|| জন্মদিনের স্মরণলেখায় আইজ্যাক নিউটন || লিখেছেন মৃদুল শ্রীমানী

আজ বড়দিন, আজ জন্মদিনে আইজ্যাক নিউটন স্মরণ
পৃথিবীর ইতিহাসে যে সমস্ত গ্রন্থ দিনবদলের দায়িত্বভার নিয়েছে ফিলজফিয়া ন্যাচারালিস প্রিন্সিপিয়া ম্যাথমেটিকা তাদের মধ্যে সর্বাগ্রগণ্য। বইটি লিখেছেন মহাবিজ্ঞানী আইজ্যাক নিউটন। সেকালের রীতি অনুযায়ী বইটি ল্যাটিন ভাষায় লিখিত হয়েছিল।
প্রকাশের তারিখ ছিল ৫ জুলাই, ১৬৮৭। ১৭২৮ সালে, লেখকের মৃত্যুর পর এই বইয়ের ইংরেজি সংস্করণ হয়। এই বইতে নিউটন তাঁর গতি সম্বন্ধীয় সূত্র ও সর্বব্যাপী মহাকর্ষ সূত্র নিয়ে সর্বমোট তিন খণ্ডে আলোচনা করেছেন।
নিউটন তাঁর জীবদ্দশায় দুইবার বইটির সংস্করণ করেন। প্রথমে বিভিন্ন ত্রুটি সংশোধন করে ১৭১৩ সালে
দ্বিতীয় সংস্করণ বের হয়। এর আরো পরে ১৭২৬ সালে আরো গবেষণাজাত তথ্য ও ধারণা অন্তর্ভুক্ত করে একটি উন্নততর ও পরিবর্ধিত সংস্করণ প্রকাশ করেন। বইটির তিনটি খণ্ডের প্রথম দুটির নাম ছিল দি মতু করপোরাম। অর্থাৎ বস্তুর গতি বিষয়ক কথা। তৃতীয় খণ্ডের নাম ছিল দি মুণ্ডি সিস্টেমেট। বা, জাগতিক ব্যবস্থা সম্পর্কে।
১৬৮৪ সালের জানুয়ারি মাসে এডমন্ড হ্যালি, ক্রিস্টোফার রেন এবং রবার্ট হুক গ্রহগুলির চলন সংক্রান্ত নিয়ম নিয়ে আলোচনায় মেতেছিলেন। কিন্তু যথেষ্ট বিতর্ক সত্ত্বেও তাঁরা কোনো যুক্তিসংগত সিদ্ধান্তে উপস্থিত না হতে পেরে ঠিক করলেন, এ বিষয়ে নিউটনের মতামত নেবেন। ওইসময়ে আইজ্যাক নিউটন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত বিভাগে লুকাসিয়ান অধ্যাপক।
ওই ১৬৮৪ সালেই এডমন্ড হ্যালি নিউটনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সম্ভবত সেটা আগস্ট মাস। হ্যালির কাছে আবেদনটি শুনে নিউটন এ বিষয়ে একটি নয় পৃষ্ঠাব্যাপী পাণ্ডুলিপি তৈরি করে হ্যালিকে দেন। এই পাণ্ডুলিপির নাম দেওয়া হয় দি মতু করপোরাম ইন জাইরাম। অর্থাৎ, যে সমস্ত বস্তু কক্ষপথে পরিভ্রমণ করে, তাদের গতিবিষয়ক তত্ত্ব।
এই পাণ্ডুলিপিটি পেয়ে এবং এর গাণিতিক ও পদার্থবিদ্যাগত মৌলিক ধারণা লক্ষ করে হ্যালি খুব খুশি হন। এবং ওই ১৬৮৪ র নভেম্বরে পুনরায় নিউটনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এডমন্ড হ্যালির উৎসাহে আইজ্যাক নিউটন তাঁর অন্যান্য কাজ থেকে মনোযোগ সরিয়ে এনে এই বিষয়ে আরো গভীরভাবে মনোনিবেশ করে ১৬৮৬ সালের এপ্রিল নাগাদ বিস্তৃততর পাণ্ডুলিপি তৈরি করেন।পাণ্ডুলিপিটি লণ্ডনের রয়াল সোসাইটিতে গৃহীত হয় এবং সোসাইটির প্রেসিডেন্ট ১৬৮৬ সালের ৩০ জুন পাণ্ডুলিপিটি বই আকারে মুদ্রণের অনুমতি দেন। কিন্তু রয়াল সোসাইটির ওই বৎসরের পুস্তক প্রকাশনার সমস্ত বাজেট অন্য একটি বই দি হিস্টোরিয়া পিসিয়াম ছাপাতে খরচ হয়ে যাওয়ায় রয়াল সোসাইটি নিউটনের বই ছাপাবার আর্থিক দায়ভার নিতে পারেন নি। এডমন্ড হ্যালি ছিলেন রয়াল সোসাইটির মুখপত্র ফিলজফিক্যাল ট্রানজ্যাকশনের প্রকাশক। হ্যালির ব্যক্তিগত অর্থে প্রিন্সিপিয়া ছাপা হয়।
আইজ্যাক নিউটন ছিলেন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের লুকাসিয়ান প্রফেসর। এটি সারা পৃথিবীতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে অধ্যাপকদের সবচাইতে সম্মানিত পদ বলে ধারণা করা হয়। প্রথম লুকাসিয়ান প্রফেসর ছিলেন আইজ্যাক বারো। তিনি ছয় বৎসর ওই পদ অলংকৃত করার পর ১৬৬৯ সালে নিউটন ওই পদে বৃত হন এবং একাদিক্রমে তেত্রিশ বৎসর ওই দায়িত্ব পালন করেন। ১৭০৩ থেকে ১৭২৭ সাল অবধি তিনি লণ্ডনের রয়াল সোসাইটির প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
অথচ শুরুটা তাঁর ছিল একেবারেই অন্যরকম। পুরোনো জুলিয়ান ক্যালেণ্ডার তখনকার ইংল্যান্ডে চলত। পরে এসেছিল গ্রেগরিয়ান ক্যালেণ্ডার। জুলিয়ান ক্যালেণ্ডার অনুযায়ী ১৬৪২ সালে ২৫ ডিসেম্বর যিশুর জন্মদিনে মধ্যরাত্রের ঘণ্টাটাক কিংবা ঘণ্টা দুয়েক পরে নিউটন জন্মেছিলেন। জন্মের তিনমাস আগেই নিউটনের জন্মদাতা পিতার মৃত্যু হয়েছিল। খুব ছোট্ট একটা শরীর নিয়ে জন্মেছিলেন তিনি। তাঁর নাম রাখার জন্য বিশেষ মাথা ঘামানোর কোনো যৌক্তিকতা খুঁজে পান নি তাঁর মা। শিশুটির প্রয়াত বাবার নামেই তাঁর নাম রেখে তিনি তাঁর কর্তব্য সেরে ফেলেন। নিউটনের বছর তিনেক বয়সে তাঁর মা তাঁকে দিদিমার কাছে ফেলে রেখে অন্যত্র বিবাহ করেন। এরফলে নিউটনের শিশুমন প্রচণ্ড অভিমানে দীর্ণ হয়েছিল। মা নিউটনের প্রতি সঠিক ব্যবহার করেন নি। দ্বিতীয়বার বৈধব্যের পর মা চেয়েছিলেন বিদ্যালয় থেকে ছাড়িয়ে এনে নিউটনকে চাষবাসের কাজে লাগিয়ে দেবেন। কিন্তু গণিতে প্রখর মেধাবী ছাত্রকে ছাড়তে চাননি শিক্ষক হেনরি স্টোকস। তিনি নিউটনের মাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে স্কুলে পড়া বহাল রেখেছিলেন। ১৬৬১ সালের জুন মাসে নিউটন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রিনিটি কলেজে একটি গরিব ছাত্র হিসেবে ভরতি হন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে অন্নসংস্থান সহ কিছু কিছু সহায়তা তিনি পেতেন। কিন্তু তার বিনিময়ে তাঁকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চাকর বাকরের পর্যায়ে শারীরিক পরিশ্রম করতে হত।
পড়াশুনায় ভাল ছিলেন বলেই ১৬৬৪ সালে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একটি স্কলারশিপ পেয়ে যান এবং তার ভরসায় এম এ অবধি পাশ করেন।
এম এ পাশ করার বছর খানেকের মধ্যেই নিউটন শিক্ষকতার কাজ পেয়ে যান এবং ১৬৭২ সালে বিখ্যাত রয়াল সোসাইটির ফেলো নির্বাচিত হন।
নিউটনের সমাধিপীঠে লেখা আছে, এখানে সমাধিস্থ আছেন আইজ্যাক নিউটন, নাইট, যিনি অলোকসামান্য, প্রয় দৈব বিভূতিবলে অসামান্য মানসিক প্রজ্ঞার অধিকারী এবং অপূর্ব ধীশক্তির জন্য গাণিতিক সূত্র নির্মাণে পারদর্শী। তিনি গ্রহগুলির গঠন ও চলনপথ নির্ধারণ করেছেন। ধূমকেতুর গতিপথ , সাগরের জোয়ার ভাঁটা এবং আলোকরশ্মির ছটায় নানা বৈচিত্র্য অপূর্বভাবে ব্যাখ্যা করেছেন।….তিনি সমগ্র মানবজাতির এক মহান অলংকার বিশেষ। তিনি ১৬৪২ সালের ২৫ ডিসেম্বর জন্মেছিলেন এবং ১৭২৬ সালের ২০ মার্চ তাঁর দেহাবসান হয়।
বিখ্যাত কবি আলেকজান্ডার পোপ তাঁর সম্বন্ধে অসাধারণ দুটি পংক্তি লিখেছিলেন। সেটি নিউটনের সমাধিপীঠে লেখা না হয়ে উঠলেও আজ তাঁর জন্মদিনে বিশেষভাবে স্মরণীয়। বাংলা ভাষায় পংক্তিদুটি এরকম হতে পারে
” বিশ্বনিয়ম ঢাকা ছিল অন্ধগহনতলে
নিউটনের আবির্ভাবে উঠল আলো জ্বলে।”