কর্ণফুলির গল্প বলা সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে নুসরাত রীপা (পর্ব – ২)

কখনো এমনও হয়

৩)
এইচ এস সি পরীক্ষার পর ভার্সিটি ভর্তি কোচিং করতে রাফিয়া ঢাকা চলে আসে। বড় ভাই এর বাসায় থেকে শুরু হয় ওর ঢাকার জীবন।

লেখালেখির নেশাটা পলককে এভাবে জড়িয়ে ধরেছিলো যে এটা ছাড়া বেঁচে থাকা পলক কল্পনাও করতে পারতো না।

শহর পলক কে টানে না। সবাই যখন শহরে ছোটে সে তখন গ্রামের কলেজেই ভর্তি হয়। বাবা, মা, ভাইদের কথা উপেক্ষা করে। ও ছাত্র ভালো ছিল, অনায়াসে ডাক্তার,ইঞ্জিনিয়ার হতে পারতো কিন্তু কবিতার নেশা এমনই নেশা যে একবার এ নেশায় আসক্ত হয় তার কাছে রাজসিংহা সনও অতি তুচ্ছ। হীরা-মনি-মানিক্য সে নির্দ্বিধায় পদদলিত করতে পারে আর ডাক্তার,,ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার হাতছানিকে অবহেলা করা তো খুব সাধারণ একটা ব্যাপার।

পলকের কবিতা তখন জাতীয় দৈনিকে ছাপা তো হয়ই বিশেষ সংখ্যাগুলোতে বড় বড় লেখকদের পাশে ও ছাপা হতে শুরু করেছে।

রাফিয়া শহরে থাকে। তখনও ফেসবুক আসেনি। মোবাইল অবশ্য ছিল। কিন্তু চিরকালের ভীতু আর লাজুক পলক লজ্জা আর ভয়ের দেয়ালটা ভেঙে রাফিয়ার কাছে ফোন নম্বরটা চেয়ে নিতে পারে নি। ওদের দেখা-কথা হতো কালে-ভদ্রে ঈদ-পার্বণে রাফিয়া কখনো এলে।
রাফিয়া পলককে কবিতার কথা জিজ্ঞেস করলে ভীষণ ভালো লাগতো পলকের। একই সাথে লজ্জাও পেত। কারণ তার সমস্ত কবিতার পেছনে যে অস্পষ্ট এক মানবীর ছায়া সে আর কেউ নয়, রাফিয়া।
রাফিয়া যদিও ঘুনাক্ষরে ও তা জানতো না কিন্তু পলক ভাবতো তার সমস্ত লেখাই বুঝি রাফিয়া সংগ্রহ করে পড়ে! রাফিয়া অনেক বই-ম্যাগাজিন পড়ে যদিও কবিতার অংশটুকু নিরবে এড়িয়ে যায় তবুও একবার ঐ একবারই এক ঈদ সংখ্যায় পলকের একটা কবিতা চোখে পড়ে যায়। পরে দেখা হলে, রাফিয়া পলকের লেখাটার ব্যাপারে কথা বললে
পলকের ধারণা আরো বদ্ধমূল হয় যে,রাফিয়া তার সব লেখা পড়ে!

তার লেখার গতি আরো দ্রুত হয়ে ওঠে।
মনের গভীরে রাফিয়ার জন্য অসীম প্রেম ক্রমশ বেড়ে বেড়ে বিশাল ক্যানভাসের এক ছবি হয়ে উঠতে থাকে।

তবে ঢাকা আর দুলালপুর কোনই পার্থক্য নেই রাফিয়ার কাছে। হয় পড়ার বই নয় গল্পের বই এর ভেতর ডুব মেরে দিন কাটতে থাকে।

অনেক কথা বুকের ভেতর কিলবিল করে। আর সে কথা শোনার জন্য স্রষ্টা ইফতিকে পাঠিয়ে দেন রাফির জীবনে! অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী ইফতির সাথে পড়া অবস্থাতেই বিয়ে করে দেশ ছাড়ে রাফি।

ততদিন পলক কোথায় মনের কোন কোণে চলে গেছে! অস্পষ্ট,জুবুথুবু,ঝাপসা—

৪)
কিন্তু রাফিয়ার ইফতির সাথে বিয়ে হয়ে যাওয়ার খবর শোনার পর হঠাৎ করেই কবিতা লেখা থেমে যায় পলকের। আসলে কবিতা লেখার জন্য কবির একজন মানসী থাকে। পলকের মানসী ছিলো রাফিয়া। মনের দৃষ্টি যতদূর মেলে রাফিয়াকে পলক আর কোথাও খুঁজে পায় না, ও আর কবিতা লিখতেও পারে না আর লেখার আগ্রহ ও হয় না।

পলক কবিতা লেখা ছেড়ে দেয়। কিছুদিন উদভ্রান্ত্রের মতো ঘুরে বেড়ায়। পলকের বাবা অনিল চৌধুরী ততদিনে রিটায়ার্ড করেছেন। পলক তার সবচে আদরের ছোট সন্তান। তাকে এমন ভবঘুরে দেখে পৃথিবী ছাড়তে হবে ভেবে তিনি কেঁদে আকূল হন।

পলক পড়াশুনো ছেড়ে দেয়। একটা কথা বললে আরেকটা জবাব দেয়। ওর মনের ভেতর অণুক্ষণ কেবল রাফিয়া। পলক জানে, বোঝে রাফিয়াকে ও কোনোদিনই নিজের করে পেত না। প্রথমত ধর্মীয় ব্যবধান। রাফিয়া কট্টর মুসলিম বাড়ির মেয়ে। আর পলক ও কখনোই নিজের বাবা মা কে ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যাবার মতো শক্ত মনের ছিল না। এই সত্য টুকু গভীর। ভাবে উপলব্ধি করা সত্ত্বেও রাফিয়ার জন্য ভীষণ কষ্ট হতো পলকের। না পাওয়ার হাহাকারে হৃদয় মন পুড়ে চলছিল অবিরাম।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।