সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব – ১০)
মজুর, মার্ক্স ও মে দিবস
পারসনস একঘণ্টার মতো বক্তব্য রাখেন। তাঁর বক্তব্য পেশ করায় আগাগোড়া সতর্কতা ছিল। তিনি তো দেখতে পাচ্ছিলেন কতগুলি অস্ত্রধারী পুলিশ অদূরে দাঁড়িয়ে আছে। যদিও শহরের মেয়র এসে সভাস্থলের পাশ দিয়ে চলে গেলেন, তবুও পারসনস যেন বেশ আভাস পাচ্ছিলেন কী যেন একটা দুর্যোগের কালো মেঘ আকাশ জুড়ে ছেয়ে ফেলছে। বাস্তবের আবহাওয়াও যেন তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে ঘোরালো হয়ে উঠল। বৃষ্টির ফোঁটা যেন বর্শার মতো বিঁধছে। রাতও গড়িয়ে গিয়েছে অনেকটাই। সারাদিন ধকলের শেষে অনেক ক্লান্ত শ্রমিক এত রাতে আর থাকতে পারছে না। তারা বাসায় ফিরতে চাইছে। ভীড় তাই পাতলা হয়ে এল। অথচ পারসনস তো প্রথমটা বলতেই চাননি। কেননা তিনি যে জানেন তাঁর বক্তব্যে শ্রমজীবী জনতার মনে আগুন জ্বলে যায়। তেসরা মে তে দু দুটো লাশ পড়ে গেছে। মালিকেরা চাইছে আরো লাশ পড়ুক, মানুষের মন বিপ্লবীদের প্রতি বিদ্বিষ্ট হয়ে যাক। শুধুমাত্র শ্রমিকজনতা শান্তিপূর্ণ ভাবে দাঁড়িয়ে আছে বলে পারসনস বলে যাচ্ছিলেন। তারপর জোরে বৃষ্টি নামার লক্ষণ দেখে তিনি ক্ষান্ত দিলেন। আসলে সঙ্গে থাকা বাচ্চাদের কথাটা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। বৃষ্টিতে ভিজে সর্দি কাশি জ্বর বাধালে মুশকিল। বাচ্চারা জ্বরজারিতে কাবু হয় বেশি। তাই তিনি বাচ্চাদের আর লুসি এবং লিজিকে নিয়ে লেক স্ট্রিটে জেফ’স হল অভিমুখে রওনা হলেন। পারসনস বিদায় নিলে বলতে উঠলেন মেথডিস্ট পাদ্রি রেভারেণ্ড স্যামুয়েল ফিলডন ( ১৮৪৭ – ১৯২২)। পাদ্রি সাহেবের তো বলার কথাই ছিল না। তিনি আমন্ত্রিত বক্তাও নন। সমাবেশের খবরটাও জানতেন না। শুধুমাত্র রবাহূত হয়ে আঁতের টানে দৌড়ে এসেছিলেন। তাই প্রথমটা ফিলডন বলতে অনিচ্ছুক ছিলেন। তার উপর সবেমাত্র দি অ্যালার্ম পত্রিকার সম্পাদক বিখ্যাত শ্রমিক নেতা অ্যালবার্ট পারসনস ঝাড়া এক ঘণ্টা ধরে গভীর তাত্ত্বিক বক্তব্য রেখে গিয়েছেন। অতি সন্তর্পণে তিনি সমাবেশের শান্তিপূর্ণ ভাবমূর্তিটি রক্ষা করে চলে গিয়েছেন। তারও আগে বলেছেন আরবেইটার জাইটুং পত্রিকার সম্পাদক অগাস্ট স্পাইজ। এই দুই অসাধারণ বাক্যবীরের পর আর কি কারোর বক্তব্য রাখার দরকার করে? রাতও হয়েছে অনেকটা। দশটা বেজে গিয়েছে খানিকক্ষণ। বৃষ্টি পড়ছে। ভীড়ও পাতলা হয়ে এসেছে। পাদ্রি সাহেব নিজের বক্তৃতা দিতে প্রথমটা অনিচ্ছাই প্রকাশ করেছিলেন।
কিন্তু আয়োজকদের তরফে পীড়াপীড়ি উপেক্ষা করা শক্ত হল ফিলডনের পক্ষে। তিনি কেন শ্রমিকদের পক্ষে সমাজতান্ত্রিক দর্শন আঁকড়ে ধরা প্রয়োজন আর কেন কি করে সেই সময়কালের আইন কানুন শ্রমিকশ্রেণীর শত্রু, কেন বিরাজমান আইনকানুন শেষপর্যন্ত মালিকদের স্বার্থেই কাজ করে আর তেমন আইনকে অক্ষয় জেনে পূজার আসনে বসিয়ে রাখলে কেন শ্রমিক জনতার মুক্তি নেই, সেই কথা উচ্চগ্রামে বলে চলেছিলেন।
শ্রমিকরা পাদ্রি সাহেবের মুখে এইসব কথা শুনতে শুনতে আবার চাঙ্গা হয়ে উঠেছে। তথাকথিত শান্তির ধারণা যে শ্রমিকদের মুক্তির দুয়ার একটুও ফাঁক করবে না, এটা বুঝতে পেরে তারা যেন একটু চঞ্চল হয়ে উঠল। পারসনসের থেকে ফিলডনের ভাষা যে আলাদা মাত্রায় চলে গিয়েছে এটা পুলিশবাহিনী বুঝতে পেরে গিয়েছিল। পাদ্রিটাকে এখনি থামানো দরকার। নইলে পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যাবে।