দৈনিক ধারাবাহিক উপন্যাসে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব – ২৩৫)

পর্ব – ২৩৫

বিকেলে আবার বাবা শুরু করেছেন, পৃথিবীর উচ্চতম গিরিশৃঙ্গ লেখো।
খোকা বোর্ডে লিখল এভারেস্ট।
উচ্চতা লেখো।
খোকা লিখল ২৯০০২ ফুট।
মিটারে লেখো।
খোকা লিখল ৮৮৪৮ মিটার।
বাঃ। ভাল হয়েছে। এবার বলো, ইউরোপের উচ্চতম গিরিশৃঙ্গ কি?
ছেলে বলল, মঁ ব্লাঁ।
মা বলল, আমার বাবা তোমাকে ওই ব্রাণ্ডের একটা কলম দিয়েছিল।
বাবা মায়ের কথা কানেই নিলেন না।
ধমকে উঠে বললেন, কোন্ পর্বতমালা, সেটা বলো?
ছেলে বাবাকে জিজ্ঞাসা করল, আল্পস?
আমায় জিজ্ঞাসা করছ কেন? তুমি কি মনে রাখতে পার নি?
মা বললেন, মনে রেখেছে তো। আল্পস বলে তো ঠিকই বলেছে।
বাবা রেগে উঠে বললেন, কনফিউজড হবে কেন? অনু তো ক‌ই ফাম্বল করে না!
মা সাফাই গান, আহা খোকা তো ছ মাসের ছোট!
বাবা বলে চলেছেন, সত‍্যি সত‍্যি উঁচু যদি বলতেই হয়, তাহলে উঁচু পাহাড় বলতে হাওয়াই দ্বীপে মৌনা কিয়া’র নাম বলতে হবে। পা থেকে মাথা অবধি মাপলে ওটাই সবচেয়ে বেশি লম্বা। আর পৃথিবীর পেটের কাছ থেকে মহাকাশের দিকে সবচাইতে এগিয়ে গিয়েছে চিলির মাউন্ট চিম্বোরাজো। আর সৌর জগতের মধ‍্যে সবচেয়ে উ‍ঁচু পাহাড়টা পৃথিবীতে নেই, আছে মঙ্গল গ্রহে। ওর নাম অলিম্পাস মনস্।
মা বললেন, ওইটুকু মাথায় এতকিছু ঢুকিয়ে দিও না। সব গুলিয়ে ফেলবে। পরীক্ষায় ফেল করবে।
বাবা কড়া স্বরে জানতে চাইলেন ফেল করবে কেন?
মা কাঁদো কাঁদো স্বরে বাবাকে বললেন, খোকাকে অঙ্কের মাস্টারমশাই যাচ্ছেতাই করে বকেন। ক্লাসে ঢুকলে আগেই ওকে কান ধরে বাইরে বের করে দিয়ে নিল ডাউন করিয়ে দেন। মা চোখে আঁচল চাপা দিয়েছেন। ওকে বিষ নজরে দ‍্যাখেন।
বাবা বললেন, কিন্তু কেন?
অন‍্য মায়েরা বলছিল, তোমার ছেলেকে মাস্টার মশাই বোর্ডে একটা বিন্দু আঁকতে বলেছে। আর ছেলে বলেছে, বিন্দু আঁকা যায় না। যাই আঁকি না কেন, যত ছোটোই আঁকি না কেন, তার একটা দৈর্ঘ্য থাকবে, প্রস্থ থাকবে, এমনকি উচ্চতাও থাকবে। মাস্টার মশাই সেই শুনে খেপে গিয়ে কাঠের স্কেল দিয়ে মেরে মেরে স্কেল ভেঙে দিয়েছেন। ছেলে এত দুষ্টু, আমায় বলে নি। চান করাতে গিয়ে দেখি পিঠে চোরের মার মারার দাগ। আরেকদিন নাকি বলেছে, এক থেকে দুইয়ের মধ‍্যে অসংখ্য সংখ্যা আছে। এত সংখ্যা, যে খাতায় লেখা সম্ভব নয়। শুনে মাস্টার মশায় কান ধরে ক্লাসের বাইরে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন।
বাবা আশ্চর্য হয়ে বলছেন, এগুলো আমি ওকে কোনো দিন বলি নি, কিন্তু ও যা বলেছে, একেবারে খাঁটি সত‍্য বলেছে। এরজন্য মারল?
মা কেঁদে উঠে বললেন, এখন ক্লাসে আর ওকে বসতেই দেন না। আগেই কান ধরে ক্লাসের বাইরে বের করে দেন।
বাবা বললেন, আমি কাল‌ই স্কুলে যাব। দেখি কে মেরেছে খোকাকে!
মা বলেন, দোহাই তোমার, পায়ে পড়ছি। এ নিয়ে তুমি আর গণ্ডগোল কোরো না। তাহলে খোকাকে স্কুল থেকে তাড়িয়েই দেবে।
বাবা বললেন, দেয় দেবে। দিলেই ভাল। কলকাতায় নিয়ে গিয়ে সেন্ট জেভিয়ার্সে ভর্তি করে দেব।
বাবার তর্জন গর্জন কানে যেতে বড় জ‍্যাঠামশায় ঘরে ঢুকে পড়লেন। মা ঘোমটা দিয়ে জড়োসড়ো। জ‍্যাঠামশায় বাবাকে বললেন, পড়ানো বলে একে? পড়ানোর আওয়াজে বাড়ি কাঁপছে। বাবা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে। বাড়ির মধ‍্যে ওই একটা লোকের কাছে বাবার হম্বিতম্বি করার সাহস নেই। তারপর জ‍্যাঠামশায় খোকাকে হাতের নড়া ধরে টেনে নিয়ে চলে গেলেন। জ‍্যাঠামশায় কোলের কাছে তাকে জড়িয়ে নিয়ে বসেছেন। চামচে করে কেটে কেটে অমলেট তার মুখে পুরে দিচ্ছেন। জ‍্যাঠামশায় পড়া ধরেন না। গল্পের মতো করে বলে যান। কিছুই জিজ্ঞাসা করেন না। ওইজন‍্যে মন দিয়ে শুনতে ইচ্ছে করে।
জ‍্যাঠামশায় বললেন, দুটো হাত আর দুখানা পা দেখলে মনে হয় এইগুলো আমাদের শরীরের সবচেয়ে বড়ো অঙ্গ। কিন্তু তার চেয়েও বড়ো অঙ্গ আছে। সেটা হল ত্বক। গায়ের চামড়া।
খোকা বলল, তাই? বোঝা যায় না তো?
সারা গায়ে বিছিয়ে আছে যে! হাতে, পায়ে, পিঠে, বুকে, গালে, ঠোঁটে। তারপর গাল টিপে আদর করে দেন।
খোকা জানতে চায়, ত্বক কতটা বড়ো?
জ‍্যাঠামশায় বলেন, বড়োদের গায়ের ত্বক একটা চারফুট বাই পাঁচ ফুট চাদরের মতো। ওই যে সিঙ্গল বিছানাটা দেখছ, ওর চাদরটার মতো।
খোকা অবাক হয়ে ভাবতে থাকে।
এত বড়ো?
জ‍্যাঠামশায় হাসেন। কিন্তু জানো, এ হল সেকেণ্ড।
খোকা বলে, তাহলে ফার্স্ট কে?
জ‍্যাঠামশায় বলেন, পেটের ভেতর আছে ক্ষুদ্রান্ত্র, তার ভেতর দিকের চামড়াটা অনেক অনেক বড়।
কতো বড়ো?
তা ধরো পনেরো কুড়িগুণ। আর তুমি সেই কবিতাটা জানো? মাসি গো মাসি, পাচ্ছে হাসি?
খোকা বলে, খুউব জানি।
তাহলে শেষের লাইনটা বলো তো?
খোকা বলে, দেখতে পেলুম তিনটে শুয়োর মাথায় তাদের নেই কো টুপি।
খোকা জানো তো, গায়ের চামড়ার দিক দিয়ে শুয়োরের সঙ্গে মানুষের খুব মিল। অ্যানিম‍্যাল ফার্ম গল্প লিখেছিলেন জর্জ অর‌ওয়েল। সেখানে পশুখামারের পশুরা বিপ্লব করে ফেলেছিল। তারপর দুটো শুয়োর, নেপোলিয়ন আর স্নোবল, তারা নেতা হয়ে বসে অন‍্য পশুদের কি যে দুর্দশা করেছিল কি বলব? বিপ্লব মানে ওই। সব ভেঙেচুরে তছনছ করে আবার সেই পুরোনো গাড্ডা। ফরাসী বিপ্লবের শেষে নেপোলিয়ন সম্রাট হয়ে যান, আর রুশ বিপ্লবের পর স্তালিনের নির্মম অত‍্যাচার। গুলাগ আর্কিপেলাগো। তাহলে শ্রীজ্ঞান কি চেয়েছিল?
খোকা অবাক চোখে চেয়ে থাকে।
জ‍্যাঠামশায় বলেন, ললিতা, ওকে সন্দেশ দাও।
জ‍্যাঠাইমা বলেন, না না, এখন আর খাবে না। ওর মা কি খাইয়েছে না খাইয়েছে জানি না। উল্টো পাল্টা খাইয়ে দিলে ওর মা আবার রাগ করবে।
হুঁ! রাগ করলেই হল? ভাল সন্দেশ। সেরা সন্দেশ। একটা কি আধটা খাবে, তাতে রাগ করার কি আছে!
খোকা চুপ করে থাকে। দেড় দু মিনিট পরেই জ‍্যাঠাইমা জিজ্ঞাসা করেন, কি রে, খাবি নাকি সন্দেশ।
খোকা বলে, খাব।
জ‍্যাঠাইমা বলেন, তা আর খাবি না! যে লোভী তুই!
জ‍্যাঠামশায় বলেন, খবরদার, আমাদের বাড়ির ছেলেকে লোভী বলবে না।
জ‍্যাঠাইমা বলেন, হুঁ! আমাদের বাড়ির ছেলে। রক্তের সম্পর্ক! বলি, যে জন্ম দিল, সে হল পরের বাড়ির মেয়ে। আর তার পেটের ছেলেটা আমাদের বাড়ির ছেলে। ভারি বুদ্ধি তোমার?
জ‍্যাঠাইমার কথাটা কানেই নেন না জ‍্যাঠামশায়। বলেন, আজকে বড় কাতলা মাছটা আনিয়েছিলাম, দেখেছ খোকা?
খোকা বলল, মাছটা যখন কাটছিল, তখন কি রক্ত, কি রক্ত!
জ‍্যাঠামশায় বলেন, মানুষের শরীরের ওজনের শতকরা সাতভাগ হল রক্ত।
খোকা বলে, ওজন নয়, ভর।
জ‍্যাঠামশায় বলেন, আচ্ছা, ভর। আর শোনো বড়োদের শরীরে পাঁচ লিটার রক্ত থাকে। রক্তের বেশিটাই রক্তরস। প্লাজমা।
খোকা জানতে চায়, কতটা?
তা মনে করো, শতকরা পঞ্চান্ন ভাগ। আর রক্তরসের বেশিটাই জল। শতকরা বিরানব্ব‌ই ভাগ। আচ্ছা, বলো তো, রক্তের রঙ লাল কেন?
খোকা বলে হিমোগ্লোবিনের জন‍্য।
তা যেন হল, কিন্তু হিমোগ্লোবিন থাকে কোথায় জানো? লোহিত রক্তকণিকার মধ‍্যে। লোহিত রক্ত কণিকা কত আছে জানো? এক মাইক্রোলিটার রক্তে ছেলেদের চার দশমিক সাত মিলিয়ন থেকে ছয় দশমিক এক মিলিয়ন। মিলিয়ন মানে কত বলো তো?
খোকা বলে, মিলিয়ন মানে একের পর ছখানা শূন্য। দশলক্ষ।
জ‍্যেঠু, ছেলেদের আর মেয়েদের কি লোহিত রক্ত কণিকার সংখ্যা আলাদা?
জ‍্যাঠামশায় বললেন, তা একটু আলাদা । মেয়েদের প্রতি মাইক্রোলিটার রক্তে চার দশমিক দুই মিলিয়ন থেকে পাঁচ দশমিক চার মিলিয়ন লোহিত রক্তকণিকা থাকে। এটা মাইক্রোলিটারের হিসাব। মাইক্রোলিটার আবার লিটারের দশলক্ষ ভাগের একভাগ। টেন টু পাওয়ার মাইনাস সিক্স। হিমোগ্লোবিনের হিসেবেও ছেলে আর মেয়েদের মধ‍্যে তফাত আছে। ছেলেদের রক্তে প্রতি ডেসিলিটারে সাড়ে তেরো গ্রাম থেকে সাড়ে সতেরো গ্রাম আর মেয়েদের রক্তে বারো থেকে সাড়ে পনেরো গ্রাম হিমোগ্লোবিন থাকে।
খোকা জিজ্ঞাসা করে মেয়েদের কম কেন?
জ‍্যাঠাইমা উল বোনা বন্ধ করে মুখ তুলে তাকান।
সোনা রোদের আলো ঝলমলিয়ে উঠে ঘরে ছড়িয়ে পড়েছে। জ‍্যাঠামশায় বললেন,
রক্ত আলোর মদে মাতাল ভোরে,
আজকে যে যা বলে বলুক তোরে,
সকল তর্ক হেলায় তুচ্ছ করে,
পুচ্ছটি তোর উচ্চে তুলে নাচা।
জ‍্যাঠামশায়ের মুখে পুচ্ছ শব্দটি শুনে হাসি পেয়ে গেল খোকার।
তিনি কোনো কিছুই গ্রাহ‍্য না করে আবেগে বলে যেতে থাকেন,
রূপ-নারানের কুলে
জেগে উঠিলাম,
জানিলাম এ জগৎ
স্বপ্ন নয়।
রক্তের অক্ষরে দেখিলাম
আপনার রূপ,
চিনিলাম আপনারে
আঘাতে আঘাতে
বেদনায় বেদনায়;
সত্য যে কঠিন,
কঠিনেরে ভালােবাসিলাম,
সে কখনাে করে না বঞ্চনা।
আমৃত্যুর দুঃখের তপস্যা এ জীবন,
সত্যের দারুণ মূল্য লাভ করিবারে,
মৃত্যুতে সকল দেনা শােধ করে দিতে।
জ‍্যাঠামশায় বলেন, খোকা জানো তো, আমাদের বুকের বামদিক ঘেঁষে, একটু পিছন দিকে একটা পাম্প মেশিন আছে।
খোকা বলে, জানি। ওটা হৃৎপিণ্ড।
তোমার হাতটা মুঠো করো তো দেখি। খোকা হাত মুঠি করে। দুই করতলে তার মুঠিটুকু আবৃত করেন জ‍্যাঠামশায়। বলেন, এই তোমার মুঠিটা হল তোমার হৃৎপিণ্ডের সাইজ। আর আমি যদি মুঠো করি, সেইটা আমার হৃৎপিণ্ডের সাইজ। হৃৎপিণ্ড সারাক্ষণ রক্ত পাম্প করে চলেছে।
কি করে ওই পাম্প চলছে জ‍্যেঠু?
ওর নিজস্ব কারেন্ট আছে খোকা। হৃৎপিণ্ডে চারটে কুঠুরি। উপরের দুটো অলিন্দ। নিচের দুটো নিলয়।
অলিন্দ কথাটা জানি জ‍্যেঠু। রাইটার্সে অলিন্দ যুদ্ধ। বিনয় বাদল দীনেশ। বরানগরে আমার মায়ের মাসির বাড়ি। তাদের গেটে লেখা আশা নিলয়। জ‍্যেঠু আলয় মানে বাড়ি, আবার নিলয় মানেও বাড়ি।
সন্ধ্যা নামছে। কাকেরা বাড়ি ফিরছে। সারাদিন ওরা ঘুরেফিরে খাবার খুঁজে খেয়ে, কা কা করে চিলের সঙ্গে যুদ্ধ করে কাটিয়েছে। এবার সন্ধ্যা নামছে। সারাদিনের মতো কাজ শেষ। এবার বাড়ি ফিরে ঘুমিয়ে পড়া। পড়তে বসতে হবে না। অস্তি গোদাবরীতীরে বিশাল শাল্মলীতরু বলতে হবে না। কাকের মা বাচ্চাদের ডানার নিচে ঢেকে ঘুম পাড়াবে।
জ‍্যেঠু বলছেন, এই হৃৎপিণ্ডটা সারাক্ষণ পাম্প করে যাচ্ছে। এক মিনিটে ষাট সেকেণ্ড, তাই তো?
মা এসে জ‍্যাঠাইমার পাশে বসলেন। এই সোয়েটারটা কার জন‍্য করছেন বড়দি?
জ‍্যাঠাইমা ইঙ্গিতে চুপটি করে থাকতে বলেন। তারপর তিনি উঠে একগ্লাস জল স্বামীর দিকে এগিয়ে দেন। খাও। অনেকক্ষণ ধরে একটানা কথা বলছ।
গ্লাসের জল শেষ করে জ‍্যেঠু বলেন, এক মিনিটে বাহাত্তর বার এই হৃৎপিণ্ড রক্ত পাম্প করে চলেছে। সেকেণ্ডে একবারেরও বেশি। ছোটোদের হার্টবিট আরো বেশি। এই হৃৎপিণ্ড ঠেলে ঠেলে রক্তকে সারা শরীরে পাঠিয়ে দিচ্ছে। তুমি যখন জন্মাও নি, মায়ের ভেতরে এইটুকু হয়ে ছিলে, তখনও তোমার হৃৎপিণ্ড কাজ করতো আর মায়ের হৃৎপিণ্ডের আওয়াজ শুনত। মা হাসেন। খোকাও হাসে।
জ‍্যাঠামশায় বলেন,
এই হৃদয়ের ধ্যান-গুহা-মাঝে বসিয়া শাক্যমুনি
ত্যজিল রাজ্য মানবের মহা-বেদনার ডাক শুনি।
এই কন্দরে আরব-দুলাল শুনিতেন আহ্বান,
এইখানে বসি’ গাহিলেন তিনি কোরাণের সাম-গান!
মিথ্যা শুনিনি ভাই,
এই হৃদয়ের চেয়ে বড় কোনো মন্দির-কাবা নাই।

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।