গদ্যের পোডিয়ামে পিয়াংকী – ধারাবাহিক – (অষ্টম পর্ব)

ওরফে তারাখসা এবং তুমি বালক
অবশিষ্ট দগ্ধ। পুড়ে গেল শেষমেষ। এবার একটি কৃষ্ণগহ্বর পড়ে থাকবে বিশাল পাত্র জুড়ে। রাত যদি কাব্য হয় আর তার শরীর চিরে যদি জীবন ছিঁড়ে আনি আমি , তাহলে আমাকে নিশ্চিত ওয়ারিয়র বলা যায়। তবু কেউ একথা স্বীকার করে না। এর পেছনে কোনো রহস্য অনুমান করতে পারি না বলেই চুপ থাকি। “কবিতা রচনার জিনিস নয়, চুরি করা কথা”, আমার বাবা বলেছিলেন একদিন। আচ্ছা, আমি কি তবে প্রতিদিন আপনাকে চুরি করতে করতে এগোচ্ছি? কথা যদি কবিতা হত, তাহলে গদ্যের প্রয়োজন পড়ত না, এই সামান্য একখানি কথা আমার বাবা মানতে চান না। যে কোনো কবিতা তাঁকে পড়ে শোনাতে গেলে কনক্লুশন লাইনে পৌঁছলেই তিনি কীভাবে যেন মিলিয়ে দেন মানুষের বক্তব্যের সাথে। বলেন,” এই তো সেদিন তোর মার সাথে ঝগড়া হচ্ছিল তুই চৌকির কোণে বসে শুনছিলি, সেটাকেই দেখ লিখেছিস” আমি থ’ হয়ে বসে থাকি। কোথাও গিয়ে নিজেরই মনে হয় ঠিকই তো বলল বাবা। আদতে বাবা ঠিক বললেন নাকি আমিই ঠিক বলাতে সাহায্য করলাম,সেটা বুঝতে পারি না।
এই প্রভাব বিষয়টা বড় অদ্ভুত । সরাসরি কাজে লাগে না কিন্তু কাজে লাগতে সাহায্য করে ভীষণ। যেমন বাবার প্রভাব আজকাল আমায় মানুষের জবানি লিখতে সাহায্য করছে। নবাবি আমলে সাহেবরা যেমন আধিপত্য বিস্তার করে ধীরে ধীরে আমাদের সাম্রাজ্য দখল করেছিলেন, আমিও তেমনি তোমার কথা শুধু লিখে চলেছি। নাম দিচ্ছি ‘কবিতা’। এই ‘তুমি’ তুমি নও। এই তুমি মানে সমাজ দেবতা সন্তান গাছ পাখি সব। শুধুমাত্র যুদ্ধ জানি আমি।কথা লিখতে হলে নিজের ভিতর যুদ্ধ নামাতে হয়। দুই পক্ষ সাজাতে হয় দাবার ছকের নিয়মে। এই দুই পক্ষ আসলে একটি আমি। আমিই নীল আমি-ই সবুজ। তুমি লাল বা হলুদ হতে পারো তাতে আমার কিছুই যায় আসে না। আমি সবুজের হয়ে চাল ফেলি যতটা বুদ্ধি দিয়ে ঠিক ততটাই বুদ্ধি দিয়ে নীলের জন্যও চাল ফেলি। এ এক অদ্ভুত খেলা। খেলতে খেলতে একসময় সন্ধে হয়। পাখি উড়ে যায়। চাঁদ ওঠে। ফের, রক্তাভ করি আধার।
আঁধার যতই উর্বর হতে থাকে পতিত জমি কমে যায় তত। শোকের লোকগীতি শুনি। শোক আমি বিক্রি করি না। টাকা আমার দরকার, শোক আমার সম্পত্তি। শোকটুকু ছাড়া আমার ব্যক্তিগত কোনো গদ্য নেই। নিজস্ব লাল বলতে গেলে ওই শোক। আর কবিতা বলতে আপনার থেকে চুরি করা কথা। আজকাল বাবাকেই আমার বালক মনে হয়। জীবনের এই কিছুটা পথ পার করে আসার পর দেখি , নৈবিদ্য সাজিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দৃঢ়প্রত্যয় ঋজু এক পুরোহিত ,পৃথিবী নাকি তাকে “মৃত্যু” নামে চেনে। আমার কাছে বাবাই পুরোহিত বাবাই শ্রেষ্ঠ কথাকার।
সামান্য কিছু শব্দের এই গদ্য লিখতে লিখতে আচমকা শো-ইনফো তে গিয়ে চেক করলাম। তিনশো পঁচাশি শব্দ লিখেছি গদ্যের আকারে।পুরোটাই বাবার বক্তব্য চুরি করে সাবানের ফেনা জমানো। অর্থাৎ, বাবাই সঠিক। নিজস্ব বলতে কিচ্ছু নেই। সবই ধার করা। বাবা বলেছিলেন, “মানুষের সাথে মানুষের কথাই তুই কবিতার আকৃতিতে লিখিস “। আজ যুক্ত করছি, মানুষের সাথে মানুষের কথাই আমি গদ্যের আকৃতিতেও লিখি। এ ঋণ শোধ তাই অসম্ভব।