আজকের দিনটি পৃথিবীব্যাপী যুদ্ধের ইতিহাসে সাংঘাতিক একটা দিন। এইদিনে জার্মানির হিটলার আর ইটালির মুসোলিনি চুক্তি স্বাক্ষর করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ঘনিয়ে তোলেন। ইতিহাস যে পড়েছে, তাকে যুদ্ধের কথা পড়তেই হয়েছে। ভারত ইতিহাসে হোক, চীন জাপান, স্পেনের ইতিহাস হোক, রুশ জার্মান হোক, বা ইংল্যাণ্ড ফ্রান্স, যুদ্ধ লোকক্ষয়, হাহাকার, একটা গভীর বাস্তব ঘটনা।
সুদূর অতীতে রাম রাবণের যুদ্ধ ঘটেছিল কি না, তার কোনো পাথুরে প্রমাণ আমাদের হাতে নেই। কিন্তু রামকথা যাঁরা লিখেছিলেন, সেই বাল্মীকির দল যুদ্ধের গোড়ায় শূর্পনখার নাক কান কাটার গল্পটা বলে নিলেন। বললেন, অশোকবনে সীতাকে রাবণ স্পর্শ করতে যেতে পারে নি, একটাই ভয়ে, তা হল, সীতাকে স্পর্শ করলেই রাবণের মাথা চৌচির হয়ে যাবে এমন একটা অভিশাপ রাবণকে সামলে সুমলে রাখত। তারপর রামকথায় বালী সুগ্রীবের ভাইয়ে ভাইয়ে যুদ্ধে রামকে বহিরাগত হয়েও লুকিয়ে চুরিয়ে তীর মেরে বালীকে খুন করতে হয়েছিল। সেটাকে মহাকাব্যের নায়কোচিত কাজ বলতে মুখে বাধে। ইন্দ্রজিতের যজ্ঞাগারে লক্ষ্মণ প্রবেশ করছেন, আর কি কি করছেন, সে সব লিখেছেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত। সেখানে ইন্দ্রজিৎ স্বদেশপ্রেমী নায়ক। লক্ষ্মণ স্রেফ তস্কর আর বিভীষণ বিশ্বাসঘাতক। রামায়ণের গল্পে লঙ্কাকাণ্ড ঘটানোর পালাটা যাত্রার দর্শকের চোখ বিস্ফারিত করে তোলে। আর মহাভারতের প্রকাশ্য রাজসভায় দ্রৌপদী আপনজনের হাতে গুরুজনদের সম্মুখে চরম লাঞ্ছিত হচ্ছেন, এই দৃশ্যটা সচেতন পাঠকের মনে জ্বালা ধরিয়ে দেয়। আর জ্যাঠাদের হাতে কিশোর অভিমন্যু চক্রব্যূহে আটকা পড়ে মরণান্তিক আঘাত বুকে নেয়। নিশীথের অন্ধকারে পাণ্ডবশিবিরে ঢুকে দ্রৌপদীর পঞ্চপুত্রের নিধনও অশ্বত্থামার তরফে জঘন্য ক্রূরকর্ম বলে নিন্দিত। আগুন লাগানোর গল্পও মহাভারতে কম নেই। খাণ্ডবদাহনে তার প্রমাণ মেলে। রামায়ণ ও মহাভারত নিছক গল্পকথা হলেও মানুষের বুদ্ধি তাকে যুগ যুগ ধরে গ্রহণ করেছে। আর যুদ্ধ জিনিসটা যে আসলে কি, তা মহাকবিগণ ওখানে লিখে রেখে গেছেন।
সুদূর অতীতে ভারতে এক যুদ্ধনিপুণ রক্তপিপাসু চণ্ডাশোক ছিল। কলিঙ্গ যুদ্ধে লক্ষ লক্ষ সৈন্যের প্রাণহানি করতে সেই দানবের বাধে নি।
লাশের রক্ত গড়িয়ে দয়া নদীর জল লাল হয়ে গিয়েছিল। নদীর নাম দয়া, আর তাতে বইছে রক্তের ধারা। এরপর আর কেউ মাথা তুলে অশোকের মুখোমুখি হবে, এমন বড়ো একটা যোদ্ধা ছিল না। তখন তিনি ধর্মাশোক হয়ে গেলে আর সাম্রাজ্য হাতছাড়া হবার ভয় ছিল না। ক্রমে তিনি হয়ে গেলেন প্রিয়দর্শী।
যুদ্ধের গল্পও এভাবেই সাগ্রহে গিলেছে মানুষ। আকাশের মেঘ গর্জালে বিদ্যুৎ চমকে সে দেব দানবের অসির ঝনৎকার দেখেছে। পুরাণে পুরাণে, মঙ্গলকাব্যে গল্প ফেঁদেছে মহিষাসুরমর্দিনীর। তাই যুদ্ধ এক ভয়ানক রকম বাস্তব ঘটনা।
অথচ কবিকে দেখাতে হল, যুদ্ধের ফলে এমনকি বিজয়ীরও কোনো উপকার হয় না। রাম জিতেছিলেন, এ যেমন সত্য, তার চেয়ে বেশি সত্য, সীতাকে অবিচার করে মৃত্যুর দিকে তিনি ঠেলে দিয়েছিলেন। যুধিষ্ঠির ছিলেন ধর্মপুত্র। যুদ্ধজয়ের লোভে তিনি মিথ্যা বললেন, রথ তাঁর নেমে এল ধূলার ধরণীতে।
আর অবিচ্ছিন্ন স্বর্গবাস তাঁর জুটল না। নরকদর্শন করতে হয়েছিল প্রথমেই। আর বাড়তি পাওনা হয়েছিল অভিমন্যুর পত্নী উত্তরার গর্ভস্থ শিশুর প্রতি সাংঘাতিক ব্রহ্মশির অস্ত্রের আঘাত।
যুদ্ধ মানেই তাই। কবিরা চোখে আঙুল দিয়ে দেখান যুদ্ধ মানে আসলে মনুষ্যত্বের পরাজয়, মূল্যবোধের পরাজয়। নিয়ম মেনে যুদ্ধ, সে এক কল্পকাহিনী মাত্র।
রবীন্দ্রনাথকেও তাঁর সময়ে যুদ্ধের বিরুদ্ধে বলতে হয়েছে। বিচিত্রিতা কাব্যগ্রন্থের ‘যাত্রা’ কবিতা, পরিশেষ কাব্যগ্রন্থের ‘প্রশ্ন’ কবিতা, ‘আফ্রিকা’ কবিতা, আরোগ্য কাব্যগ্রন্থের ‘ওরা কাজ করে’ কবিতা, রবীন্দ্র কাব্যসম্ভারে যুদ্ধবিরোধী ভাবনা নেহাত কম না। শুধু কবির চোখ দিয়েই নয়, দর্শন, ইতিহাস, সমাজতত্ত্ব ও অর্থনীতির পরিশীলিত মন নিয়ে রবীন্দ্রনাথ যুদ্ধের গভীর কার্যকারণে আমাদের তাকাতে বলেন। কালান্তরের “লোকহিত” প্রবন্ধে, এবং উগ্র জাতীয়তাবাদবিরোধী আরো নানা প্রবন্ধে তাঁর এই মনটা খুঁজে পাওয়া যায়।
আমরা চাই, বা না চাই, পুঁজিবাদ আর তার সংকট এ যুগে একটা বড়োমাপের সত্য। পুঁজিবাদের সবচাইতে সংকটাপন্ন অবস্থাকে বলতে হবে সাম্রাজ্যবাদ। “রক্তকরবী” গড়ে তোলার আগে তিনি যক্ষপুরীর কথা ভেবেছিলেন। আর ভেবেছিলেন রাম রাবণের কথা। দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে আমেরিকা থেকে চিঠি লিখেছিলেন তিনি। সেখানে সাম্রাজ্যবাদের কুৎসিত রূপটি তিনি গোপন করতে চান নি।
আধুনিক যুগে যুদ্ধ কিভাবে ঘটছে, তার ঐতিহাসিক বাস্তবতা আর ভেতরে ভেতরে অর্থনীতির সুতোর টান, দার্শনিক স্তরে জাতিঘৃণা, রক্তের বিশুদ্ধতার প্রলাপ রবীন্দ্রনাথকে যে ভাবিয়েছিল এ জিনিসটা রবীন্দ্র সাহিত্যের চিন্তাশীল পাঠকমাত্রেই উপলব্ধি করবেন। আজকের দিনে কুখ্যাত জার্মান সমরনায়ক অ্যাডলফ হিটলার আর ইটালির ফ্যাসিস্ট নায়ক বেনিতো মুসোলিনি মানব সভ্যতার বিরুদ্ধে সাংঘাতিক যুদ্ধ বাধাতে চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন। উপাধি পাওয়া বৈজ্ঞানিক ভৃত্যদের কাজে লাগিয়ে হিটলার মুসোলিনি তো বটেই, যে কোনো যুদ্ধোন্মাদ শাসক আস্ফালন করতে থাকে।
“বৈজ্ঞানিক ভৃত্য” কথাটা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বহু দিনের আবিষ্কার, সেই জুতা আবিষ্কার কবিতা থাকেই। আর রবীন্দ্রনাথের কল্পনায় কাঞ্চী ও কর্ণাট দ্বৈরথে কাঞ্চীরাজের হাতে শিশুদের ও তাদের অভিভাবকদের প্রবল লাঞ্ছনা বিদূষককে কি বলিয়েছিল, লিপিকার পাঠকের তা মনে থাকার কথা।
রামায়ণে কথিত আছে, হনুমান ব্রাহ্মণের বেশ ধরে মন্দোদরীর কাছ থেকে রাবণের মৃত্যুবাণ চেয়ে এনেছিল। দ্বৈপায়ন হ্রদের তীরে ন্যায়মূর্তি কৃষ্ণ ভীমকে অঙ্গুলিসংকেত করেন, গদাঘাতে দুর্যোধনের ঊরু ভাঙো। আজ বিজ্ঞানকে সাথে নিয়েই যুদ্ধোন্মাদদের বিরুদ্ধে লড়তে হবে।