কর্ণফুলির গল্প বলায় নুসরাত রীপা

এক সন্ধ্যায়

অফিস থেকে বেরোতেই আটটা বেজে গেল তামান্নার। রাস্তার জ্যাম দেখে চক্ষু চড়কগাছ। পিঁপড়ার মতো সারি সারি গাড়ি, রিক্সা,ভ্যান, প্রাইভেট কার রাস্তায়। তার মধ্য শত শত পথচারী এইসব যানবাহনের মধ্য দিয়ে এই গাড়ির পেছন দিয়ে, ওই বাসের সামনে দিয়ে, সিএনজির গা ঠেলে বিভিন্ন কসরৎ করে নানা ফাঁক ফোকর গলিয়ে একজন আরেকজনকে ওভারটেক করে আপন গন্তব্যে ছুটছে। কারো জন্য কারো অপেক্ষা করার সময় নেই।অন্যের সুবিধা অসুবিধা দেখার সুযোগ নেই। কেবল ছুটে চলা।
এই জ্যাম ঠেলে মতিঝিল থেকে মিরপুর যাওয়া আসা করাটা যে কী দুরূহ যন্ত্রণার সেটা জানে ভুক্তভোগী। অবশ্য মেট্রোরেলটা হয়ে গেলে এই কষ্টের পরিসমাপ্তি হবে। সেই আশাতেই আছে তামান্না এবং তামান্নার মতো আরো অসংখ্য কর্মজীবি নারী পুরুষ।
কত ছোট একটা জীবন তার মধ্যে মাত্র চব্বিশ ঘন্টার একটা দিনে যদি আসা যাওয়ার জন্য পথেই চার পাঁচ ঘন্টা কেটে যায় তাহলে সময়ের কত অপচয়!
তামান্না অনেকটুকু রাস্তা পেরিয়ে গুলিস্তানের সামনে থেকে রীতিমতো যুদ্ধ করে একটা পাবলিক বাসে উঠলো। বাসে প্রচন্ড ভিড়। লোকজন ঠাসাঠাসি করে দাঁড়িয়ে আছে। এখন যে করোনা কাল সেটা কাউকে দেখে বোঝার উপায় নাই। মানুষের যে খানিকটা ডিসট্যান্স মেনটেন করে দাঁড়ানো উচিত সে ব্যাপারেও কারো মাথা ব্যথা আছে বলে মনে হয় না। বেশির ভাগেরই মাস্ক নেই। অনেকের মাস্ক গলায় ঝুলছে।
করোনার ভয় ছাড়াও এরকম ভিড় বাসে ধাক্কাধাক্কি করতে তামান্নার ভালো লাগে না। কিন্তু এই বাসে না উঠলে পরেরটায় যে আরাম করে যাওয়া যাবে তার তো কোনো নিশ্চয়তা নাই। আর মতিঝিল থেকে মিরপুর সিএনজি ভাড়া করে যেতে গেলে কম করে হলেও চার-সাড়ে চারশ টাকা লেগে যাবে। অযথা এতগুলো টাকা দিতে বুকে লাগে!
বাসে লোক ভর্তি হলেও মেয়েদের সংরক্ষিত আসনের একজন জিরো পয়েন্টের কাছে নেমে গেলে তামান্না বসার সিট পেয়ে গেল।
ঘড়ি দেখলো তামান্না। এই জ্যাম ঠেলে বাসায় পৌঁছাতে কটা বাজবে কে জানে?
বাসায় বাচ্চারা ওদের দাদীর কাছে থাকে।তামান্নার শ্বাশুড়িরও বয়স হয়েছে। উনার নিজেরই এখন যত্ন আত্তির প্রয়োজন।আট সন্তানের মধ্যে তামান্নার বর রফিক সবার ছোট। ছোট ছেলের আবদার ফেলতে পারেন না বলে রফিকের এখানে গত ছয়মাস ধরে আছেন।
করোনা কাল, স্কুল বন্ধ। শ্বাশুড়ি বাসায় থাকায় বাচ্চাদের জন্য কম চিন্তা করতে হয় তামান্নাকে। কিন্তু কাজ তো বেশি।
সকালে নাস্তা আর দুপুরের খাবার রান্না করে রেখে আসে তামান্না। এছাড়া বৃদ্ধা শ্বাশুড়ির জন্য আর বাচ্চাদের জন্য হরলিকস বানিয়ে ফ্লাস্কে রেখে আসে। ফল কেটে কনটেইনারে করে ফ্রিজে রেখে আসে। রাতের খাবারটা ফিরেই রান্না করে। যেহেতু রফিক দিনে বাইরে খায় তামান্না তাই রাতের খাবারে অন্য কিছুর পাশে রফিকের কোনো প্রিয় পদ করে!ভালোবাসার মানুষকে কষ্ট করে খাইয়েও সুখ যে!
রফিক লাঞ্চ নেয় না। অফিস ক্যান্টিনে খেয়ে নেয়। তামান্না অবশ্য বাসা থেকেই খাবার নিয়ে যায়। বাইরে খেলে খরচ বেশি হয়। পুরো সংসারের ভার যখন তামান্নার হাতে তখন ওকে তো হিসেবী হতেই হয়।
রফিক খুব ছোট একটা অফিসে কাজ করে। এক্সিকিউটিভ অফিসার । সেলারি বেশি নয়। চাকরি বাকরি না করলে বাজে দেখায় তাই চাকরি করে। নইলে তো সে ভবঘুরে জীবনই কাটাতো! বিয়েটা যে কেন করলো- মাঝে মাঝেই সে তামান্নাকে একথা বলে।
সংসার মূলত তামান্নার টাকাতেই চলে। তামান্না একটা বেসরকারী কোম্পানীতে বেশ ভালো পোস্টে আছে। ভালো মাইনে। কিন্তু এজন্য পরিশ্রম ও করতে হয় দ্বিগুন।
ছাত্র জীবনে কবিতা পড়ে মুগ্ধ হয়ে রফিক কে ভালোবেসেছিল । সে সময় রফিকের ছন্নছাড়া উদাসীনতাই বেশি আকর্ষণ করতো। যদিও বিয়ের পর ভুল ভেঙেছে। কিন্তু মেনে নেয়া ছাড়া উপায় কী! আর রফিক যদি কবিতা লিখে খুব নাম করে তাহলে তামান্নার চাইতে সুখী আর বেশি হয় কে!
সাড়ে নটা বেজে গেছে। বাস এখনো শ্যামলী পেরোয় নি। রফিক বাসায় ফিরেছে কী না জানতে তামান্না রফিকের মোবাইলে কল দিল। ফোন সুইচড অফ। বাসায় ফোন দিল। বড় মেয়ে টুকটুকি ফোন রিসিভ করলো, না, বাবা আসে নি। দিদা নামাজ পড়ে। আমি আর ঝুমঝুমি খেলা করছি। তুমি কখন আসবে মা? ক্ষিদে পেয়েছে।
বয়ামে বিস্কিট আছে। নামিয়ে খাও। আমি খাবার কিনে আনবো।
ফোন নামিয়ে রাখে তামান্না। ভেবেছিল রফিককে বলবে খাবারটা কিনে নিয়ে যেতে। বাসায় ফিরে রান্না করে খেতে গেলে রাত দুটোই হয়তো বেজে যাবে। কিন্তু রফিক ফোন না ধরাতে তামান্না শ্যামলীতেই নেমে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। রাত বেশি হলে দোকানেও ভালো খাবার পাওয়া যাবে না। তারচে শ্যামলীতে পরিচত খুব ভালো একটা রেস্টুরেন্ট আছে ওখান থেকে খাবার কিনে নেবে।
নিজস্ব একটা ফ্ল্যাটের বড় সখ তামান্নার। কিন্তু টাকা সঞ্চয় করা হয় না কোনোমতেই । রফিক যা ইনকাম করে তা প্রায় পুরোটাই বই পত্রপত্রিকা কিনে আর বেড়িয়ে খরচ করে। তামান্নার হাতে বাজার খরচ হিসেবে চার পাঁচ হাজার টাকা দেয় অবশ্য। কিন্তু আজকালকার দিনে পাঁচ ছয়জনের সংসারে পাঁচ হাজার টাকার বাজারে তো সপ্তাহই যায় কোনো মতে।
বাস থেকে নেমে ফুটপাত দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে দুপাশে নির্মিততব্য সুউচ্চ ভবন গুলি দেখতে দেখতে ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো তামান্না। কেমন প্রাইজ হবে কে জানে! ওর কলিগ মেহনাজ একটা বুকিং দিয়েছে রুপনগরে। দাম টা জানতে হবে। একটা স্থায়ী ঠিকানার দরকার আছে। বাচ্চারাও বড় হচ্ছে তো!
রফিকটা ভালোবাসাবাসিতে যতটা সিরিয়াস সাংসারিক ব্যাপারে যদি তার সিকিভাগও হতো কোন কষ্টই আর তামান্নার গায়ে লাগতো না।
রাস্তা পেরিয়ে কাঙ্খিত রেস্টুরেন্টটার ভেতর ঢোকার আগ মুহূর্তে থেমে গেল তামান্না। দোকান আর বিলবোর্ডের ঝলমলে আলোর নিচে হাস্যজ্বল একজোড়া নারী পুরুষের দিকে চোখ আটকে গেছে ওর। মেয়েটি ভারী সুন্দর। ওয়েস্টার্ন পোশাক পরেছে। মানিয়েছেও বেশ। মাস্ক টা থুতনির নিচে ঝুলছে!
পরস্পরের হাত ধরে অনুরাগে ভেসে কথা বলতে বলতে হেঁটে যাচ্ছে জুটিটা। কতটা গভীর প্রেম থাকলে নারী পুরুষের এমন আচরণ হয় তা কেবল যে প্রেম করেছে সেই বুঝতে পারে।
স্তম্ভিত তামান্না লোকারণ্যে অপসৃয়মান জুটিটির দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করলো, রফিক!
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।