সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব – ২৭)

মজুর, মার্ক্স ও মে দিবস
আর দুনিয়ার সর্বত্র যে ভূমিদাস যেখানে থাকত, সেই ভূমির উপর তার একটা অধিকার ছিল । রাজা তাকে সেই জমি ব্যবহার করা থেকে উচ্ছেদ করতে পারত না। কিন্তু আমেরিকা মহাদেশের আবিষ্কার আর তার সাথে তাল মিলিয়ে যে সব উন্নতি ঘটে চলল, সেই সূত্রে এক’শ বছর বা দু’শ বছর পরে পেরু এবং মেক্সিকোয় যে বিপুল স্বর্ণভাণ্ডারের সন্ধান পাওয়া গেল, তা লুঠ করে ইউরোপে নিয়ে এসে সেই সোনার সাহায্যে ইউরোপে থমকে থাকা অর্থনীতিতে নবীন রক্তের সঞ্চার করল। তাইতে অগ্রগতির রথ ছুটে চলল। ভূমিদাস প্রথার অবসান হয়ে মজুর শ্রমিক ব্যবস্থার সূচনা হল। এই ব্যবস্থার সূচনা হয়েছিল ফরাসি বিপ্লবের সময়ে, ১৭৮৯ থেকে ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে। ওই সময় ইউরোপে ব্যক্তিস্বাধীনতা আর রাজনৈতিক স্বাধীনতার চিন্তা ভাবনা শুরু হয়েছে। ইতিহাসের দিকে এক ঝলক তাকালে দেখা যাবে ষোড়শ শতকে ধর্মীয় স্বাধীনতা এবং চিন্তার স্বাধীনতার দাবিতে সংগ্রাম চলেছিল। তারপর সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দী জুড়ে গোটা ফ্রান্সে এক সংগ্রাম শুরু হয়। যার ফলে গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা হয় এবং রাজনৈতিক স্বাধীনতার ভিত্তি প্রতিষ্ঠা হয় । তারই ধারাবাহিকতায়, ঘটনা পরম্পরার অন্তর্লীন যুক্তিতে শিল্প কারখানার ক্ষেত্রে সমস্যার বিরুদ্ধে মানুষ মাথা তুলল। সেই সংঘর্ষের সূত্রেই আজ আমরা এই কোর্টে দাঁড়িয়ে রয়েছি। আমাদেরকে কেন এখানে আনা হয়েছে? সরকারের প্রতিভূ আইনজীবীরা বলেছেন যে, এই আমরাই শ্রমিক আন্দোলনে পথনির্দেশ করছিলাম। আর আমাদের যাতে কঠিনতম সাজা দিয়ে নিশ্চিন্ন করে ফেলা যায় তার জন্য সরকার পক্ষ বেছে বেছে জুরিদের যোগাড় করলেন। আমরা শ্রমিক মুক্তির দিশা দেখাচ্ছিলাম বলে তাঁরা ঠিক করলেন আমাদেরকে এমনভাবে শাস্তি দিতে হবে যাতে চিকাগো তথা গোটা আমেরিকার মজুর শ্রমিকেরা থরহরিকম্প হয়, তারা কুঁকড়ে গিয়ে যেন গর্তে সেঁধিয়ে যায়। আর কোনোদিন যেন ক্ষুধা, দাসত্ব, দৈন্য আর অনাহারে মৃত্যুর বিরুদ্ধে আওয়াজ না তোলে। কারখানা জগতের এই যে শ্রমবিবাদ এটা ঘটনা পরম্পরার একটা স্বাভাবিক ফল। মজুরকে খাটিয়ে নিয়ে ঠিক কতটা মজুরি দেওয়া যুক্তিসংগত তার বিচার হওয়া দরকার। এর একটা শুনানি হোক। এর একটা মীমাংসা হোক। এই জেলার উকিলেরা এই প্রশ্নকে টুঁটি টিপে মারতে পারেন না। গোটা আমেরিকায় যত জেলা কোর্ট আছে সব জেলা কোর্টের উকিলবাবুরা একজোট হয়ে এই প্রশ্নটাকে কোণঠাসা করতে পারেন না। এই শ্রমিক সমস্যাকে ধামাচাপা দিতে এই সমস্ত বিশিষ্ট সম্মানিত ভদ্রলোকেরা আমাদের টুঁটি টিপে মারতে চাইছেন। কিন্তু কেন? আমি যদি কিছু অনুভবের কথা বলে ফেলি, অনুগ্রহ করে আমাকে ক্ষমা করবেন। এই আদালতের কাঠগড়ায় আমাকে দু মাস ধরে একটানা হাজির থাকতে হয়েছে। আর ওই সব লোকগুলো আমার বিরুদ্ধে যা নয় তাই নিন্দামন্দ কটুবাক্য বলে গেছেন। আত্মরক্ষার্থে আমি একটাও কথা বলার অনুমতি পাইনি। দু মাস ধরে তারা আমার ও আমার সহকর্মীদের উপর জঘন্য নিন্দা মন্দ করে গেছেন। বিষধর সাপ যেমন করে তার শিকারের দিকে বিষ ছো়ঁড়ে, তেমনি করে আমাদের প্রতি ওরা কুবাক্য স্রোত বহিয়ে দিয়েছেন। আগেকার দিনে চার্চের লোকেরা যেভাবে যুক্তিবাদী বিজ্ঞানমনস্ক লোককে ধর্মের নামে অত্যাচার করতে করতে মেরে ফেলত, এই লোকগুলো যেন ঠিক সেই রকম করতে গিয়েছিল। সমস্ত ঘটনাকে বিকৃত করে মিথ্যা আর অতিরঞ্জিত করে যা মুখে আসে ওরা বলে গেছে, আর আমাদের শুধু শুনে যেতে হয়েছে। প্রতিবাদে মুখ খোলার কোনো অধিকার দেওয়া হয় নি। তাই আজ যদি এখানে বলার সুযোগ পেয়ে আমার মধ্যে কিঞ্চিৎ আবেগ উথলে ওঠে, তাহলে তার কারণ ছিল ওইভাবে নির্যাতিত হওয়ার প্রহরগুলো। আজ আমায় ক্ষমা করবেন। সত্যের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তাকিয়ে দেখুন এই শ্রমিক সমস্যা কেন? এটা কোনো আবেগের বিষয় নয়। শ্রমসমস্যা কোনো সেন্টিমেন্টাল জিনিস নয়, এখানে কোনো ধর্মীয় নীতির প্রশ্ন নেই। এটা কোনো রাজনৈতিক সমস্যা নয়। না মহাশয়, শ্রমসমস্যা একটা বিশুদ্ধ অর্থনৈতিক ঘটনা। এটা বিষম গুরুত্বপূর্ণ একটা জগদ্দল পাথরের মতো কঠিন বাস্তবতা। হ্যাঁ, আমি মেনে নিচ্ছি এটার একটা আবেগগত পর্যায় আছে। এর কিছু কিছু ভাবপ্রবণ, ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক দিকও রয়েছে। কিন্তু সব কয়টি প্রশ্নকে সূত্রবদ্ধ করলে শেষ বিচারে এটা একদম ডালরুটির প্রশ্ন। কিভাবে আর কোন্ রাস্তায় আমরা বাঁচব আর পেটে স্রেফ দুমুঠো দেবার যোগাড়টা কিভাবে হবে–এককথায় এই হল শ্রমিক আন্দোলন। এটা একটা বৈজ্ঞানিক ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে আছে। বাস্তবের তথ্যভিত্তিক ঘটনার উপর এই জিনিসটা প্রতিষ্ঠিত। আমি এই নিয়ে বিখ্যাত ও বিশিষ্ট লেখকদের গ্রন্থগুলি খুব যত্ন করে ধৈর্য ধরে পড়াশোনা করেছি এবং বিস্তর পরিশ্রম করে গবেষণাও করেছি। এই বিষয়টা কেন আর কোথা থেকে উঠে আসছে তা নিয়ে সংক্ষেপে আমার অর্জিত জ্ঞান আপনাকে শোনাতে চাই। সবার প্রথমে আপনাকে বুঝিয়ে বলতে চাই ক্যাপিটাল, মানে পুঁজি, এই পুঁজি জিনিসটা কী?
ক্রমশঃ