।। ত্রিতাপহারিণী ২০২০।। T3 শারদ সংখ্যায় পত্রালিকা

ছোটমা

তিতির স্কুল থেকে ফিরে ব্যাগটা কোনরকম রেখে স্কুল ড্রেসটা পরেই বিছানায় শুয়ে পড়ে ধপাস করে। তিতিরকে ওরকম করে শুয়ে থাকতে দেখেই রমনা ওর পাশে এসে বসে মাথায় হাতটা রাখতেই তিতির রমনার হাতটা এক ঝটকায় সরিয়ে দেয়। রমনা আবার একবার হাতটা রাখতেই তিতির এবার মাথাটা ঘুরিয়ে বেশ ঝাঁঝের সুরেই বলে ওঠে, কি হলো টা কি? আমি কি একটু চুপ করে শুয়েও থাকতে পারবোনা?
রমনা – তুমি স্কুল থেকে এসে এমন করে তো শুয়ে থাকো না তিতির, তাই আমি ভাবলাম তোমার শরীর টরীর খারাপ হলো নাকি।
তিতির – আমার কিচ্ছু হয়নি। প্লিজ আন্টি এখন যাও এখান থেকে।
রমনা – তিতির, তোমার কিছু অসুবিধা হলে বলতে পারো আমায়?
তিতির – আমার কিচ্ছু অসুবিধা হচ্ছেনা। আচ্ছা আমি কি একটু একা শান্তিতে থাকতে পারবো না? তোমাকে বললাম তো প্লিজ তুমি যাও।আর এবার থেকে আমার ঘরে ঢোকার সময় নক করে ঢুকবে।
তিতির কথাটা শেষ করা মাত্রই নিলয় বেশ কড়া গলায় বলে ওঠে, তিতির, ও তোমার মা। তোমার মা হয়ে তোমার ঘরে ওকে নক করে ঢুকতে হবে? তুমি কিন্তু বারবার ওকে অপমান করছো, আর একবার যদি…
তিতির – আর একবার যদি করি কি করবে তুমি আমায়? মারবে?
আমি যাকে তাকে আমার মা বলে ডাকতে পারবোনা বাবা। আমার মা ঐযে আছে ছবিতে, আমার সাথেই আছে। আমার মা থাকতে আমি অন্য কাউকে মা বলে ডাকতে পারবোনা। তোমার মত এত তাড়াতাড়ি সব ভুলে যাই কি করে।
নিলয় – আমি কিচ্ছু ভুলে যাইনি তিতির। আমি কিন্তু তোমার কথা ভেবেই..
তিতির – এটা আমায় প্লিজ বোলোনা বাবা। এগুলো তোমার একটা অজুহাত। আমার জন্য তুমি আবার বিয়ে করেছ এটা আর সবাই বিশ্বাস করলেও আমি বিশ্বাস করিনা।
আসলে তুমি চাইছিলে বিয়ে করে আমার মাকে ভুলে আবার সবকিছু নতুন করে…
নিলয় – তিতির… চুপ করো তুমি। আর একটাও কথা না। বড্ড বেশি কথা বলে ফেলছো তুমি আজকাল।তুমি বোধহয় ভুলে যাচ্ছ কার সাথে কথা বলছো।
রমনা আর দেরি না করে তিতিরের ঘর থেকে কোনরকম সরিয়ে নিয়ে নিজেদের ঘরে নিয়ে যায় নিলয়কে। তখনকার মত দুজনেই আর কোন কথা বাড়ায়না।
রাতে যখন জানলার ধারে দাঁড়িয়ে দূরের আকাশের দিকে তাকিয়ে একটার পর একটা সিগারেটে টান দিয়ে যাচ্ছে নিলয়, তখন রমনা নিলয়কে বলে, তোমার খুব কষ্ট হচ্ছে তাইতো? নিশ্চয়ই মেয়েটাকে ওরকম করে কথা বলতে চাওনি তুমি।
নিলয় – আমি সত্যিই চাইনি রমনা তুমি বিশ্বাস করো। মেয়েটা হঠাৎ করেই যেন কেমন হয়ে যাচ্ছে।
রমনা – ওর এরকম হওয়াটা কি খুব অস্বাভাবিক নিলয়। একটা ক্লাস এইটে পড়া মেয়ে তার মা মারা গেছে এই দুটো বছর হলো, দুম করে কাউকে মা বলে মেনে নেওয়া যে ওর কাছে খুব কষ্টের।
নিলয় – তার মানে কি তাই রমনা, তুমি এত চেষ্টা করছো ওকে আপন করে নেওয়ার, আর ও বারবার তোমায় অপমান করবে?
রমনা – আচ্ছা নিলয়, তোমার সাথে আমার বিয়ের প্রথম শর্তই তো ছিলো তিতিরকে ভালো রাখা, ওর মা হয়ে উঠতে হবে আমায়। আমি তো সেই চেষ্টাই করছি।
ওকেও তো একটু বুঝতে হবে আমাদের। ওর এই আচরন তো খুব স্বাভাবিক নিলয়। ও যদি কখনোই ওর মাকে কাছে না পেতো, না দেখতো তাহলে আমাকে মা বলে মেনে নেওয়াটা অনেক সহজ হতো ওর কাছে। আর ওর মা চলে যাওয়ার পর তোমাকে আঁকড়ে ধরেছিল মেয়েটা।
নিলয় – আমিও ওকেই আঁকড়ে ধরেছি রমনা। আমি ভেবেছিলাম ওর একটা মা এনে দিলে হয়তো ওই ফাঁকা জায়গাটা পূরণ হবে।
রমনা – এ তোমার বড্ড ভুল ধারনা নিলয়। পৃথিবীতে কারোর জন্য কিচ্ছু থেমে থাকেনা একথাটা যেমন ভীষন ভাবে সত্যি, তেমন এটাও ঠিক যে কারোর জায়গা কেউ নিতে পারেনা। আর মায়ের কাছে সন্তান আর সন্তানের কাছে তার মায়ের কোন বিকল্প হয়না নিলয়। মা হারা সন্তানের ব্যথাটা বোধহয় আমরা ঠিক কেউই বুঝতে পারিনা যতক্ষন না নিজেদের জীবনে সেটা ঘটছে।
নিলয় – তুমি হয়তো ঠিকই বলছো রমনা। কিন্তু আমিতো ওর ভালোর জন্যই..
রমনা – আমি বলি কি নিলয়, তিতিরকে একটু সময় দাও। আমি বুঝি তুমি ওর ভালোর জন্যই সবটা করো। আমরা শুধু ওর ভালোটা চাইলেই যে হবেনা, ও কিসে ভালো থাকবে, ওর কি ভালো লাগে সেটা যে ওর থেকে কেউ ভালো বলতে পারবেনা।
তুমি হয়তো ওর মা চলে যাওয়ার পর থেকে অনেকটা সময় দিতে ওকে, এখন আমি আসার পর অনেকটা সময় নিজের কাজে ব্যস্ত হয়েছো। ওর মনে হতেই পারে যে আমি এসে ওর বাবাকে কেড়ে নিয়েছি ওর থেকে। ওকে আরেকটু সময় দেওয়ার চেষ্টা করো, দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে।
নিলয় – তুমি বলছো রমনা। সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি যে তিতিরকে ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারিনা।
রমনা – আচ্ছা সেকথা আমার থেকে আর কে বেশি জানে বলতো। কাল তোমার ভোরের ফ্লাইটে যাওয়া। এবার আর কথা না বলে শুয়ে পড়ো।
নিলয় – তোমায় আমি কথা দিলাম রমনা এবার অফিস টুর থেকে ঘুরে এসে আমি মেয়েটাকে সময় দেবো। তুমি কিন্তু তিতিরের খেয়াল রেখো, আর সাথে নিজের কথাও ভুলে যেওনা।
রমনা – তিতির আমারও মেয়ে নিলয়, ওর খেয়াল রাখবো না তো কার রাখবো বলো।
সেদিন খুব ভোরে বেরোনোর ঠিক কিছুক্ষন আগে নিলয় দরজা ঠেলে ঢুকে তিতিরের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, তিতির আমি আসছি, তুমি লক্ষ্মী হয়ে থেকো কেমন।
তিতির তখন নিলয়ের হাতটা ধরে বুকের কাছে নিয়ে বলে, প্লিজ বাবা যেওনা তুমি।
নিলয় এবার তিতিরের পাশে বসে গালটা ধরে আদর করে নিজের কাছে টেনে নিয়ে যেতেই টের পায় তিতিরের শরীরের উত্তাপ। আর তারপরই বলে, তিতির তোমার জ্বর হয়েছে নাকি, গা টা এত গরম।
তিতির তুমি রাতে কিছু বলোনি তো।
কথাটা শুনেই রমনাও ছুটে আসে ঘরে, তিতির সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করেই বলে ওঠে, বাবা প্লিজ তুমি যেওনা আজকে।
নিলয় এবার তিতিরের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে, আমার যে আজকে একটা ভীষন জরুরি কাজে যেতেই হবে তিতির। আমি ডাক্তার আঙ্কেলকে ফোন করে দিচ্ছি তোমায় এসে দেখে যাবেন, আর তোমার মা তো আছেই তিতির। তুমি একদম ঠিক হয়ে যাবে দেখো।
তিতিরের হাতটা কোনরকম ছাড়িয়ে মনটা তিতিরের কাছে রেখেই নিলয় বেরিয়ে পড়ে। রমনা সেই থেকেই তিতিরের পাশেই বসে থাকে। মাঝেমাঝে জ্বরটা বাড়ছে, রমনা মাথায় জলপট্টি দিয়ে যাচ্ছে, ডাক্তারকে ফোন করে তাড়াতাড়ি আসার জন্যও বলতে থাকে ও।
ডাক্তার যখন আসে তখন তিতিরের জ্বর বেশ ওপরের দিকে, সঙ্গে নিশ্বাস নিতেও বেশ কষ্ট হচ্ছে। ডক্টর কিছু ওষুধ লিখে চলে যেতেই বাড়ির রোজকারের কাজ সামলানোর, সন্ধ্যা দি কে দিয়ে সবটাই আনিয়ে নেয় রমনা। ওষুধগুলো সময়ে ঠিকমত দিলেও জ্বরটা যেন সেরকম কমছেনা কিছুতেই।
সেদিন রাতে তিতিরের ঘরে একটা চেয়ারেই বেশ খানিকটা সময় কাটিয়ে দেয় রমনা, তারপর হঠাৎ মনে হলো তিতির যেন কিছু বলতে চাইছে, তিতিরের দিকে এগোতেই বুঝতে পারে তিতিরের শ্বাসকষ্টটা হচ্ছে খুব, চোখটা যেন ঠেলে বেড়িয়ে আসছে কষ্টে। রমনা আর বিন্দুমাত্র দেরি না করে ডাক্তারকে ফোন করে। ডাক্তারকে বার কয়েক ফোন করে না পেয়ে তড়িঘড়ি একটা অ্যাম্বুলেন্স জোগাড় করে তিতিরকে নিয়ে হসপিটালে গিয়ে পৌছায়। ইমার্জেন্সিতে তিতিরকে দেখেই ডাক্তাররা আই সি ইউ তে নিয়ে চলে যায়, আর রমনাকে বলে যায়, আপাতত কিছুই বলা যাবেনা। কয়েকটা টেস্ট এখনি করতে হবে। রমনা আই সি ইউ এর বাইরের লাউঞ্জে বসে থাকে ঠায়, যদি ডাক্তাররা কিছু বলে।আর মাঝে মাঝেই তিতিরের কষ্ট পাওয়া চোখ দুটোর কথা মনে পড়ে চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে ওর। তারপরই হঠাৎ মনে পড়ে, নিলয়কে জানানো হয়নি কিছুই, তারপর নিলয়কে ফোন করতেই ওপার থেকে নিলয়ের গলার স্বরটা শুনেই হাউহাউ করে কেঁদে ফেলে রমনা, কাঁদতে কাঁদতেই বলে, আমাদের তিতির ভালো নেই নিলয়, তুমি ফিরে এসো।
নিলয় – ভালো নেই মানে? কি হয়েছে? জ্বরটা কি আরো বেড়েছে? কি হয়েছে বলো রমনা।
রমনা – তুমি ফিরে এসো নিলয়। তিতির হসপিটালে, আমি তোমায় সেখান থেকেই ফোন করছি। ডাক্তাররা বলছেন আপাতত কিছু বলা যাবেনা। তিতির খুব কষ্ট পাচ্ছে।
সেদিন রাত থেকে রমনা একভাবে বসে আছে আই সি ইউ এর সামনে, আর মাঝেমাঝে ডাক্তাররা আই সি ইউ এর দরজাটা খুললেই ছুটে যাচ্ছে সেদিকে, যদি জানা যায় তিতির এখন কেমন আছে, যদি একটু মেয়েটাকে ছুঁয়ে দেখা যেত। ফ্লাইটের জন্য জোগাড় যন্ত্র করে নিলয় ফিরে আসে পরের দিনই। পরদিন সকালে নিলয় আর রমনাকে ডেকে ডাক্তার নিজেই বলেন, তিতিরের নিউমোনিয়া হয়েছে, এবং ফুসফুসে সংক্রমন বেশ খানিকটা ছড়িয়ে গেছে। আপাতত অবস্থা অনেকটা আয়ত্তে আনা গেছে, তবে এখনও দিন তিনেক হসপিটালে থাকতে হবে তিতিরকে। তবে আজকের ভিসিটিং আওয়ার্সে চাইলে একবার তিতিরের সাথে দেখা করতে পারে দুজনেই।
নিলয় আর রমনা সেদিন অপেক্ষায় থাকলো বিকেল চারটের। ঘড়ির কাঁটা চারটে বেজেছে জানান দিতেই দুজনেই আই সি ইউ এর দরজায় গিয়ে দাঁড়ালো। নিলয় রমনাকে আগে ঢুকতে দিতে বললেও রমনা নিজেই বলে, তুমি আগে যাও নিলয়। তিতির নিশ্চয়ই তোমার অপেক্ষায় আছে।
নিলয় আর কথা না বাড়িয়ে ভেতরে ঢুকেই দেখে তিতির সাদা বিছানায় লেপ্টে আছে একরকম, চোখদুটো দরজার দিকেই চেয়ে আছে। নিলয়কে দেখেই উঠে বসার চেষ্টা করলেও নিলয় নিজেই হাতের ইশারায় বারন করে জিজ্ঞেস করে, কেমন আছো তিতির? আই অ্যাম এক্সট্রিমলি সরি তিতির। আমি বুঝতে পারিনি তোমার এতটা শরীর খারাপ।
এখন কি একটু ভালো লাগছে?
তিতির হু বলেই বলে, বাবা ঐ আন্টি কোথায়?
নিলয় – আন্টি তো বাইরেই আছে তিতির। আন্টি তো আজ দুদিন ধরে এখানেই আছে।
তিতির – আমি জানি বাবা। ডাক্তার আঙ্কেল আমায় বলেছে। তুমি একবার আন্টিকে ডেকে দেবে?
নিলয় – ডেকে দিচ্ছি। তবে তুমি কিন্তু বেশি কথা বলোনা তিতির। তোমার রেস্টের প্রয়োজন।
বাইরে গিয়ে রমনাকে ডেকে ভেতরে আসতে বলতেই রমনা একটু ইতস্তত করেই এগিয়ে যায় তিতিরের কাছে। তারপর তিতিরের মাথায় হাত রেখে বলে, তিতির এখন কেমন আছো তুমি?
তিতির – ভালো। তুমি বসো না।
রমনা – আমি ঠিক আছি তিতির। বলো কিছু বলবে? অসুবিধা হচ্ছে কিছু?
তিতির – তোমায় একটা কথা বলার ছিল।
রমনা – বলো তিতির।
তিতির – আমি কি তোমায় মা বলে ডাকতে পারি আন্টি?
রমনা – না তিতির। তোমার মা একজনই। তুমি বরং আমায় ছোটমা বলে ডেকো।
কথাটা বলতে বলতেই আনন্দে রমনার দুচোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে, তিতিরকে বুকের কাছে আঁকড়ে ধরে রমনা, আর রমনার স্পর্শে তখন তিতির যেন অনুভব করছে এইতো তার হারিয়ে যাওয়া মায়ের ছোঁয়া, মা বলেই তো এমন করে আগলে রাখে তিতিরকে।
কখন পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে নিলয়, ঠোঁটের কোনে কুড়িয়ে পাওয়া টুকরো সুখ লেগে থাকলেও চোখে তখন অশ্রুধারা, মনে মনে বলে যাচ্ছে, একটা জটিল সম্পর্কের ধাঁধা কত সহজেই তুমি সমাধান করে দিলে রমনা।
আমি পেরেছি শ্রীলা, তোমার কথা রাখতে। তোমার বলে যাওয়া শেষ কয়েকটা কথার মধ্যে তিতিরের একটা মা এনে দেওয়ার কথাটা আজ আমি রাখতে পেরেছি। তুমি দেখেছো তো, তোমার মতই তিতিরকে আগলে রেখেছে তিতিরের ছোটমা।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।