গল্পবাজে মুহাম্মদ সেলিম রেজা

শিকারী মদনদা

সেদিন মদনদার বাড়ি গিয়ে, এঘর ওঘর করে খুঁজে না পেয়ে ঠাকুর ঘরে উঁকি মেরে দেখি বৌদি পুজোয় বসেছেন। দাদা কোথায় জিজ্ঞাসা করলে তিনি ক্রিকেট আম্পায়ারের আউট সিগন্যাল দেওয়ার মতো তর্জনী খাড়া করে বাতাস খোঁচাতে শুরু করলেন।
অনুমান করে বললাম, ছাদে আছেন?
উত্তরে বৌদি স্বভাবসিদ্ধ মিস্টি হাসি ছুড়ে দিয়ে ঘাড় কাত করলেন। অর্থাৎ আমার অনুমান সত্য, দাদা ছাদে আছেন।

এই ঠা ঠা রোদে তিনি সেখানে কী করছেন? এবারেও বৌদি নিরুত্তর। তাঁর ডানহাতটা ডিজেল ইঞ্জিনের পিস্টনের মতো কপাল আর বুক করতে থাকল।

আপনি কী মৌনব্রত পালন করেছেন? আন্দাজে গুলি চালিয়ে দিলাম। বৌদি ডানদিকে মাথা কাত করে ফিক করে হেসে দিলেন।
তাঁকে আর বিরক্ত না করে দু’-লাফে ছাদে চলে এলাম। কে জানত সেখানেও আমার জন্য একরাশ বিস্ময় অপেক্ষা করছে! খালি গায়ে মেঝেয় পাছা পেরে বসে রয়েছেন মদনদা, পরনের লুঙ্গিখানা হাঁটুর উপরে তোলা। পা দু’খানা সম্মুখপানে ছড়িয়ে দিয়ে খানকতক লোহালক্কর নিয়ে একমনে ঘাঁটাঘাটি করছেন।
ক’দিন গ্রামে ছিলাম না। এর মধ্যে এমন কি সমস্যা দেখা দিল বুড়ো-বুড়ির সংসারে যে, একজন মৌনব্রত নিয়ে ঠাকুরের পায়ে হত্যে দিয়ে পড়ে আছেন? আর একজন চৈত্রের ধুপ রোদে ছাদে বসে কঠোর সাধনায় মগ্ন?
একবুক কৌতুহল নিয়ে কাছে গিয়ে দেখি, দূর থেকে যেগুলোকে সামান্য লোহালক্কর মনে হয়েছিল আসলে তা এক একটি যন্ত্র। দাদার হাতে রয়েছে একটি আদ্যিকালের জং ধরা পিস্তল। দুই পায়ের ফাঁকে একটি করে স্ক্রু ড্রাইভার, প্লাস, হাতুড়ি। পাশাপাশি একটি অ্যালুমিনিয়ামের বাটিতে খানিকটা সর্ষের তেল। একদলা রঙিন সুতির কাপড়, সম্ভবত বৌদির ব্যবহার করা পুরোনো শাড়ির ছেড়া অংশ।
পিস্তল নামক ভয়ংকর বস্তুটির সাথে কোনকালেই আমার সখ্যতা ছিল না। সিনেমার পর্দায় পিস্তল হাতে হিরো ভারসেস ভিলেনের লড়াই দেখেছি। আর দেখেছি পুলিশ অফিসারদের কোমরের বেল্টের সাথে চামড়ার কেসে বন্দি অবস্থায় বাদুরের মতো ঝুলে থাকতে। চর্ম চোখে কাছ থেকে অবলোকন করা এই প্রথম।

দেখ দেখিনি পেঁচো এটা ভাঙতে পারিস কি না।
সামনাসামনি হতে মদনদা যন্ত্রটা আমার হাতে ধরিয়ে দিতে পিলে চমকে উঠল। মরা সাপের কাঁটাতেও বিষ থাকে! এটাও যে কোন অঘটন ঘটিয়ে ছাড়বে না এমন কথা কে বলতে পারে! ভয়ে ভয়ে বললাম, কিছু হবে না তো?
একথা শুনে দাদা এমন করে আমার দিকে তাকালেন, যেন আমি প্রাগৈতিহাসিক যুগের অদ্ভুতদর্শন লুপ্তপ্রাণী, পুনর্জীবিত হয়ে তাঁর সামনে আবির্ভুত হয়েছি। ঘাবড়ে গিয়ে শুয়োপোকার মতো গুটিয়ে গেলাম। বিরক্ত হয়ে তিনি আমার হাত থেকে পিস্তলখানা ছো মেরে তুলে নিয়ে বললেন, ভাগ শ্লা অনামুখো।
আমি অনামুখো! আমার মুখ দেখলে অমঙ্গল হয়? এতবড় অপবাদ! অপমানে আমার আগাপাছতলা রি রি করে জ্বলে উঠল। রাগের চোটে তখন দাদার নেড়া মাথাটাকে তবলার মতো দেখছিলাম। ইচ্ছে করছিল আশ মিটিয়ে বাজিয়ে নিই – তেরে কেটে তা ধিন তা!
হেনসময় বৌদি এলেন ছাদে। তাঁর হাতে পুজোর থালা। প্রসাদী ফুল কপালে ছুঁইয়ে দাদা-ভাইয়ের হাতে একটা করে বাতাসা ধরিয়ে দিলেন। আমি সেটা ভক্তিভরে কপালে ঠেকিয়ে মুখে নিলাম। মদনদার ওসবের বালাই নেই, দুই ঠোটে চেপে ধরে বিস্কুটের মতো কুটকুট করে কুটতে শুরু করলেন। কাণ্ড দেখে বৌদির আক্কেল গুড়ুম। আর্তনাদ করে উঠলেন, আপদ! তিনকাল গিয়ে এককালে ঠেকেছে, ঠাকুরদেবতাকে ভক্তি করতে শিখল না।
পরক্ষণে মা-কালীর মতো এতটা জিভ বার করে দাঁতে কেটে বিলাপ করতে লাগলেন, দিলে তো আমার ব্রত ভেঙে? আজ একটা অমঙ্গল না ঘটে যাবে না। ঠাকুর অপরাধ নিও না। জোড়া পাঁঠা ভোগ দেব।

ঠাকুর দেবতাকে ঘুষ দিয়ে কিছু হবে না গিন্নি। বরং বুড়োকে ভালোমন্দ রেঁধে খাওয়াও, তাহলে আর কিছুদিন শাঁখা-সিঁদুর পরার বিলাসিতা করতে পারবে। কথা শুনে রাগের চোটে বৌদির মুখমণ্ডল রক্তবর্ণে রঞ্জিত হয়ে উঠল। ধ্যাৎ শব্দযোগে একরাশ বিরক্তি ছুড়ে দিয়ে গজগজ করতে করতে দ্রূত পলায়ন করলেন তিনি।
কেন জানি না মদনদার উপর রাগ ধরে রাখতে পারি না। কিছুক্ষণের মধ্যে সব অপমান-যন্ত্রণা ভুলে গিয়ে তোষামোদ করতে থাকি। আজও তার ব্যতিক্রম হল না। একঢোকে অনামুখো অপবাদ হজম করে নিয়ে বললাম, দাদা এটা কোথায় পেলেন?

কোথায় পেলাম মানে? এ আমার পৈতৃক সম্পত্তি। মার্বেলের মতো গোল গোল চোখ করে আমার দিকে তাকালেন মদনদা।

তাই!

তবে না তো কি! তুই কী আমাকে এলেবেলে ঘরের ছেলে ভাবছিস?

না, না। তা ভাববো কেন!

এই পিস্তল দিয়ে আমার ঠাকুরদা এক সাহেবকে গুলি করে মেরেছিলেন ওই দিঘির মাঠে।

ওমা তাই নাকি! শুনিনি তো?

তোদের না শোনারই কথা। নেমকহারাম ইতিহাস লিখিয়েরা আমাদের বংশের একটা কথাও লিখে রাখেনি। এমনকি আমার বাপ-ঠাকুরদা ব্রিটিশদের সাথে লড়াই করেছে, সে কথাও ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই পায়নি। ক্ষণেকের জন্য থেমে দম নিয়ে পুনরায় বললেন, সব গটআপ গেম বুঝলি। দু’-একজন বড় দরের নেতার কথা বাদ দিয়ে ইতিহাস বইতে যা পড়ানো হয় সব মিথ্যে।

কী জানি, হবেও বা!

তুই কী আমার কথা বিশ্বাস করছিস না?
কূটিল দৃষ্টি নিয়ে আমার দিকে তাকালেন মদনদা। এ দৃষ্টি আমার বিলক্ষণ চেনা। ইতিপূর্বে বেশ কয়েকবার এরূপ পরিস্থিতি সৃষ্টি করে তাঁর বিরাগভাজন হয়েছি। কখনো কখনো উপরি পাওনা হিসেবে কানের নীচে আছড়ে পড়েছে অস্তিচর্মসার হাতের উষ্ণ আলিঙ্গন। আজ সূযোগ দিলাম না। দ্রূত সামলে নিয়ে বললাম, দাদা আমি আপনাদের পারিবারিক ইতিহাস লিখতে চাই।
-কী! কী বললি? মদনদার মুখমণ্ডল ছুয়ে খুশির লহর বয়ে গেল।

হ্যাঁ দাদা। আপনি যেমন যেমন বলবেন ঠিক সেইভাবে লিখব। এখন বলুন নীলকর সাহেবকে কেন গুলি করা হয়েছিল?
মদনদা দ্বিগুণ উৎসাহিত হয়ে ঠাকুরদাদার বীরগাথা বর্ণনা করে শোনাতে থাকলেন, তখন নীলকর সাহেবদের অত্যাচার চরম আকার ধারণ করেছে।জোতজমা কেড়ে নিয়ে নীলচাষ করতে বাধ্য করা হচ্ছে চাষীদের। ঘরে ঘরে অন্নের অভাব, বাড়িতে উনুন জ্বলছে না। এই পরিস্থিতিতে এক নীলকর সাহেব আমাদের জমিদারির জমি জবরদখল করতে এলে ঠাকুরদা রুখে দাঁড়ান। তিনি ছিলেন রগচটা প্রকৃতির মানুষ। কথায় কথায় ব্লাডি ডগ বলে গালি দিলে তিনি সোজা সাহেবের কপাল লক্ষ্য করে গুলি চালিয়ে দেন।

তারপর!

দেশ স্বাধীন হল। সরকার জমিদারি কেড়ে নিলেন। আমাদের জোতজমা সব ভাগবাটোয়ারা হয়ে গেল। এক ঝটকায় বিত্তবৈভবের চূড়া থেকে মাটিতে আছড়ে পড়ল আমাদের পরিবার।
মদনদার বুকের খাঁচা তোলপাড় করে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এসে বাতাসে মিলিয়ে গেল। একটু থেমে পিস্তলখানা দেখিয়ে তিনি আবারও বললেন, সেই থেকে এটা দেরাজের মধ্যে পড়েছিল। আজ বার করতে হল।

কী করবেন ওটা দিয়ে?

বাড়িতে চোরের আনাগোনা শুরু হয়েছে। আজ একটা হেস্তনেস্ত করে ছাড়ব।

সর্বনাশ!

গত পরশু দিবাগত রাতে প্রথম আসে। তোর বৌদি টের পেয়ে চিল্লাচিল্লি করলে পালিয়ে যায়। গতরাতেও এসেছিল। পিস্তলের লেজ ও মাথা চেপে ধরে মোচর দিতে দিতে বললেন মদনদা।

কিছু চুরি যায়নি তো?

ঠিক বুঝতে পারছি না। তবে আমার কী মনে হয় জানিস?

কী! আগ্রহাতিশয্যে আমার মাথাটা দাদার দিকে ধাবিত হল। ঠিক যেমন চৌম্বকশক্তির আকর্ষণে লৌহচূর্ণ ছুটে যায়।

বাবার মুখে শুনেছি নীলকর সাহেবের সাথে গণ্ডগোল হবার পর ঠাকুরদা পরিবারের সমস্ত দামি অলংকার, সোদা-চাঁদির ভাণ্ডার বাড়ির মধ্যে কোথাও পুঁতে রেখেছিলেন। হঠাৎ করে মারা যাওয়ায় তিনি জায়গাটা বাবাকে দেখিয়ে যেতে পারেননি।

ওহ্!

বাবা অনেক খোঁজখুঁজি করেছিলেন। কিন্তু কোন হদিস করতে পারেননি। আমার ধারণা গুপ্তধনের সন্ধানে চোরের আনাগোনা শুরু হয়েছে বাড়িতে।

সে না হল। কিন্তু সামান্য একটা পিস্তল নিয়ে কি আপনি তাদের সাথে….
আমার কথা শেষ হতে না হতে মদনদা স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে নিজের উরুতে মস্ত চাপড় মেরে বুক টান করে বললেন, কেন পারব না? শুকনো শরীর দেখলে হবে না বন্ধু, এই শরীরে রাজরক্ত বইছে। দাঁত-মুখ বিকৃত করে সর্বশক্তি ঢেলে আরও একটা মোচর দিলেন মদনদা।
এইমুহূর্তে যন্ত্রটা মৃত সাপের মতো চলৎশক্তিহীন। বিষ থাকলেও ফোঁস করার ক্ষমতা নেই। চিলের মতো ছো মেরে সেটা দাদার হাত থেকে তুলে নিয়ে মোচর দিতে শুরু করলাম। বার কয়েকের চেষ্টায় কুঁচ শব্দে আলতো আর্তনাদ করে উঠে পিস্তলের কোমর অল্প একটু কুঁজো হল।
তখন আমাকে ধরে কে? সব পেয়েছির আনন্দে উত্তাল হয়ে চিৎকার করে উঠলাম, দাদা নড়ছে।
নাড়া। নাড়া। নাড়া….। বাটনা বাটার সময় মেয়েদের শরীর যেমন দোলে, মদনদাও তেমনি দুলে দুলে ‘নাড়া নাড়া’ মন্ত্র জপ করে চলেছেন। আমি তালে তাল দিয়ে মোচর দিয়ে যাচ্ছি।
একসময় খেলা সাঙ্গ হল। মদনদা আমার হাত থেকে যন্ত্রটা নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখে আহ্লাদে আটখানা হয়ে বললেন, সাবাস পেঁচো সাবাস! এতদিনে মরদের মতো কাজ করেছিস একখানা।
তখন খানিকটা অনুযোগের সুরেই বললাম, এবার প্রমাণ হল তো আমি অনামুখো নই?

হেঁ হেঁ হেঁ! তুই এখনও সে কথা মনে রেখেছিস? এক টুকরো ন্যাকড়া তেলে চুবিয়ে নিয়ে স্ক্রু-ড্রাইভারের আগায় জড়িয়ে নিলেন। তারপর পিস্তলের নলে ঢুকিয়ে চক্রাকারে ঘোরাতে ঘোরাতে আরও বললেন, তোকে ভালোবাসি বলেই না একটু আধটু বকাঝকা করি। পাড়ার অনেক ছেলেছোকরা আসা যাওয়া করে, কই তাদের তো কিছু বলি না।
একথা ঠিক পাড়ার অন্যান্য ছেলেছোকরার থেকে তিনি আমাকে বেশি প্রাধান্য দেন, কখনও কখনও প্রশ্রয়ও। বাড়ি এলে বৌদি চা না খাইয়ে ছাড়েন না। পালাপার্বণে ডেকে এনে মাছটা মাংসটা পেট ভরে খাওয়ান। একবার অসুস্থ হয়ে ক’দিনের জন্য হাসপাতালে ভর্তি ছিলাম। দাদা-বৌদি রোজ বিকেলে ফলমূল নিয়ে দেখতে যেতেন। একদিন ভাত খাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলে হোটেল থেকে চিকেন বিরিয়ানী এনে খাইয়েছিলেন। ভালো না বাসলে কেউ কারও জন্য এতোটা করে, যেখানে রক্তের কোন সম্পর্ক নেই?
অথচ পাড়ায় তাঁর ভীষণ দুর্নাম। কঞ্জুসের শিরোমনি, পিপড়ের পিছন টিপে চিনি বের করে নেন, অতিরিক্ত খরচের ভয়ে গায়ে তেল-সাবান মাখেন না, মাংস হাঁড়িতে রেখে শুধু ঝোল মেখে ভাত খান, একটাই বুরুশ স্বামী-স্ত্রীতে ব্যবহার করেন, ইত্যাদি ইত্যাদি। এমনকি অনেকে মদনদার মুখ দেখে যাত্রা ভঙ্গ করে।

কিরে এখনো রাগ ভাঙেনি তোর? দাদার কথায় চমক দিয়ে চেতনা ফিরল। তাড়াতাড়ি করে বললাম, কিসের রাগ দাদা? ওসব আমি কখন ভুলে গেছি।
ততক্ষণে মদনদা পিস্তলখানা ঘষেমেজে চকচকে করে ফেলেছেন। সেটা আমার মুখের সামনে তুলে ধরে বললেন, একেবারে নতুন কেনা মনে হচ্ছে তাই না?
টিকটিকির মতো মাথা নেড়ে সমর্থন জানালে তিনি প্রফুল্ল হলেন। আগ্রহভরে পিস্তলে কিভাবে টোটা ভরতে হয়, লিভার টেনে দিয়ে ট্রিগারে চাপ দিতে হয় দেখিয়ে দিলেন।
বেশ রোমাঞ্চরকর ব্যাপার! যন্ত্রটা দাদার কাছ থেকে চেয়ে নিয়ে বারকয়েক রিহার্সাল দিয়ে নিলাম। তারপর সেটা বাগিয়ে ধরে ছাদের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত বুক টান করে হেঁটে গেলাম। ফেরার সময় নিজেকে বলিউডি এ্যাকশন মুভির এ্যাঙ্গরি হিরো মনে হচ্ছিল। কল্পনায় একজনকে খলনায়ক খাড়া করে ঢাস ঢাস করে এলোপাথাড়ি গুলি ছুড়তে শুরু করলাম। এমনসময় হঠাৎ করে…..

ওরে থাক, আর হিরোগিরি করতে হবে না। নীচে যায় চল, রোদে পিঠের ছালচামড়া জ্বলে গেল।
মদনদা চিৎকারে সম্বিত ফিরে পেয়ে দেখি প্রতিপক্ষের পাত্তা নেই। উদ্ধত পিস্তলের সামনে দাঁড়িয়ে দাদা মিটিমিটি হাসছেন। সাথে সাথে একরাশ লজ্জা উড়ে এসে কানপাটি গরম করে দিয়ে হাওয়ায় মিলিয়ে গেল।
বিশাল বাড়িটাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে উঁচু পাঁচিল। পরিচর্যার অভাবে কয়েক জায়গার ইঁট খুলে পড়েছে। তন্মধ্যে দক্ষিণ-পূর্ব কোণের ক্ষতটা সবচেয়ে মারাত্মক, ওই জায়গাটাকে নিশানা করে রাত এগারোটা নাগাদ দোতালার একটা ঘরে অবস্থান নিলাম আমরা।
অন্যান্য দিনের মতোই একটা বাল্ব টিমটিম করে জ্বলছে। অল্প ওয়াটের মরা আলোয় পাঁচিলটাকে দূর থেকে দেখা কুয়াশাচ্ছন্ন পাহাড়ের মতো মনে হচ্ছিল। এদিকে ঘর জুড়ে জমাট অন্ধকার। আর অন্ধকার মানেই মশাদের মুক্তরাজ্য। বসতে না বসতে কানের কাছে মামু মামু গান শুরু হয়ে গেল, সাথে হুল ফোটানোর অস্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতা।
এরই মাঝে একটা বেয়াড়া জিজ্ঞাসা মাথায় উদয় হল। পাশাপাশি বসে থেকেও কেউ কাউকে দেখতে পাচ্ছি না। সেখানে মশারা কিভাবে শরীরের বস্ত্রহীন অঙ্গ খুঁজে পায়? ওরা কী কুকুর-বিড়ালের মতো অন্ধকারে দেখে? নাকি ঘ্রাণশক্তি বলে শিকারের দিকে ধাবিত হয়? মদনদা এই ব্যাপারে হয়তো সাহায্য করতে পারতেন। কিন্তু ‘কোন কথা হবে না’ ফতোয়া জারি থাকায় মুখ খোলার সাহস পেলাম না। অগত্যা সে চিন্তা পরিহার করে কিভাবে মশার অত্যাচার থেকে পরিত্রাণ পাওয়া তার পথ প্রতিষ্ঠায় ব্রতী হলাম।
বৌদি অপারেশনে শামিল হতে চেয়েছিলেন। দাদা তাঁর আবেদন নাকচ করে দিলে অভিমানে আহত হয়ে ডিনার না করেই তিনি শোবার ঘরে আত্মগোপন করেছেন। চুপিসারে দোতালা থেকে নিচে নেমে এসে তাঁকে ধরে ঝুলে পড়লাম, দয়া করে একটি মশা মারার কয়েল দিন। তা নাহলে চোর ধরা দূরের গল্প, মশা আমাদের দাদা-ভাইয়ের দফা রফা করে ছাড়বে।
অনেক সাধাসাধির পর দরজা খুলে বাইরে এলেন বৌদি। চাঁদ সদাগরের মনসা পূজো দেওয়ার মতো অবজ্ঞাভরে কয়েল আর দেশালাই বাক্স ছুড়ে দিয়ে পুনরায় দরজার ওপারে অন্তর্হিত হলেন।
কয়েল জ্বালানোর কয়েক মিনিটের মধ্যে মশারা স্বদলে গৃহত্যাগ করে গেল। কানের গোঁড়ায় মামু ডাকার কেউ নেই, গালে-মুখে চড়-থাপ্পড় মারতে হচ্ছে না। এই সূযোগে চোখ দু’টোকে আরাম দেবার লোভ পেয়ে বসল। মাথাটাকে চেয়ারের পিছনদিকে বিছিয়ে দিয়ে আলতো করে চোখ বুজলাম। কিন্তু কপালে ঘি খাওয়ার যোগ না থাকলে যা হয়? আরাম হারাম করে দিয়ে শক্ত কিছুর আঘাত আছড়ে পড়ল কপালের মাঝখানে। তারপর আর কিছু মনে নেই।
চেতনা ফিরে পেতে প্রথমেই পোড়া কপালের কথা মনে পড়ল। হাত দিয়ে দেখি শিং না গজালে পোয়াটাক আলুর মতো ফুলে উঠেছে। সঙ্গে সঙ্গে এক খাবলা ব্যাথা ছুটে এসে চেপে ধরল, খোঁচা খাওয়া কুকুরের মতো কুঁই কুঁই করে কেঁদে ফেললাম।
কথায় আছে অভাগা যেদিকে ধায় সাগর শুকায়ে যায়। এক্ষণে আমার অবস্থা অনেকটা সেরকম, ভেবেছিলাম কপালের দুঃখে কপাল চাপড়ে কেঁদে বুক ভেজাব। কিন্তু মদনদার দিকে দৃষ্টি যেতে সব গোলমাল হয়ে গেল। কপালের দুশ্চিন্তা কপালের হাতে ছেড়ে দিয়ে তাঁকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম।
ততক্ষণে পুবাকাশ ফরসা হতে শুরু করেছে। আকাশের বুক ফেরে চুঁইয়ে পরা প্রভাতী আলোয় যা দেখলাম তাতে আমার চক্ষু ছানাবড়া, প্রাণপাখি খাঁচা ছাড়ার জোগাড়। মদনদা হাত-পা ছড়িয়ে ধুলি ধূসরিত মেঝেয় মৃত কোলাব্যাঙের মতো চিৎ হয়ে পড়ে আছেন। তাঁর বেলের মতো মসৃণ কেশহীন মাথাটা রক্তে লতপত। হাঁ মুখের ফাটল দিয়ে মাছিরা দিব্যি ভিতর-বাহির করছে, কোটরাগত চোখজোড়া ঠেলে বেরিয়ে এসে পলেস্তারা খসা ছাদের কড়িকাঠ ছুতে চাইছে যেন।

বুড়ো টেসে গেল নাকি!
তাড়াতাড়ি উঠে গিয়ে মদনদার বামহাতের কব্জি চেপে ধরলাম, নাড়ি চলছে। নাকের গোড়ায় হাতের চেটো প্রসারিত করে ধরলাম, শ্বাস পড়ছে। জ্ঞানটুকুই যা নেই। দরকারে গলায় দেবার জন্য এক বোতল রাখা ছিল ঘরে। বোতলের ছিপি খুলে কয়েক খাবল জল তাঁর চোখমুখে দিতে চোখ খুলে এমনভাবে তাকালেন, যেন সদ্যজাত শিশু পৃথিবীর আলো প্রথমবার অবলোকন করছে।

দাদা। দাদা। ও মদনদা।
উঠে বসলেন তিনি। তারপর মাথায় হাত দিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠে চোরের চোদ্দগুষ্ঠীর পিণ্ডি চটকাতে শুরু করলেন।
বৌদির শোবার ঘরের দরজার শিকল চোরেরা বাইরে থেকে তুলে দিয়ে গেছে। দাদার কান্নার আওয়াজ পেয়ে খাঁচায় বদ্ধ পাখির মতো সেখানে তিনি ছটপট করছিলেন। ছুটে গিয়ে তাঁকে উদ্ধার করলাম।
অতঃপর চোরেরা কি নিয়ে গেছে খুঁজতে গিয়ে দেখা গেল পুজোর ঘরের সিংহাসন শূন‍্য, ঠাকুর মদনমোহন লাপাতা।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।