গল্পবাজে মুহাম্মদ সেলিম রেজা

দ‍্য গ্রেট মদনদা

নলিনী দাদু চা শেষ করে পেয়ালাটা টেবিলের উপর রেখে বললেন, ওহে মদন আজ তোমার ওই পুলিশের তাড়া খাওয়ার গল্পটা শোনাও।
বৌদি দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে আমাদের কথোপকথন শুনছিলেন। দাদুর কথা শুনে বললেন, আপনার বন্ধু জীবনে কোন কাজটা করতে বাকি রেখেছে বলবেন দাদা?
– মন্দ কথা বলোনি বৌঠান? মদন জীবনে কী করেনি সেটা রীতিমতো গবেষণার বিষয়। এ রকম ক‍্যারেক্টার হাজারে একটা-দু’টো মেলে। লেখার হাত থাকত যদি মদনকে নিয়ে লিখতাম আমি। তারপর হঠাৎ আমাকে উদ্দেশ‍্য করে বললেন, তুমিতো অনেক লেখাপড়া করেছ হে। চেষ্টা করে দেখ, মহাকাব‍্য না হোক পাঁচালি ধাঁচের কিছু করা যায় কিনা?
কলেজে পড়ার সময় নব‍্যতা ঢালি নামে একটি মেয়েকে পছন্দ করতাম। মুখেফুটে ভালো লাগার কথা তাকে বলতে পারিনি, অথচ কত কথা বলার ছিল। সেইসব না বলা কথা কবিতার আকারে ডায়েরিতে লিখে রেখেছি। তা বলে মদনদার মতো একটি মিসটেরিয়াস চরিত্র নিয়ে লেখা? উরিব্বাস! এ আমার দ্বারা হবে না। পত্রপাঠ দাদুর প্রস্তাব প‍্রত‍্যাখ‍্যান করে বললাম, চাইলেই কী আর লেখা যায় দাদু? নজরুল-শরৎচন্দ্র কলেজ-বিশ্ববিদ‍্যালয়ের ধারেকাছে না গিয়েও কালজয়ী সাহিত‍্য রচনা করেছেন। এমন নয় যে সে সময় উচ্চশিক্ষিত মানুষের অভাব ছিল। আসল হল প্রতিভা। প্রতিভা না থাকলে….
আমার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে মদনদা সোৎসাহে বললেন, খাঁটি কথা বলেছ ভায়া প্রতিভা না থাকলে লেখালেখি হয় না। আমি এক সময় কবিতার প্রেমে পড়েছিলাম। তখন….
– কে কবিতা? মদনদাকে মাঝপথে থামিয়ে দিলেন বৌদি।
– কে আবার! ওই যে গো…..
– জীবনে কত মেয়ের লাথি-ঝাঁটা খেয়েছ শুনি?
– মেয়ে! কবিতা মেয়ে হতে যাবে কেন? এই কবিতা হল গিয়ে কবি-রা যা লেখে। ছড়া, পোয়েম।
– আমি ভেবেছিলাম…..
– ভাববেই তো। সারা জাহানের ভাবনার ঠিকাদারি নিয়ে রেখেছ যখন। সাধে কী আর বলি মেয়েমানুষের হাঁটুতে বুদ্ধি।
– এই মেয়েমানুষ মেয়েমানুষ করবে না। পুরুষ হয়ে কোন মহান কাজটি করেছ শুনি?
– পৃথিবীতে বউ সামলানোর থেকে মহান কাজ কিছু আছে নাকি? তাও আবার তোমার মতো একটি….।
– বলো বলো আমার মতো কী? কপাল মন্দ তাই….। বৌদি রাগে দুঃখে কথা অসমাপ্ত রেখে আঁচলে মুখ ঢেকে ফোঁস ফোঁস করতে লাগলেন।
নলিনি দাদু চুপ করে বসে বুড়োবুড়ির তরজা উপভোগ করছিলেন। এক্ষণে পরিস্থিতি ঘোরাল হয়ে উঠছে উপলব্ধি করে যুযুধান উভয়পক্ষকে প্রতিহত করে বললেন, তোমরা কী চাও না আমরা এখানে আসি?
– তা কেন হবে দাদা! আর্তনাদ করে উঠলেন বৌদি। পরক্ষণে মদনদা অহত কন্ঠে বললেন, বড় ব‍্যাথা দিলে হে নলিনী। এমন কথা শুনতে হবে আশা করিনি, তাও আবার তোমার মুখ থেকে।
– আমি ও বলতে চাইনি ভায়া। কিন্তু রোজ রোজ তোমাদের তর্জা ভাল্লাগে না।
– তর্জা! রঙ্গ-রসিকতাকে তুমি তর্জা বলছ? একটু থেমে মদনদা পুনরায় বলতে থাকলেন, আসলে কী জান নলিনী, আমাদের এই বিরান সংসারে সুখ বলতে বুড়োবুড়ির প্রেম ছাড়াতো কিছুই নেই। তাই সূযোগ পেলেই আমরা পরস্পরকে নিয়ে একটু-আধটু….। যাগ্গে কী যেন বলছিলে? ও হ‍্যাঁ আমি জীবনে কী করিনি।
– ও কথা আজ থাক মদন। সেদিন ঠিক কী ঘটেছিল বল? কেউ বলে পুলিশ ঘার ধরে পুকুরের জলে চুবিয়েছিল। আবার কেউ কেউ বলে মারের চোটে তুমি কাপড় নোংরা করে ফেলেছিলে। তাই ধুতি ফেলে….।
একথা শুনে নিজেকে কন্ট্রোল করা গেল না, ফিক করে হেসে দিলাম। অমনি মদনদা ফোঁস করে উঠলেন, হাসছিস কেন আহাম্মক? আমি কী ন‍্যাংটো হয়ে….। রীতিমতো আণ্ডারওয়ার ছিল পরনে।
– আণ্ডারওয়ার! হি হি হি। আপনার লজ্জা করল না?
আত্মপক্ষ সমর্থন করে মদনদা বললেন, ব‍্যাটাছেলের আবার লজ্জা কিসের? তাছাড়া তখন মাঝরাত, ন‍্যাংটো হয়ে ঘুরলেও দেখার কেউ ছিল না।
– মেনে নিলাম কেউ তোমাকে দেখেনি। কিন্তু কেন তোমাক ওইভাবে পথে নামতে হল? নলিনী দাদুর জিজ্ঞাসার উত্তরে মদনদা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, ঠ‍্যালায় না পড়লে কী আর বিড়াল গাছে ওঠে?
অতঃপর ক্ষণেকর জন‍্য থেমে স্বভাবসিদ্ধ ঢঙে গলা পরিস্কার করে নিয়ে বলতে থাকলেন, সে একটা রাত গেছে বুঝলে নলিনী। পুলিশের লোক চারদিক থেকে বাড়িটাকে ঘিরে ধরেছে। পালাবার পথ না পেয়ে একে একে সবাই পুকুরে ঝাঁপিয়ে দিচ্ছে।
– তুমিও!
– না ঝাঁপিয়ে উপায় ছিল না হে। জুয়া খেলতে গিয়ে পুলিশের হাতে ধরা পড়লে বাবা জ‍্যান্ত পুঁতে ফেলতেন।
বৌদি অনেকক্ষণ মুখে কুলুপ এঁটে বসে রয়েছেন। এক্ষণে তিনি একরাশ ঘৃণা উগরে দিয়ে বললেন, তোমার জুয়াখেলার নেশাও আছে? ছিঃ ছিঃ!
– তুমি যা ভাবছ ঘটনা তা নয় গিন্নি। সে রাতে আমি ভাড়ায় খেলতে গিয়েছিলাম।
– আমাদের সময় ফুটবল, ভলিবল খেলার জন‍্য প্লেয়ার হায়ার করা হত। আজকাল পাড়ার ক্রিকেট টুর্ণামেন্টগুলো ও হায়ার করা প্লেয়ার দিয়ে হচ্ছে। কিন্তু ভাড়ায় জুয়া খেলার কথা জীবনে এই প্রথম শুনলাম। সত‍্যি মদন, য়ু আর গ্রেট।
মদনদা স্মিত হেসে টেবিল থেকে গ্লাস টেনে নিয়ে ঢকঢক করে খানিকটা জল পান করলেন। তারপর বললেন, জানইতো তাস খেলায় আমার যথেষ্ট নামডাক আছে। বিশেষ করে ব্রিজ, টুয়েন্টি নাইন আর ফ্লাস খেলার মাস্টার ছিলাম। দক্ষতাই বলো কিংবা ইশ্বরপ্রদত্ত বিশেষ গুণ, বার দুই ঘাটাঘাটির পর উল্টোদিক থেকে বলে দিতে পারি প্রতিপক্ষের হাতে কি কার্ড আছে।
– তাই কখনও সম্ভব! বিস্মিত না হয়ে পারলাম না আমি।
দাদু বললেন, অবাক হচ্ছো কেন পেঁচো? নিশা নামে একজন জেলে ছিলেন মিত্রপুর গ্রামে। তিনি জলের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারতেন পুকুরের কোথায় মাছে জড়ো হয়ে আছে। সেখানে পিছনদিক থেকে তাস চেনা এমন কি কঠিন কাজ?
দাদুর কথায় দ্বিগুণ উৎসাহিত হয়ে মদনদা যা বললেন তা মুটামুটি এইরকম। অখিলেশ নামে দাদার একবন্ধুর জুয়া খেলার নেশা ছিল। এলাকার যেখানে জুয়ার আসর বসত সেখানেই তিনি হাজির হতেন। দুর্ভাগ্যের বিষয় খেলায় তাঁর জেতার রেকর্ড নেই। তবু কোনদিন ভাগ‍্য ফেরে এই আশায় জমি-জায়গা বেচে খেলা চালিয়ে যেতে থাকেন তিনি। সেই লোকটা একদিন তাঁর হয়ে খেলার আমন্ত্রণ জানালে দাদা সানন্দে রাজি হয়ে যান।
আসর বসেছিল ভাগোল গ্রামের সাগর মণ্ডলের বাড়িতে। জঙ্গীপুর, ফারাক্কা, মালদা থেকে বড় বড় মালদার পার্টি সেদিন খেলতে এসেছিলেন। দাদা তাদের সাথে সমানে টক্কর দিচ্ছিলেন। জিতেও ছিলেন দু’-দু’টো বাজি। তৃতীয়বার জিত প্রায় হাতের মুঠোয় চলে এসেছ এমনসময় পুলিশ বাড়ি ঘিরে ফেলেছে খবর পেয়ে টাকা পয়সা ফেলে রেখে সবাই দে ছুট।
পুলিশ তিনদিক থেকে বাড়ি ঘিরে রেখেছে। দক্ষিণ দিকে রয়েছে একটা বড়পুকুর। তারওপর পুলিশ যাকে নাগালে পাচ্ছে তাকেই কুকুর পেটা করছে। অগত‍্যা পালাবার পথ না পেয়ে একে একে সকলে পুকুরে ঝাঁপ দেয়। মদনদা ও ঝাঁপিয়ে ছিলেন, যদিও ঝাঁপানোর মুহূর্তে পুলিশের লাঠি দাদার পিঠ চুম্বন করতে কার্পণ্য করেনি। এতদিন বাদে সে কথা স্মরণ করে দাদা একপ্রস্থ হাত বুলিয়ে নিলেন পিঠে।
– বেশ হয়েছে! যেমন কর্ম তেমনি ফল। আমি সেখানে থাকলে আর ক’ঘা দিতে বলতাম।
খোঁচা খেয়ে ভুরু কুঁচকে বৌদির দিকে তাকালেন মদনদা। ভেবেছিলাম বুড়ো-বুড়ি ফের বাকযুদ্ধে অবতীর্ণ হবেন। কিন্তু দাদা কটুক্তি গায়ে মাখলেন না। যেমন বলছিলেন বলতেই থাকলেন, মাঘ মাসের হিমশীতল রাত, এমনিতেই হাত-পা জমে যাবার জোগাড়। তারওপর সোয়েটার-চাদর জলে ভিজে গায়ে চেপে বসেছে। কয়েক মিনিটের মধ‍্যে হাত-পা অবশ হয়ে এল। ওদিকে ধুতি পায়ে জড়িয়ে গিয়েছে, সাঁতর দিতে পারছি না। প্রাণ বাঁচাতে ধুতি-চাদর-সোয়েটার সব খুলে ফেলে দিলাম।
– তারপর! তারপর কী হল?
– কোনরকমে সাঁতরে পাড়ে উঠলাম। ঠকঠক করে গোটা শরীর কাঁপছে, ঠিকভাবে দাঁড়িয়েও থাকতে পারছি না। পুলিশের টর্চ লাইটের জোড়াল আলো ঘুরতে ঘুরতে আমার উপর পড়তে ধর ধর চিৎকার করে উঠল ওরা।
থামলেন দাদা। দম নিয়ে আবারও বলতে লাগলেন, কি বলব দুঃখের কথা। তাড়া খেয়ে ছুটতে শুরু করলাম। আলপগার ডিঙিয়ে হোচট খেতে খেতে ছুটে চলেছি। কোথায় যাচ্ছি, কোন দিকে যাচ্ছি অন্ধকারে কিছুই বুঝতে পারছি না। একটা কথাই তখন মাথায় খেলা করছিল, পালাতে হবে।
পুব আকাশ একটু ফর্সা হতে দূরে একটি গ্রাম চোখে পড়ল। কোন গ্রাম, কাদের বাস কিছুই জানি না। আশ্রয় চাই, গরম বস্ত্র চাই। গ্রামে পৌঁছে একটা বাড়ির দরজায় ধাক্কা দিলাম। অনেক চেষ্টাচরিত্র করার পর এক পৌঢ় দরজা খুলে বাইরে এলেন। প্রথমত তিনি আমাকে দেখে চিৎকার করে উঠেছিলেন। পরক্ষণে সামলে নিয়ে বলেন, তুমি জমিদার বাড়ির খোকা না?
আমি তখন কথা বলার অবস্থায় ছিলাম না। সর্বশক্তি প্রয়োগ করে চিৎকার দিলাম – পু…পু… পু…পু…
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।