামনে নাচ কিন্তু মনটা ঘুরে বেড়াচ্ছে গানের সুরে। এ কেমন সুর! কেমন গান! বুক অফ নলেজের দৌলতে মমীর দেশ কোথায় তা জানি। মিশর… আফ্রিকা… সাহারা… বেদুইন… আমাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল ওই দেশে। আমি নাচতে দেখছি এক বেদুঈন মেয়েকে। তার লম্বা বেণী, ঘাগরা, কাচলি, ওড়না উড়িয়ে ছুটে ছুটে নেচে বেড়াচ্ছে মরুভূমির মধ্যে। বিশেষ করে যখন সেই সুদূর… কথাটায় একটা অদ্ভুত টান। ফেরার সময় মা’কে জিজ্ঞাসা করলাম, ” এই গানটা কার লেখা গো? এরকম গান তো শুনিনি। ” এই প্রসঙ্গে বলি আমাদের বাড়িতে গান বাজনার রুচি একটু অদ্ভুত। পুরনো চোঙাওয়ালা গ্রামোফোনে এইচ এম ভির রেকর্ডে বাজত দেবব্রত বিশ্বাসের গান। শ্যামা, বাল্মিকীপ্রতিভা শুনে শুনে মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল। জ্ঞান প্রকাশ ঘোষ আর বেগম আখতারের রাগপ্রধান। সন্ধ্যাবেলায় ঠাম্মার সাথে প্রার্থনা সংগীত গাওয়া বাধ্যতামূলক ছিল। সেখানে বেশিই ছিল রবীন্দ্রসঙ্গীত আর অতুলপ্রসাদী। কিন্তু এই সুর, ছন্দে দুলে ওঠার মত গান কখনো গাইনি, শুনিওনি। মা বলল, “এটা নজরুলগীতি”। তখন বাড়িতেই গান শিখি। ঠাম্মার কাছে হারমোনিয়ামে, বাবার গিটার আর দাদুর এস্রাজের সাথে গলা মেলাই। বাবাকে বললাম, ” আমি নজরুলগীতি শিখব।” ” ও গান শিখতে গেলে রাগরাগিণীর ধারণা চাই আগে” বাবা বলল। ফলতঃ গানের স্কুলে ভর্তি হলাম আর সে বছরই বইমেলা থেকে এলো নজরুলগীতি অখন্ড। নতুন কেনা টেপরেকর্ডারে বাজল ফিরোজা বেগম আর অনুপ ঘোষালের কিছু গান।
কিন্তু এত সহজে কি তাঁকে জানা যায়! একটু বড় হয়ে ‘ মানুষ ‘ নজরুলকে চিনতে শুরু করলাম। আমার বাবা নজরুলকে দেখতে গিয়েছিল একবার। তিনি তখন বোধশক্তিরহিত। তবুও দেবতা দেখার আনন্দ পেয়েছিল, পরবর্তী বহুবার সেই ঝাঁকিদর্শনের গল্প থেকে বোঝা যায়। আমার পূর্ববঙ্গীয় পূর্বপুরুষদের মধ্যে সেসময় মুসলিম প্রীতির চেয়ে মুসলিম ভীতি প্রচলিত ছিল। কৈশোরের সরলতার প্রশ্ন করলাম, ” নজরুল যে মুসলিম ছিলেন?” বাবা বলল, ” মুসলিম! তবে ওমা দনুজ দলনী মহাশক্তি… ওরে নীল যমুনার জল… লিখলেন কি করে?” ” তবে কি পরে হিন্দু হয়েছিলেন?” ” হিন্দু! কোন হিন্দু এই গান লিখেছে বলত, ঐ হের রসুলে খোদা এল ঐ” ধর্মবোধের প্রশ্নটা সেদিন অমীমাংসিতই রইল। সম্ভবত বাবারও জানা ছিল না উত্তর।
নজরুলকে নিয়ে বহু মানুষের স্মৃতিচারণা পেলাম কল্যাণী কাজী সম্পাদিত ‘ শত কথায় নজরুল ‘ বইতে। লাইব্রেরী থেকে আনলাম নজরুল-জীবনী। তার মধ্যে তাকে খুঁজে পাওয়ার থেকে যেন হারিয়ে ফেলা বেশি। ইতিমধ্যে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত চর্চায় কিছুটা এগুনোর পর নজরুলসংগীতের স্বর্ণখনির প্রবেশদ্বার খুলল। এবার বুঝলাম, কবিকে খুঁজে পেতে হয় তার সৃষ্টিতে। স্মৃতিচারণা, অভিভাষণ, চিঠিপত্রে তার বাইরের বিচ্ছুরণ দেখা যায়। সাজিয়ে তোলা কথা, বানিয়ে তোলা ব্যাখ্যার গোলকধাঁধায় ঘুরে মরি।’ গভীর নির্জন পথে’র সাধনার ফসল তার কাব্য, তার গান। রাগরাগিণীর প্রতিটি পাপড়ি থেকে সমস্ত মাধুর্য সংগ্রহ করে তার অন্তরের বিরহমিলনাতুর ভাবের মিশেলে অজস্র সৃষ্টির ঝর্না। নজরুলকে, কবি নজরুলকে মনে হয় সেই একক বুলবুল, যে নার্গিস বনে ঝরাবনগোলাপের বিলাপকেও অনুভব করতে পারে। সেই কবি নজরুল, যাকে তাঁরই ‘ সুরে ও বাণীর মালা দিয়ে’ ই শুধু স্পর্শ করা যায়, আপন করা যায়।
বহুবছর নির্বাককালে কবির মনোজগতে কি চলেছিল সে হয়তো চির অজ্ঞাত থেকে যাবে।হয়ত গভীর নৈরাশ্য… হয়ত নিগূঢ় সাধনা…আজ লোকত্তর জীবনে কবির চোখ দুটিকে বারবার মনে হয়। যেন দূরে থেকে অনিমিখ দৃষ্টিতে এখনো চেয়ে আছেন প্রিয় দেশটির দিকে। প্রিয় মানুষদের জন্য যে সৃষ্টি তিনি রেখে গেছেন তার যথার্থ ব্যবহারের আগ্রহে। হয়ত আবার কোন দুরন্ত বৈশাখী ঝড়ের রাতে ফিরে আসবেন তার বিদ্রোহী অশান্ত সত্ত্বা নিয়ে। আশায় থাকি আমরা… আশায় থাকি…