T3 || কোজাগরী || বিশেষ সংখ্যায় পূর্বা দাস

পরমাত্মিকা

বরং নেমে আসি স্মৃতিসরণিতে। সময় এখন খুব এলোমেলো। যে বর্ষার ফিরে যাবার কথা ছিল ভাদ্রে, সে এই আশ্বিনের শেষে ভোররাতে মল্লারে তান সাধে। ভিক্ষে করাকে নিন্দে করতে পারিনা। আমাদের দেবতা যে ভিখারী শিব। দুয়ারে দুয়ারে অন্নপূর্ণার কাছে ঝুলি ভরে এমনই এক ভিখারী সন্ন্যাসী তৈরি করেছেন স্কুল, স্বাস্থ্যকেন্দ্র। বেশি দূরে না। এই বাংলাতেই। কিন্তু ভিক্ষার দান যখন একটা গোটা জাতের আত্মমর্যাদা বিলোপ করে, রাগ করতেও ভুলে যাই। প্রাণ জুড়ে শুধু হাহাকার। আমার গৃহ-সাহায্যকারী মেয়েটির হাতের নার্ভ শুকিয়ে যাচ্ছে। পুজোর বোনাসের টাকা জমা করে দুই ছেলে-মেয়ের জন্য বাহারি জামাপ্যান্ট কিনল। কিন্তু হাসপাতালের চিকিৎসায় ওর হাত দিন দিন ওকে পঙ্গুত্বের কিনারায় নিয়ে যাচ্ছে। এই আমাদের সনাতন শিক্ষা, সনাতন ধর্মের দেশ। ছুটে পালাতে ইচ্ছা করে ভীষণ। এখানে না, এখানে কিছুতেই না। কোন আলোকিত প্রান্তর কি অপেক্ষায় আছে আমার!

সত্যিই পালিয়েছিলাম একদিন। দৌড়, দৌড়, দৌড়। তখনও শ্রাবণ। জলে ডুবে আছে মাঠঘাট। টুপটুপে ভরা পুকুর-ডোবা। বাঁশপাতা থেকে জল ঝরছে ফোটা ফোটা। দৌড়তে দৌড়তে রাস্তার দু’পাশের সবুজের রং আশ্চর্য কোমল হয়ে এল। শ্লথ হল গতি। একেই কি বলে পান্না রং! আদিগন্ত শুধু ধানের চারা। কোথাও একটুও ধোঁয়া নেই, ধুলো নেই। শান্তির জল ছিটিয়ে আকাশ সব দূষণ ধুয়ে দিয়েছে। শুধু দু একটা গরুর গাড়ির ক্যাচকোচ।

আমি নেমে গেলাম মাঠে। আলপথে হাঁটা অভ্যাস আমার ছোটবেলার। একটা আইবিস দেখতে পেয়েছি। ব্ল্যাকহেডেড আইবিস। বর্ষার ধানক্ষেতে এরা প্রায়ই থাকে। আমার পায়ে স্ট্র্যাপ শু। জিন্স গুটিয়ে নিয়েছি একটু। ওর জুটিটাকে খুঁজছি। আইবিস তো একা থাকে না। আরেকটা থাকতেই হবে। তৃষিত চোখ আর ক্যামেরা আতিপাতি করে খুঁজছে আরেকটা কালো বিন্দুকে, তখন অন্য একটা বিন্দু যে ছোট থেকে বড় হতে হতে অবয়ব হয়েছে টের পাইনি। অবাক হয়েছে সে। প্রায় ভিনগ্রহী চেহারার আমি। মাথায় কালনার কাছে হাইওয়ের ওপর একটা দোকান থেকে কেনা বেতের টুপি, গলায় ঢাউস ক্যামেরা, ক্যামোফ্লেজ ফুলহাতা শার্ট আর সেই রঙের জিন্স। ভ্যাবাচ্যাকা তো একটু হবেই। তবু মাটি, জল, হাওয়াতে দুজনের ভীষণ মিল। নিশ্চিত টান। সে ভরসাতেই টুপি খুললাম। মুখে চোখে বন্ধুত্বের হাসি ফুটিয়ে নিলাম। তাকিয়ে দেখি, ফুল ফুল ছাপা শাড়ির আঁচল কোমরে শক্ত করে পেঁচিয়ে নিয়েছে। দিগন্ত ছোঁয়া সবুজের মাঝখানে ও নিজেই একটা ছবি হতে পারত। কিন্তু এখন সে আভাস দিলে বন্ধুত্ব সেঁতিয়ে যাবে। ওর মাথার বোঝাটা দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম,

  • কি ওগুলো?
  • ধানের চারা।
  • সেকি! ধান পুতেছ, আবার তুলে ফেললে! নষ্ট হবে নাকি সব?

জবাবে খিলখিল হাসি। সেই হাসির অনুবাদে আছে অনেক স্নেহ, অর্বাচীনের উপর নির্ভেজাল দয়া, হয়ত বা উপছে পড়া বাৎসল্যও।

  • তা তুমি এখানে এমন একা? কেন?

আহা! ও আমায় ‘তুমি ‘ বলেছে। এ কিন্তু রেওয়াজ নয়। আদ্যপ্রান্ত শহুরেকে এতো সহজে কাছে টেনে নেওয়া – না। এ মেয়ের এলেম আছে।

  • আসলে জল তেষ্টা পেয়েছে খুব। ধারে কাছে কাউকে তো দেখছি না। তোমাকে দেখলাম দূর থেকে আসছ…

আমার মধুর মিথ্যেটাকে বুঝেও বেশ ভালোভাবেই নিল। মিটিমিটি হেসে বলল,

  • তবে চল, হুই যে আমার ঘর। এখানে তো এই বৃষ্টির কাদাজল খাওয়াতে পারব না।

ক্যামেরার লেন্সে দেখলাম রাস্তার ওপারে আধখানা চাঁদের মতন ধানজমির শেষে কিছু নারকেল সুপারির সারি। আর হ্যাঁ, কয়েকটা বাড়ির আভাসও ।রাস্তা দিয়ে গেলে দু তিন কিলোমিটার তো হবেই।

  • চল, আমার বাহন টা নিয়ে নি।

অসংকোচে এলো আমার সাথে সাথে। ছোট্ট অলটো গাড়ি আমার। জিজ্ঞাসা করে,

  • ড্রাইভার?
  • আমার ড্রাইভার আমিই।

মাথার বোঝা কোলে রেখে বসল আমার পাশে। মিনিট দশেকে পৌঁছলাম ওর গ্রামে। ওর মাটির বাড়িতে কালো রং করা। তার ওপর সাদা আর কাঁচা হলুদ দিয়ে লতাপাতার আলপনা। বাইরে দড়ির খাটিয়াতে একজন বয়স্ক মানুষ আর দু-তিনজন কমবয়সী হাত পাখার হাওয়া খাচ্ছিলেন। আমায় দেখে এক গলা বিস্ময়। সামলে নিয়ে বয়স্ক মানুষ বললেন,

  • সাহেব, তুষ্টির হাত থেকে নে না – আটিগুলো নে রাখ যত্ন করে।

সাহেব হলেও ছেলেটি কুচকুচে কালো, আর এই মেয়ে তাহলে তুষ্টি।

  • এসো, ঘরে এসো।

এভাবে কতদিন কেউ ডাকেনি আমায়। আমি হাত তুলে নমস্কার করি সবাইকে। সবারই পায়ে কাদা আর আমার শরীর ঝুঁকতে শিখেছে কি এখনো! এবারে আমি ওর পেছনে। নীচু ছাদের ঘর। দরজায় মাথা ঠেকে যায়। ঘরের ভেতরে একটি আসবাবেও আধুনিকতার ছোঁয়া নেই। বেতের মোড়া, তার ওপরে গোল করে পাতা গদিতে সুন্দর কারুকাজ। সস্তার কাঠের চৌকিতে টানটান সতরঞ্চি। জানলার চওড়া তাকে কাঁসার ঘটিতে পাতাশুদ্ধ মাধবীলতা। হাত ধুয়ে জল এনে দিল আমায়। শিউলি ফুলের মত ধবধবে সাদা কয়েকটা নারকেল নাড়ু আর কাঁসার ক্লাসে জল। আমার সাজানো ড্রয়িংরুমের চিনেমাটির ট্রে আর গ্লাসের কথা ভেবে লজ্জা পেলাম।

  • আমি স্নান করে আসি গো। হাতে পায়ে কাদা। অনেক ভোরে বেরিয়েছি। তুমি কথা বলো ওদের সাথে।

যদিও এই ঘরটা ছেড়ে বেরোতে ইচ্ছা করছিল না, কিন্তু ভদ্রতায় বাঁধল। বাইরে উদাস মুখে বৃদ্ধ। তুষ্টি মোড়া পেতে দিয়ে গেল আমার জন্য। বৃদ্ধ আপন মনেই বলছিলেন,

  • উনিশ বছরে বিধবা হয়ে এখন ছাব্বিশে পড়েছে। আমার ঘর আলো করে আছে ও। কোন সকালে মাঠে যায়। ওর হাতের ছোঁয়া পেলে ফসল আমার লকলকিয়ে বাড়ে। আমার জমিতে, জানো মা, বাজারের সার দিই না আমরা। তুষ্টিই শিখিয়েছে। ভাগ হতে হতে এখন মাত্র পনের বিঘে আমাদের ভাগে। লেখাপড়া শেখাচ্ছিলাম। হঠাৎ করে সম্বন্ধ এল, ভালো চাষী ঘর। আমাদেরই মত। এখন সে ঘর অন্ধকার।
    কথা বলতে বলতে বৃদ্ধ আরো অন্যমনস্ক হচ্ছিলেন। তুষ্টি স্নান করে এসেছে। এখন ওর পরনে একটা ম্যাক্সি। আমরা যাকে নাইটি বলি, ঠিক সে রকম না। গলার কাছে, হাতে, এমনকি পায়ের ঘেরের কাছেও ফ্রিল দেওয়া খুব সুন্দর একটা পোশাক। কাপড়টা একটু উন্নত মানের হলে এটা পরে আমি অনায়াসে বন্ধুদের আড্ডায় গিয়ে বসতে পারব।
  • এই দেখো, কি সুন্দর মা আমার। এরকম সব পোশাক বানায় ওরা। একটা ঘর আছে ওদের, আমার বাড়ির পেছনেই। গ্রামের অনেক মেয়ে সেলাই শিখছে। ওদের হাত পাততে হয় না গো মা কারো কাছে।

বৃদ্ধের গলায় উচ্ছ্বাস ঝরে পড়ছে।

সাহেব এগিয়ে এল।

  • দিদি আমায় জোর করে কল্যাণীতে পড়তে পাঠিয়েছিল, জানেন। এখন চেষ্টা করছি গ্রামের আরও দুতিনজনকে ওখানে পাঠাতে। কত কি শেখা যায়, কত কি জানা যায়। আমরা ঠিক করেছি মাটি নষ্ট হতে দেব না। সন্ধ্যেবেলায় আমাদেরও একটা আসর হয়। গানটান হয় তার সাথে ছোট ছোট ছেলেদের বলি, যেন ওরা চাষ ছেড়ে দেওয়ার কথা না ভাবে।

এবার ফিরতে হবে। শহরের অন্ধকূপ আমায় গিলে নেবে আবার। তুষ্টিকে একটু একান্তে ডাকলাম।

  • তোমার ভাল নাম বল। যে নামে স্কুলে পড়তে। যে নামে তোমার একটা অ্যাকাউন্ট আছে ব্যাংকে।
  • অশোকা।
    ও অবাক চোখে তাকায়।
  • দান করার স্পর্ধা নেই আমার। শুধু তোমাদের পাশে একটা আসন রাখার
    দাবী জানিয়ে যেতে চাই। তাই গুগল পে। সাথে আমার ফোন নাম্বারটাও রেখে দাও। যদি কখনো দরকার হয়। তোমার ভাঁড়ারের উৎস কখনো যেন শুকায় না তুষ্টি।

এত কথা মুখে বলতে পারিনি। মনে মনে বলেছিলাম। আর বলেছিলাম, লক্ষ্মীর কাছে সম্পদ গচ্ছিত রাখলাম। জানি, দ্বিগুণ হয়ে ফিরে আসবে, আমার না হোক আমার সন্ততিদের জন্য। পুজোর আবার দিনক্ষণ হয় নাকি!

আজ কোজাগরীর চাঁদ উঠলে লক্ষ্মীর বর্ণনা পড়তে গিয়ে দেখলাম তুষ্টি আর অশোকা দুটোই লক্ষ্মীর সমনামী।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।