ধারাবাহিক অনুবাদ গল্পে পূর্বা দাস (পর্ব – ৬)

যুদ্ধের প্রহর

সেই হাসিটা মুখে লেগে থাকা অবস্থায় ও সৈনিকটির দিকে তাকায়। দেখে সেও ওর দিকেই তাকিয়ে আছে।
” আরি …” লোকটির চোখে জল। ও কুঞ্জকে বাও করে। কুঞ্জ বোঝে, এ হলো শ্রদ্ধার, কৃতজ্ঞতার সংকেত। বেচারা কুঞ্জ। কোমর ঝুঁকিয়ে আধাখেচড়া একটা বাও ফেরত দেয় লোকটিকে।
” ঘুমোও এবার। এই বিছানা এখন তোমার। আরামে ঘুমাও দেখি।” কুঞ্জ জানে ওর কথা লোকটি কিছুই বুঝবে না। শুধু মমতাভরে ও কম্বল দিয়ে ভাল করে ঢেকে দেয় ওকে। লোকটি একদম বাধ্য শিশুর মতো কুঞ্জর ব্যবস্থা মেনে নেয়। এখন আর ওকে তেমন ভয়ঙ্কর কিছু মনে হচ্ছে না। এতই দুর্বল ও, যে কিছু যদি করতেও চায় সেটা খুব হাস্যকরই হবে। আর কুঞ্জ, সতের বছরের সদ্য তরুণ কুঞ্জর কাছে ওকে কব্জা করতে একটু সময় লাগবে না।
মেঝেতে বিছানো কম্বলের ওপর কুঞ্জ বসে পড়ে। ঘরের আলোটা আজ জ্বালিয়ে রাখবে বলেই ঠিক করে ও। লুকিয়ে লোকটিকে লক্ষ্য করতে থাকে কুঞ্জ। লোকটি সোজা হয়ে শুয়ে আছে ।অন্যমনস্ক ভাবে সিলিঙের দিকে চেয়ে কি যেন ভাবছে। চোখের জল গড়িয়ে পড়ছে মুখের এক পাশ দিয়ে।
“তুমি বাপু যুদ্ধ করতে এসেছ এই ঘোর বিদেশে। কি আশা করো তুমি, রাজার বিছানায় রাত কাটাবে?” কুঞ্জ ভাবে, বেশ ভালই করুণা করা হয়েছে এই বিদেশী সৈনিকের জন্য। নিজের মনকে একটু ঘোরাতে ও সতর্ক ভঙ্গিতে বসে থাকে। না। রাতটা সতর্ক থাকতে হবে। এদের বিশ্বাস আছে? ও ঘরে বাবা-মা… কিন্তু বসে থাকতে থাকতে কখন কম্বলের ওপর ঢুলে পড়েছে আর যখন চোখ মেলল, দেখে বাইরের অজস্র আলো ছাদের ফাঁকফোকর আর জানালা গলে ভেতরে ঢুকে কুঞ্জকে যেন ঠাট্টা করছে।
” ইস! একদম মড়ার মত ঘুমিয়েছি আমি।” নিজের গালে চড় মারতে ইচ্ছে করে কুঞ্জ র। তড়াক করে উঠে দাঁড়ায় এবং প্রতিবর্ত ক্রিয়াতেই চোখ যায় সৈনিকটির দিকে। সে এখনো একইভাবে স্থির। সোজা হয়ে শুয়ে তাকিয়ে আছে ছাদের দিকে।
কুঞ্জ বাইরের ঘরে এসে দেখে সেখানে প্রাতঃরাশের প্রস্তুতি চলছে। বাবা সবজি কাটায় ব্যস্ত। মা উঠোনের এক কোণে চালগুলো কচলে কচলে ধুয়ে নিচ্ছে।
” এদিকে আয়। উনুনের ওপর যে গামলাটা বসানো আছে সেটা নিয়ে যা। সকালে উঠে জঙ্গলে ঘুরে পাতাগুলো তুলে এনেছি।কালকাসুন্দের শেকড় ও আছে ওতে। সেদ্ধ করা জলটা ওকে খেতে বল। ওর ঘায়ের জায়গাগুলো শুকোবে খন।” মা খনখনে গলায় একবারও কুঞ্জর দিকে না তাকিয়েই কথাগুলো বলল। বাবাও যেন কুঞ্জকে দেখতেই পায়নি এমনিভাবে নিজের কাজ করে যেতে লাগল।
“লক্ষ্মী মা আমার ” কুঞ্জ শান্তভাবে ভেষজ ঔষধের ছোট পাত্রটা নিয়ে সৈনিকটির কাছে গেল।
” খাও এটা” বলে ও আস্তে আস্তে পানীয়টা ওকে গিলতে সাহায্য করল। লোকটিও বাধ্য শিশুর মত খেয়ে নিল সবটা। লতাপাতার তেতো স্বাদটা ওর জিভে কেমন লাগবে সেটা কল্পনা করে কুঞ্জর হাসি পেল। কিন্তু লোকটি একবারও মুখ বিকৃত করল না, যতক্ষণ না পুরো পাত্র খালি হল।
আর কিছু না বলে কুঞ্জ ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। আসলে ও বুঝতে পারছিল না এই বিদেশির সাথে কিভাবে কথাবার্তা চালানো যায়। মধ্যাহ্নভোজনের সময় কুঞ্জ ওকে আবার খাইয়ে দিল। ওদের রান্না করা খাবারে সৈনিকটির কোন আপত্তি দেখা গেল না। দূরে বোমাবর্ষণের আওয়াজ অহরহ এবং মাথার ওপর এরোপ্লেনের গর্জনেরও বিরাম নেই। কিন্তু এখন আর কেউ এসব গ্রাহ্য করছে না। অন্তত কুঞ্জ এবং তার নতুন অতিথি তো নয়ই। মনে হয় ওরা কল্পনা করছিল, ঘরের ছাদ টিনের নয় বরং রাজকীয় ইট-পাথর বা সোনা দিয়েই বুঝি তৈরি।
দিন তিনেক পর লোকটি নিজে নিজে উঠে বসতে পারল। এখনো ও কুঞ্জর থেকে নিয়ম মত ওষুধ আর খাবার খেয়ে নিচ্ছিল এতটুকু আপত্তি ছাড়াই।
কুঞ্জ সৈনিকটিকে দেখে আর বিস্মিত হয়। কিভাবে পৃথিবীর অন্য প্রান্তে থাকা এক মানুষ প্রায় ওর মতনই দেখতে হয়! ও এখন প্রায়ই সৈনিকটির পাশে বসে থাকে বিশেষত যখন বিকট শব্দ করে এরোপ্লেন গুলো উড়ে যায়। দুজনের চোখ অনেক কথা বলে। কিন্তু ঠোঁট অসহায় ভাবে নিঃশব্দ থাকে।
“অন্তত তোমার নামটাও যদি জানতে পারতাম!” কুঞ্জ বলে। স্বভাবতই অপর পক্ষ থেকে কোন উত্তর আসে না।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।