কথা সাগরে মৎসকন্যা (ধারাবাহিক) নীলম সামন্ত – স্বাদকাহন

স্বাদকাহন (হট ডগ)
“ডগ ডে ইন নিউ ইয়র্ক”
দৃশ্যপট: ১৯০১ সাল, নিউ ইয়র্কের একটি বেসবল স্টেডিয়াম। গ্যালারির পাশে সসেজ বিক্রি চলছে। হঠাৎ এক ছোটখাটো লম্বা শরীর, ছোট পা-ওয়ালা কুকুর, চোখে রাগ আর আত্মসম্মানের আগুন নিয়ে এসে হাজির হয়।
ডাচশুন্ড (কুকুর):
(রাগি রাগি মুখে)
ওহে ও গরম সসেজওয়ালারা! শুনছি আমার নাম নিয়ে ক্ষুধার্তদের এদিকে টেনে আনছ?
সসেজ বিক্রেতা:
(হাসি মুখে)
আরে কুকুর ভাই, তুমিই তো আমাদের অনুপ্রেরণা! তোমার ল্যাজের মতোই তো দেখতে এই সসেজটা—লম্বা, সরু। আর তোমার মতোই সরসও ।
ডাচশুন্ড:
(ঠোঁট চেপে)
তাই বলে সোজা আমার নাম লিখে রাখলে মাংসের নামের পাশে? তুমি ভাবছো, মানুষ জানবে না আমি এক নিঃস্ব জীবন্ত কুকুর, আর তোমার ওটা মাংস?
সাংবাদিক ট্যাড ডরিগান:
(কার্টুন আঁকছেন)
বাহ! এটা তো দারুণ বিষয়! “Hot Dog”! কুকুরও গরম, সসেজও গরম! দারুণ কিছু আঁকা যায়, কয়েকদিন ধরে এডিটর দাদা যা জ্বালাচ্ছিল, এবার মুখের ওপর ছুঁড়ে দেওয়া যাবে আর লোকে বেশ মজাও পাবে৷
ডাচশুন্ড (চেঁচিয়ে):
আমি যদি কাল থেকে তোমার নামের সাথে কোনো স্ট্যু কিংবা র্যাপের নাম জুড়ে বিক্রি করি, খুশি হবে?
বিক্রেতা:
আরে বাবা, নামই আকর্ষণ! লোকে পছন্দ করছে—শুনেছো না? Yale-এর ছেলেপুলেরা তো বলেই, “Give me a hot dog!”
ডাচশুন্ড :(বিরক্তভাবে)
আমি জার্মান! আমি অভিজাত! আমার পূর্বপুরুষরা রাজপরিবারের বাগানে ইঁদুর মারত। আর আজ আমি? এক পাউরুটির মাঝে আশ্রিত হয়ে চিবিয়ে ফেলার নাম? কি ভেবেছ আমায়?
ট্যাড ডরিগান(হাসতে হাসতে):
এই যে পুঁচকে কুকুর তুমি আজ ইতিহাসের অংশ হয়ে যাচ্ছো। ইঁদুর তো অনেকেই মারে, আর কুকুরও অনেক আছে৷ মানুষ ভুলে যাবে একদিন তোমাকে, বংশলোপ পেলে কার দায় পড়েছে খুঁজে আনার? কিন্তু মনে রাখবে নামটা—“Hot Dog”! মানুষের পেট যতদিন আছে খাবার কখনও ফুরোবে না। তাই আনন্দ করো! খাবে নাকি একখানা সসেজ?
ডাচশুন্ড (নিঃশ্বাস ফেলে):
হুম! মন্দ বলোনি। অন্তত কেউ যদি কুকুর খায় না জেনে, আমাকে নিয়ে হাসে, পেট ভরায়, আনন্দ পায়, তৃপ্তি পায় সেটাই বেঁচে থাকা। তবে একদিন তোমরা বুঝবে—নামের ভেতরও আবেগ থাকে। দেখি দাও একটা, কেমন খেতে! আমাদের মেরে তৈরি করেছ নাকি?
বিক্রেতা:
আরে না না, শুধু তোমার নামটা — নাও হাঁ করো (একটা সসেজ ছুঁড়ে দিলেন)
ডাচশুন্ড (হাসিমুখে):
আহ! বেশ দারুণ তো! করো করো বিক্রি করো, মাঝে মাঝে আমাকেও এক আধটা দিও…
(হট ডগ সংক্রান্ত সব থেকে জনপ্রিয় গল্পের ওপর নির্ভর করে আমার লেখা একটি মজার কথপোকথন )
হট ডগ — গ্রামে বড় হওয়ার কারণে এই সব বিদেশী বা শহুরে খাবার সম্পর্কে ধারণা একেবারেই ছিল না৷ ভালোমন্দ খাবার বলতে মোঘলাই এগরোল চাউমিন আর পাউরুটি খেতাম ডিম টোস্ট কিংবা জ্যাম বাটার লাগিয়ে৷ গ্রামের বাড়িতেই নব্বুইয়ের দশকের ছেলে মেয়ে হিসেবে আমরা যে এতো কিছু পেয়েছি এটাই অনেক। কারণ বেশিরভাগ বাড়িতেই টিফিন বলতে মুড়ি আর তেল লঙ্কা দিয়ে পেঁয়াজ মাখা, নইলে পান্তা ভাত৷
গ্র্যাজুয়েশন পড়তে যখন কলকাতায় এলাম তখনই দেখলাম প্যাটিস, স্যান্ডউইচ, আর গোল, লম্বা পাউরুটি, যাকে আজ বান বলি। লম্বা পাউরুটিগুলোর মাঝে কাটা এবং তার ভেতর মাংসের কিছু একটা দেওয়া। সামনের নেম প্লেটে নাম লেখা থাকত হট ডগ৷ হট ডগের সাথে এই ভাবে দূর থেকে আলাপ হলেও সামনে মিলন হওয়াতে মন চাইত না। কারণ আমি ভাবতাম পাউরুটির ভেতর বোধহয় কুকুরের মাংস আছে৷ চিলি চিকেন যার দৌড় সে কিভাবে সসেজ জানবে এটা একটা বড় প্রশ্ন৷ কিন্তু যখন জানলাম এতে কুকুরের মাংস থাকে না, আর পরবর্তীতে ক্যালিফোর্নিয়াতে খেয়ে দেখলাম সসেজ দেওয়া। সসেজ যদি মুরগি বা গরু শুকোরের মাংস থেকে তৈরি হয় তবে নাম হট ডগ কেন? তখন তো গুগুল ছিল না যে দুম করে টাইপ করব আর হুস করে উত্তর এসে যাবে৷ তবে অনুসন্ধান তো ছিলই। আস্তে আস্তে অনেক গল্প জানলাম।
সসেজ, একটি লম্বা পুঁটলির মধ্যে মাংসের কিমা ভরা বস্তু, যা প্রক্রিয়াজাত খাবারগুলির মধ্যে প্রাচীনতম ও উল্লখযোগ্য। এই সসেজের উল্লেখ হোমারের লেখা ওডিসিতেও পাওয়া যায়৷ শোনা যায় জার্মানির ফ্র্যাঙ্কফুট নামক শহরেই সসেজ প্রথম তৈরি হয়৷ প্রথমে গরু এবং শুকোরের মাংস দিয়েই তৈরি হত। কিন্তু পরবর্তীতে মানুষের স্বাদ ও খাবার ধরণের তফাৎ অনুযায়ী মুরগীর মাংস দিয়ে সসেজ বানানো শুরু হল। আবার এও শোনা যায় বিশ শতকের দিকে জার্মানিতে কুকুরের মাংস খাওয়ার প্রচলনও ছিল। ফলে সসেজের নাম হয়েছিল এক জার্মানি কুকুরের নামেই, ডাচশুন্ড বা ছোট্ট কুকুর সসেজ। অনেকে দাবি করেন এই জনপ্রিয় সসেজ ষোড়শ শতাব্দীর শেষের দিকে জার্মানির কোবার্গে বসবাসকারী একজন কসাই জোহান জর্জেহনার দ্বারা তৈরি করা হয়েছিল। এই প্রতিবেদন অনুসারে, জর্জেহনার পরে তার নতুন পণ্য প্রচারের জন্য ফ্রাঙ্কফুর্ট ভ্রমণ করেছিলেন।
খাবার উৎপত্তির গল্প অনেক রকম থাকে। সে যুগে সঠিক ডকুমেন্টেশন পদ্ধতি ছিল না আর খাবারের পেটেন্ট করা যায় এমনটাও হয়তো সাধারণ মানুষ ভাবেননি। তাই অনেক রন্ধনশিল্পীর নানান রসালো খাবার টিকে থাকলেও তাদের নাম হারিয়ে গেছে। ইতিহাসবিদরা কেবল পুরনো পত্রপত্রিকা নাড়াচাড়া করে যতটুকু তথ্য পেয়েছেন তার ওপরেই এই সমস্ত অনুসন্ধান। আবিষ্কার যেই করুক না কেন সসেজ যে জার্মানিতেই জন্মলাভ করেছিল তার কোন দ্বিমত নেই৷ তাহলে লম্বা পাউরুটি আর আমেরিকার স্ট্রিট ফুড হিসেবে বিখ্যাত হল কিভাবে? এই প্রশ্ন তো এসেই যায়।
জার্মানি থেকে আমেরিকাতে সসেজ মূলত শরনার্থীদের হাত ধরেই চলে আসে। ঠিক যেমনটা কলকাতার ফুচকা বা মেদিনীপুরের আলুর চপ ব্যবসার তাগিদে ভারতবর্ষের নানান রাজ্যে ছড়িয়ে পড়ে তেমনই জার্মানিরাই আমেরিকার নানান জায়গায় গরম গরম লাল সসেজ ঠেলা গাড়িতে করে বিক্রি করতেন বলে জানা যায়। বিশ শতকের দিকে দিনমজুর থেকে শুরু করে কারখানার শ্রমিক মধ্যে এই খাবারটি বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ১৮৯৩ সালে শিকাগোতে কলম্বিয়ান এক্সপোজিশনে প্রচুর দর্শনার্থী আসেন। সেখানে প্রচুর পরিমানে সসেজ বিক্রি হয়েছিল। আর লোকজন পছন্দও করেছিল কারণ দামও কম আর খেতেও সুবিধাজনক। তখনও সসেজের সাথে বানের উল্লেখ সেভাবে পাওয়া যায়নি ঠিকই কিন্তু হট ডগ ইতিহাসবিদ ব্রুস ক্রেইগ, রুজভেল্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপকের মতে জার্মানরা সবসময় রুটির সাথে ড্যাচসুন্ড সসেজ খেত।
আবার অনেক হট ডগ বিশারদের মতে ১৯০৪ সালে সেন্ট লুইস “লুইসিয়ানা পারচেজ এক্সপোজিশন”-এর সময় বাভারিয়ান কনসেশনার, অ্যান্টন ফিউচটওয়ানগার দ্বারা প্রবর্তিত হয়েছিল। সত্য কি অসত্য তার প্রমাণ না পাওয়া গেলেও গল্পটি বেশ মজাদার। এই সসেজ বিক্রেতা গরম গরম লাল সসেজ হাতে ধরে খাওয়ার জন্য সকলকে এক ধরণের গ্লাভস পরতে দিতেন। নিয়ম ছিল খাওয়ার পর গ্লাভস ফেরত দেবেন। দেখা গেল গ্লাভস ফেরত দেওয়ার ক্রেতা খুবই কম। এদিকে দোকানে গ্লাভসের অভাব শুরু হল। তখন ওই বিক্রেতা তার শ্যালক যিনি ছিলেন বেকারি, তাকে সমস্যার কথা বললেন এবং সুরাহার পরামর্শও চাইলেন৷ সেই বেকারিই সসেজের সাথে মানানসই বান বানিয়ে দিলেন এবং মাঝ বরাবর কেটে পকেট তৈরি করে দিলেন যার ভেতর সসেজ সুন্দর ভাবে বসানো যায়। অধ্যাপক ক্রেইগ এসব গল্প মানতে নারাজ৷ আসলে মালিকানা যেহেতু নথিবদ্ধ নেই তাই যে যেভাবে পারে সেভাবেই দাবী করে।
হট ডগ নামকরণের পেছনেও এই ধরণের একটি গল্প শোনা যায়। ১৯০১ সালের দিকে নিউইয়র্কের পোলো গ্রাউন্ডে বেসবল খেলার সময় এক সসেজ বিক্রেতা বহনযোগ্য গরম জলের ট্যাঙ্ক থেকে হট ডগ বিক্রি করছিল এবং গলা চড়িয়ে চিৎকার করে বলছিল “Get your red-hot dachshund sausages!” —
নিউ ইয়র্ক ইভনিং জার্নালের একজন ক্রীড়া কার্টুনিস্ট, ট্যাড ডরগান (Tad Dorgan) একটি কার্টুন আঁকেন। তাতে দেখা যায়, এক লোক এক রোলের মধ্যে একটি লম্বা কুকুরের মতো সসেজ খাচ্ছে, আর নিচে লেখা আছে:
“Get your Hot Dogs!” ডরগান ডাচশুন্ড বানান লিখতে পারছিলেন না বলে মজার ছলে “হট ডগ” কথাটি ব্যবহার করেন। যদিও এই কার্টুনটি পরে বা আজও আর পাওয়া যায় না৷ এমনও হতে পারে এটি জাতীয় সংরক্ষণাগার বা পেন্টাগনের গোলকধাঁধার গভীরে সমাহিত।
ক্রেইগ মনে করেন যে কার্টুনটি ডরগান এবং বিক্রেতার মধ্যে একটি রসিকতা হিসাবে শুরু হয়েছিল, যারা খ্যাতিমানভাবে ভালো বন্ধু ছিল, কিন্তু কোনওভাবেই “হট ডগ” এর প্রথম উল্লেখ ছিল না।
নামকরণ বা সসেজ থেকে বানের ভেতর সসেজের যাত্রাপথ নিয়ে নানান বিতর্ক থাকলেও আমার মনে হয় সবটাই ধীরে ধীরে বিক্রেতা দ্বারাই তৈরি ক্রেতাদের আকর্ষণ বাড়ানোর জন্য সাথে সুবিধের জন্যও। যেভাবে অল্প অল্প করে সমস্ত খাবারেই সংযোজন ঘটেছে।