কথা সাগরে মৎসকন্যা (ধারাবাহিক) নীলম সামন্ত – স্বাদকাহন

ইডলি
ঠাকুমা ছিলেন রন্ধন পটিয়সী, মাকে যেমন হাতে ধরে নানান সাবেকি রান্না শিখিয়েছিলেন, তেমনিই আমাকেও৷ আমার তখন আট বছর বয়স। মা বাবা দাদা আমি সাথে ঠাকুমা মিলে গিয়েছিলাম দক্ষিণ ভারত বেড়াতে। তখনকার দিনে এমনই ট্যুর হত৷ প্রায় একমাস টানা বাসে করে লোটা কম্বল নিয়ে বেরিয়ে পড়া। দক্ষিণ ভারত মানেই ধোসা ইডলির ভিড়। বাস যেখানেই দাঁড়ায় সকলেই গিয়ে গিয়ে দুটো করে ইডলি কিংবা ধোসা খেয়ে চলে আসে৷ সেই বয়সে এই খাবারটি আমার একেবারেই ভালো লাগেনি৷ যখনই সবাই খেতে বসত আমার গা গুলিয়ে উঠত আর মনে মনে ভাবতাম এদের কি কোন কাজ নেই এই উদ্ভট খাবারটিই খেতে হবে! কেন? এর থেকে তো আমাদের আস্কে পিঠে অনেক সুন্দর। আহা! কেমন প্রতি কামড়ে নারকেল কুচি মুখে পড়ে। মনে পড়ে ঠাকুমাকে বলেছিলাম ইডলিগুলো তোমার আস্কে পিঠের থেকে অনেক ছোট। আর সাদাটাও একটু কম। হাসতে হাসতে ঠাকুমা বলেছিলেন, ‘যেই দেশ যাই সেই ফল খাই’। কথাটা আমি ঠিক বুঝিনি, অনেক প্রশ্ন করেছিলাম, তখন তিনি যা উত্তর দিয়েছিলেন তার যৎসামান্যই আজ মনে আছে। হুবহু তো বলতে পারি না অর্থ টুকুই শেয়ার করছি৷
গরমকালে আমাদের বাঙালিদের মধ্যে পান্তাভাত খাওয়ার রেওয়াজ আছে৷ যদিও আমাদের বাড়িতে পান্তাভাত কম জলঢালা ভাত বেশি খাওয়া হত। আসলে ভাতে জল দিয়ে খেলে পেট ঠান্ডা হয়। পশ্চিম মেদিনীপুরের দিকে এই পান্তা ভাতকেই প্রসেস করে লোকাল পানীয় হাঁড়িয়া বানানো হয়। আদিবাসীরা বলে শরীর ঠান্ডা করে৷ ছোট থেকেই দেখেছি পুরুলিয়া বা পশ্চিম মেদিনীপুরের আদিবাসী প্রজাতিরা ধানফলা ঋতুতে কাজের জন্য এদিকে আসত। কোনদিনই দেখতাম না ওরা গরম ভাত খাচ্ছে। রোজই ডিস ভর্তি পান্তা ভাত খেত৷ আবার বলতও টক পান্তা দিতে৷ আসলে ভাত একদিন এমনিই ঢাকা দিয়ে রেখে দিলে তা ফারমেন্ট হয়ে যায় অর্থাৎ গাঁজন হয়৷ এটা সব সময়ই শরীর ঠান্ডা করে। শুধু তাই নয় গরমের দিনে ঘুমও ভালো হয়৷ দক্ষিণ ভারতে মূলত তামিলনাড়ু, অন্ধ্রপ্রদেশ বা অন্যান্য উপকূলীয় এলাকার আবহাওয়া সারাবছরই গরম থাকে৷ আর ওখানে রোদের তাপও প্রখর৷ ফলে যেকোন তেল ঝাল মশলা যুক্ত খাবার সহজপাচ্য নয়। এই সমস্ত ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যের কারণেই ওখানে অল্প তেলে বা ভাপে তৈরি রান্নাগুলো মানুষ খায় এবং বর্তমানে তা জনপ্রিয়ও। ওদের সমস্ত খাবারেই সামান্য হলেও তেঁতুলের ব্যবহার আমরা লক্ষ্য করি। এর প্রধান কারণ হল, তেঁতুল হজমশক্তি বাড়ায় এছাড়াও কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে। অতিরিক্ত গরমে আমাদের যা নিত্য সমস্যার তা যদি কারও দৈনন্দিন সমস্যা হয় তার জীবন যাত্রা তো সামান্য হলেও বদলাতে হবে। ইডলিও এমনই এক খাবার৷ চাল ডালের গাঁজনকৃত কেক। যা খানিকটা বাঙালির আস্কে পিঠে বা ঢাকনি চাপা পিঠের মতো দেখতে হয়। আবার ভাপা পিঠের মতোও।
আমরা দক্ষিণ ভারত বেড়াতে গিয়ে আমি প্রথম ইডলি খেলেও ভারতবর্ষে ইডলি আমদানি হয়ে ছিল ইন্দোনেশিয়ানদের হাত ধরে। নাহ, ঠিক এমনটাও না। ভারতীয়রাই এনেছিলেন ইন্দোনেশিয়া থেকে৷ ইন্দোনেশিয়ার বালি জাভা ইত্যাদি স্থানগুলোতে ভাতের নানান ধরণের পিঠে জাতীয় খাবারের বহুল প্রচলন ছিল। আজও তা দেখতে পাওয়া যায়৷
৭ম থেকে ১৩শ খ্রীস্টাব্দে ইন্দোনেশিয়ার পালেম্বাং, সুমাত্রা ও জাভা অঞ্চল জুড়ে গড়ে ওঠা শ্রীবিজয়া সাম্রাজ্য এবং পরের মাজাপাহিত সাম্রাজ্যের সময় হিন্দু ও বৌদ্ধ প্রভাব বেশ ভালো মতোই বিস্তার লাভ করেছিল। সেই সময় ভারতীয় ব্রাহ্মণ, শিক্ষক শিল্পী থেকে শুরু করে বণিকরাও যাতায়াত শুরু করে। ঘটনাচক্রে বেশ কিছু দক্ষিণ ভারতের বহু ব্রাহ্মণ ও পুরোহিত ইন্দোনেশিয়ায় রাজদরবারে ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক দায়িত্বে নিযুক্ত হন। খুব স্বাভাবিক ভাবেই সেখানে তারা ওই দেশেরই খাবার খেতে শুরু করেন যেমনটা বাংলার মেয়ে হয়ে মহারাষ্ট্রে দীর্ঘ বসবাস আমায় বড়া পাও বা পাও ভাজি খাওয়া শিখিয়েছে৷ খাবার খাওয়াই যে শেষ কথা হয় সবসময় তা নয়, তার সাথে সংযোজন বিয়োজনও ঘটে৷ ইতিহাসবিদরা বলেন ওই পুরোহিত ব্রাহ্মণরাই নিজেদের খাদ্যাভ্যাস যেমন ওদেশের কিছু মানুষদের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছেন তেমনি ও দেশের রান্নার প্রণালীও এদেশে এসে প্রচলন করেছেন। আবার এমনটাও ভাবা হয় এই সময়কালের হিন্দু রাজারা প্রায়শই ধর্মীয় উৎসব এবং বিবাহের মতো বিশেষ অনুষ্ঠানে ভারতে আসতেন, প্রায়শই তাদের রাজকীয় রাঁধুনিদের সাথে থাকতেন। ধারণা করা হয় যে এই রাজকীয় সফরের সময় ইন্দোনেশীয় খাবার “কেডলি” ভারতে “ইডলি” নামে পরিচিত হয়ে থাকতে পারে। তবে সবটাই তো আর একই রকম হয় না নিজের মতো বলেও একটা বিষয় থেকে থাকে। ইডলিও সেরকমই ভারতীয়দের স্বাদ অনুযায়ী বানানো একটি খাবার। বিখ্যাত ইতিহাসবিদ KT Acharya তাঁর গবেষণায় উল্লেখ করেছেন ইডলির সম্ভাব্য পূর্বসূরী বা অনুরূপ খাবার হলো এই কেদলি, যা চাল ডাল কে একসাথে ফার্মেন্ট করে ভাপে বানানো হত।
আবার এনসাইক্লোপিডিয়া অফ ফুড হিস্ট্রি’ এবং ‘সিড টু সিভিলাইজেশন – দ্য স্টোরি অফ ফুড’ থেকে জানা যায় যে আরবরা হয়তো ভারতে এই খাবারটি প্রবর্তন করেছিল। ভারতে বসতি স্থাপনের পর, আরবরা মূলত হালাল খাবার এবং ভাতের বল খেত, সাথে ছিল নারকেল-ভিত্তিক চাটনি। যেমনটা ইডলির সাথে আমরা নারকেলের চাটনি খেয়ে থাকি।
ইডলির বিবর্তন ধাপে ধাপেই হয়েছে। আর ভারতের নানান গ্রন্থ সেই কথাই বলে থাকে। যেমন, শিবকোটিয়াচার্যের ৯২০ খ্রিস্টাব্দের কন্নড় ভাষার রচনা ” ভদ্দরাধনে ” -তে ” ইদ্দালীগে ” নামক খাবারের উল্লেখ রয়েছে, যা কালো ছোলার বাটা দিয়ে তৈরি। সম্ভবত ১০২৫ খ্রিস্টাব্দে প্রাচীনতম কন্নড় বিশ্বকোষ, লোকোপকার- এর লেখক দ্বিতীয় চাভুন্ডারায়া এই খাবার তৈরির বর্ণনা দিয়েছেন, কালো ছোলা বাটার মিল্কে ভিজিয়ে, মিহি পেস্টে গুঁড়ো করে এবং দই ও মশলার স্বচ্ছ জলের সাথে মিশিয়ে। প্রায় ১১৩০ খ্রিস্টাব্দে পশ্চিম চালুক্য রাজা এবং পণ্ডিত তৃতীয় সোমেশ্বর, যিনি বর্তমানে কর্ণাটকে রাজত্ব করেছিলেন, তাঁর বিশ্বকোষ, ‘মানসোল্লাসা’তে একটি ইডলির রেসিপি উল্লিখিত করেছিলেন। সংস্কৃত ভাষার এই রচনায় পদটিকে ইডরিকা হিসাবে বলা হয়েছে। এই রেসিপিই বর্তমানে কর্ণাটকে উদ্দিন ইডলি হিসেবে পরিচিত।
ইডলি মানেই যে আতপ চাল ও বিউলির ডাল মিশ্রণে তৈরি খাবার তা নয়। ইডলির নানান ভ্যারাইটি আছে। তবে আমার মনে হয় সেই সবই যুগোপযোগী এবং স্থানীয় মানুষের স্বাদ অনুযায়ী জনপ্রিয় করে তোলার প্রচেষ্টা ছাড়া আর কিছু না ৷ আমি কয়েকটি ইডলির উদাহরণ দিচ্ছি যা পড়লে মনে হবে সত্যিই এতো রকমের হয়?
১. সাদা ইডলি
সবচেয়ে প্রচলিত রূপ, তামিলনাড়ুর ঘরে ঘরে বানানো হয়। আতপ চাল ও বিউলির ডাল সামান্য মেথি সহযোগে ভিজিয়ে রেখে ফারমেন্ট করে স্টিমে তৈরি হয় এই তুলতুলে নরম ইডলি।
২. রাভা ইডলি
সুজি, দই ও বেকিং সোডা দিয়ে তৈরি এই ইডলির জন্ম কর্ণাটকের বিখ্যাত MTR রেস্টুরেন্টে। চাল-ডাল ছাড়াও ইডলি যে হয়, রাভা ইডলি তার প্রমাণ। বর্তমানে লো-কার্ব ডায়েটে এই খাবারটি বেশ জনপ্রিয়।
৩. মল্লেগে ইডলি
কর্ণাটকের এক বিশেষ রকমের ইডলি। সাধারণত কলাপাতায় মোড়ানো অবস্থায় মাটির হাঁড়িতে রান্না করা হয়। অন্য ইডলির তুলনায় এটি অনেক বেশি ফারমেন্টেড ও সুগন্ধি।
৪. সান্না
গোয়া ও কঙ্কণ অঞ্চলে জনপ্রিয়। চালের ব্যাটারে খামির তোলার জন্য কাজুর রস বা টডি ব্যবহার করা হয়। কিছুটা মিষ্টি স্বাদ যুক্ত।
৫. চিক্কি বা কুট্টি ইডলি
অন্ধ্রপ্রদেশ ও তেলেঙ্গানার গ্রাম্য সংস্করণ। আকারে ছোট, এক কামড়ে শেষ হয়। পরিবেশন করা হয় ঘি ও মশলাদার পডি দিয়ে।
৬. রাগি ইডলি
রাগি বা নাচনি দিয়ে তৈরি হয় এই স্বাস্থ্যকর ইডলি। আয়রন ও ফাইবার সমৃদ্ধ যে কারণে এটি শিশু ও ডায়াবেটিক রোগীদের জন্য আদর্শ।
৭. ওটস ইডলি
ওটস, সুজি ও দই দিয়ে তৈরি সহজপাচ্য ইডলি। হালকা ভরপেট খাবারের জন্য এটি খুবই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে শহুরে স্বাস্থ্য সচেতনদের মধ্যে।
৮. সাজগোরা ইডলি
উপবাসের দিনে খাওয়ার উপযোগী। এতে সাধারণ চালের বদলে সাজগোরা (ব্রত চাল) ব্যবহার করা হয়।
৯. চিজ ইডলি
ব্যাটারে চিজ মিশিয়ে অথবা ওপর থেকে চিজ ছড়িয়ে বেক করে পরিবেশন করা হয়। বাচ্চাদের জিভের স্বাদ অনুযায়ী এই রেসিপির উৎপত্তি ঘটেছে।
১০. সবজি ইডলি
গাজর, বিনস, ক্যাপসিকাম ইত্যাদি ছোট কুচি করে ব্যাটারে মিশিয়ে তৈরি হয়। রঙিন, পুষ্টিকর ও আকর্ষণীয়ও।
১১. স্প্রাউটেড ইডলি
অঙ্কুরিত মুগ বা মটর মিশিয়ে ইডলি বানানো হয়, যাতে প্রোটিনের পরিমাণ বেশি হয়।
১২. কোয়িনোয়া ইডলি
গ্লুটেন-ফ্রি ও উচ্চ প্রোটিনসমৃদ্ধ কোয়িনোয়া দিয়ে তৈরি এই ইডলি ডায়েট সচেতনদের মধ্যে জনপ্রিয়।
১৩. পনির ইডলি
ব্যাটারে কুচানো পনির মিশিয়ে বানানো হয়। ওপরেও পনির ছড়িয়ে পরিবেশন করা হয়। রিচ ও ক্রিমি স্বাদ।
১৪. মাঞ্চুরিয়ান ইডলি
ভাজা ইডলিকে চাইনিজ মসলা ও সস দিয়ে টস করা হয়। একেবারে ফিউশন ফুড—চাইনিজ-দক্ষিণ ভারতীয় মিশ্রণ।
১৫. পিজ্জা ইডলি
ইডলি ব্যাটারে চিজ, ক্যাপসিকাম, ওরেগানো ইত্যাদি দিয়ে ওভেনে বেক করে তৈরি করা হয়। একরকম ক্ষুদ্র পিজ্জা ইডলি।
১৬. চকোলেট ইডলি
মিষ্টি স্বাদের ব্যাটারে কোকো বা চকোলেট চিপস মিশিয়ে তৈরি হয়। এটি সাধারণত ডেজার্ট হিসেবে পরিবেশিত হয়।
১৭. ইডলি চাট
কিউব করে কাটা ইডলি দই, তেঁতুল চাটনি, সেভ দিয়ে সাজিয়ে চাটের মতো পরিবেশন করা হয়। অবশিষ্ট ইডলি ব্যবহার করে এক অভিনব স্ন্যাকস।
১৮. ফ্রায়েড ইডলি
একদিন আগের বেঁচে যাওয়া ইডলিকে ছোট টুকরো করে ভেজে মশলা মিশিয়ে পরিবেশন করা হয়। চটপটে স্ন্যাকস। এটা কারিপাতা, কালো সরষে এবং পেঁয়াজের মশলাতেও যেমন ভালো লাগে, তেমনই টম্যাটো সস, সয়া সস পেঁয়াজ ক্যাপসিকাম আদা রসুন ও লংকা পেস্টের সাথেও জমে যায়।
১৯. পোডি ইডলি
ইডলির সঙ্গে দক্ষিণ ভারতের বিখ্যাত ড্রাই চাটনি পাউডার বা ‘পোডি’ এবং ঘি মিশিয়ে পরিবেশন করা হয়।
২০. কুজি/পনিয়রম ইডলি
ছোট ছোট গোল বলের মতো ইডলি, যা পনিয়রম প্যানে তৈরি হয়। ভেতরে নারকেল বা মিষ্টি পুরও থাকতে পারে।
ইডলি যেভাবেই দক্ষিণভারতে আসুক। আজ কিন্তু সারা ভারতের ব্রেকফাস্ট টেবিলে দেখা যায়। আর স্বাস্থ্য সচেতন মানুষদের মধ্যে তো আরই বেশি দেখা যায়৷ বাঙালিরা আবার মাংসের ঝোলের সাথেও ইডলি খেয়ে থাকে। হয়তো কিছুদিন পর দেখব ইডলির পোস্তও বানানো হচ্ছে।
আসলে খাবারের বিস্তার হাওয়ার গতিতে ঘটে আর রূপান্তর ঘটে মনের গতিতে। খাবারের প্রতি আগ্রহ আমায় যে কত কিই শিখিয়ে চলেছে প্রতিমুহূর্তে তা আমি নিজেও আন্দাজ করতে পারি না। লিখতে না বসলে হয়তো এটাও জানতাম না আমি খাবারের প্রতি রান্না ঘরের বাইরেও এভাবে আগ্রহী। কলমের অদ্ভুত গুণ মানুষকে ক্রমশ উন্নত করে তোলে। আজ সে সব বেশ বুঝি।