তখন ১৯১৯ সাল। ভারতে ব্রিটিশ শাসন। পঞ্জাবের লেফটেন্যান্ট গভর্নর স্যর মাইকেল ও’ডায়ার ( ২৮.০৪.১৮৬৪ – ১৩.০৩.১৯৪০)। ভারতে চলছে ব্রিটিশের সাংঘাতিক জবরদস্তিমূলক অপশাসন। তার বিরুদ্ধে লড়ছে কংগ্রেস দল।
সদ্য শেষ হয়েছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। ইংরেজ জয়ী পক্ষে। এর মধ্যেই রাশিয়ার বুকে শ্রমিক কৃষক মেহনতি মানুষের ঐক্যে বিপ্লব হয়েছে ভ্লাদিমির ইলিচ উলিয়ানভ তথা লেনিনের নেতৃত্বে। তার প্রভাবে দেশে দেশে মানুষ সংঘবদ্ধ হচ্ছে। গলা তুলছে শাসন শোষণ অত্যাচারের বিরুদ্ধে।
১৯১৪ সালের ২৮ জুলাই থেকে ১৯১৮ সালের ১১ নভেম্বর অবধি, চার বছর তিন মাস দুই সপ্তাহ জুড়ে চলা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মধ্যেই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ টের পেয়ে গেছে ভারতে মানুষ আরো বেশি বেশি করে জাগছে। আর তাই যুদ্ধের আবহাওয়ার মধ্যেই ১৯১৫ সালে ভারতে ব্রিটিশ আনল ডিফেন্স অফ ইণ্ডিয়া অ্যাক্ট। আনল কঠোর দমননীতি। যুদ্ধ শেষে ১৯১৯ সালে ওই ডিফেন্স অফ ইণ্ডিয়া অ্যাক্টকে আরো কড়া করে চুঁইয়ে নতুন বোতলে এল অ্যানার্কিক্যাল অ্যাণ্ড রেভলিউশনারি ক্রাইমস অ্যাক্ট, ১৯১৯। এই আইনকে লোকে চিনল রাউলাট অ্যাক্ট হিসেবে। কেননা, এই আইন আনার আগে নিয়ম মান্য করে এক বিশেষজ্ঞ কমিটি নিয়োগ করা হয়েছিল, যার প্রেসিডেন্ট ছিলেন সিডনি রাউলাট। কী বলা হল এই অ্যানার্কিক্যাল অ্যাণ্ড রেভলিউশনারি ক্রাইমস অ্যাক্ট তথা রাউলাট অ্যাক্টে?
এই আইন কোনো কারণ না দেখিয়ে যে কোনো ভারতীয় ব্যক্তিকে অ্যারেস্ট করার আইনি একতিয়ার দিল পুলিশকে।
১৯১৯ সালের মার্চ মাসের আঠারো তারিখে দিল্লির ইমপিরিয়াল লেজিসলেটিভ কাউন্সিল এ আইনটি পাশ হয়ে গেল। পুলিশ এই আইনের বলে যাকে খুশি, যখন খুশি, কোনো কারণ না দেখিয়ে, বিনা বিচারে আটক করার সুযোগ পেয়ে গেল।
সভ্য সমাজ এ ধরনের আইনকে বলে ড্রাকোনিয়ান অ্যাক্ট। দানবিক আইন। কালা কানুন। ইংরেজের ভালমানুষি আসলে ঠিক কি, এই আইন চালু করে তারা তা টের পাইয়ে দিল। এহেন দানবিক আইনের বিরুদ্ধে গলা তুললেন মোহনদাস কর্মচন্দ গান্ধি, পেশায় যিনি ব্যারিস্টার ছিলেন। তিনি এই আইনের বিরুদ্ধে সত্যাগ্রহ শুরু করলেন। এই আইন চালু করার প্রতিবাদে ব্রিটিশ রাজকে ধিক্কার দিয়ে একুশে মার্চ, ১৯১৯ তারিখে দিল্লির ইমপিরিয়াল লেজিসলেটিভ কাউন্সিল থেকে পদত্যাগ করলেন পণ্ডিত মদনমোহন মালব্য ও মহম্মদ আলি জিন্নাহ্।
জাতীয় কংগ্রেসের নেতারা দিকে দিকে এই কালা কানুনের বিরুদ্ধে জনমত সংগঠিত করতে নেমে পড়লেন। পঞ্জাবের মাটিতে ঝড় তুলতে চাইলেন চিকিৎসক রাজনৈতিক নেতা ডাক্তার সত্যপাল ( ১১.০৫.১৮৮৫ – ১৮.০৪. ১৯৫৪) এবং পঞ্জাব প্রদেশ কংগ্রেসের নেতা ব্যারিস্টার সৈফুদ্দিন কিচলু ( ১৫.০১.১৮৮৮ – ০৯.১০.১৯৬৩)
পঞ্জাবি জনমনে ডাক্তার সত্যপাল ও ব্যারিস্টার সৈফুদ্দিন কিচলুর প্রভাবের কথা ব্রিটিশ সরকারের গুপ্তচররা জানত। ১৯১৯ এর মার্চের মাঝামাঝি থেকেই ওই দুই নেতার গতিবিধির উপর নজরদারি করছিল সিআইডি। আর তাক করছিলেন স্যর মাইকেল ও’ ডায়ার, আইরিশ আইসিএস, পঞ্জাব প্রদেশের লেফটেন্যান্ট গভর্নর ( ১৯১৩ – ১৯১৯) পদে ক্ষমতাসীন প্রশাসক।
এপ্রিল মাসের দশ তারিখে ডাক্তার সত্যপাল আর ব্যারিস্টার সৈফুদ্দিন কিচলুর উপর ফরমান জারি করা হল যে তাঁদেরকে ডেপুটি কমিশনার মাইলস আরভিং সাহেবের সঙ্গে তাঁর অফিসে দেখা করতে হবে। ওইখানেই দুই নেতাকে আটক করে পঞ্জাব সরকার ধরমশালায় অন্তরীণ করে রাখলেন।
দুই জনপ্রিয় নেতার উপর এই অন্যায় আটকের বিরুদ্ধে পঞ্জাবি জনতা প্রতিবাদে গর্জে উঠল। শান্তিপূর্ণ পথে, অহিংস জনতা বৈশাখী মেলা উপলক্ষে জালিয়ানওয়ালাবাগ ময়দানে প্রতিবাদ সভায় জড়ো হল। প্রশাসন নজর রাখছিলেন। জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেতৃদ্বয়কে বিনা বিচারে আটকের বিরুদ্ধে জনতার শান্তিপূর্ণ সমাবেশকেও তাঁরা বাঁকা চোখে দেখলেন। জনতার নিরস্ত্র জোটবদ্ধতাকে ঔদ্ধত্য জ্ঞান করলেন মাইকেল ও’ডায়ার। সবক শেখানোর দরকার অনুভব করে অস্ত্রের ভাষায় প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলেন। লেফটেন্যান্ট গভর্নর স্যর মাইকেল ও’ডায়ার জালিয়ানওয়ালাবাগে নিরস্ত্র শান্তিপূর্ণ সমাবেশকে রুখতে অকল্পনীয় সাঁজোয়া ব্যবস্থা নিলেন। পঞ্চাশ ট্রুপ সেনা নামল। নাইনথ গুর্খা রাইফেলস এর গুর্খা ফার্স্ট ব্যাটালিয়নের পঁচিশজন গুর্খা সৈন্য, পঁচিশ জন পাঠান আর বালুচ সৈন্য, ৫৪ নং শিখ ও ৫৯ নং সিন্ধ রাইফেলস নামল বৈশাখী মেলা সমাবেশ রুখতে। প্রতিটি সেনানীর হাতে থ্রি নট থ্রি লী এনফিল্ড রাইফেল। চলল গুলি। যতক্ষণ না সঙ্গে আনা গুলিগোলা ফুরায়, গুলি বর্ষণ করার আদেশ হল। যে প্রাণভয়ে পালাচ্ছে, তাকেও গুলি করতে হবে। যে মাটিতে পড়ে গিয়েছে, গুলিতে বিঁধতে হবে তাকেও। এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড পরিচালনার দায়িত্ব পেলেন আরেক ডায়ার, কর্ণেল রেজিনাল্ড এডওয়ার্ড হ্যারি ডায়ার ( ০৯.১০.১৮৬৪ – ২৩.০৭.১৯২৩)। টেম্পোরারি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডায়ার। আজ এই হত্যালীলার পরিচালক রেজিনাল্ড ডায়ারের মৃত্যুদিন।
আজ থেকে একশত দুই বৎসর আগে, ১৯১৯ সালের ১৩ এপ্রিলে অমৃতসরের জালিয়ানওয়ালাবাগে শান্তিপূর্ণ নিরস্ত্র জনতার উপর যে নিষ্ঠুর আক্রমণ করেছিল ব্রিটিশ প্রশাসন, তার মূল কুশলী ও পরিকল্পনাকার ছিলেন লেফটেন্যান্ট গভর্নর স্যর মাইকেল ও’ডায়ার, আর যাঁর পরিচালনায় হত্যাকাণ্ডটি পরিচালিত হল, তিনি আরেক ডায়ার, কর্ণেল রেজিনাল্ড এডওয়ার্ড হ্যারি ডায়ার। আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করি দুজনেই ১৮৬৪ সালের জাতক।
জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডে হতাহতের সংখ্যা নিয়ে মতভেদ আছে। সরকারপক্ষ খুব স্বাভাবিকভাবেই মৃত ও আহতের সংখ্যা স্বচ্ছতার সঙ্গে প্রকাশ করেন না। জালিয়ানওয়ালাবাগের ক্ষেত্রেও তার অন্যথা ঘটেনি। তুলনায় অনেক বেশি নিরপেক্ষ হিসাব পাওয়া যায় ব্রিটিশ সার্জেন ডাঃ স্মিথের বর্ণনায়। তিনি বলেন মৃত ও সাংঘাতিক ভাবে আহতদের মোট সংখ্যা ছিল ১৮০০ এর মতো।
জালিয়ানওয়ালাবাগ কাণ্ডে দেশে বিদেশে ধিক্কারের ঢেউ ওঠে। ভারতীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা ব্রিটিশ শাসকের এহেন নখ দাঁত আস্ফালন আগে দেখেননি। তাঁরা কুঁকড়ে গিয়েছিলেন। এমনকি আগুনখেকো নেতারাও গর্তে আশ্রয় নিয়েছিলেন। প্রতিবাদ ধ্বনিত করেছিলেন কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বাইশ মে তারিখে তিনি ঘটনাটি জানতে পেরে পরিচিত রাজনৈতিক নেতাদের কাছে সমবেত প্রতিবাদের জন্য আবেদন করে ব্যর্থ হলে, একত্রিশ মে, ১৯১৯ তারিখে ব্রিটিশ সরকারের দেওয়া নাইট উপাধি পরিত্যাগ করে খোলা চিঠি পেশ করেন।
এই হত্যাকাণ্ডে নানা মহলে নিন্দাবাদ সামাল দেবার লক্ষ্যে ব্রিটিশ সরকার ১৯১৯ সালের ১৪ অক্টোবর একটি অনুসন্ধান কমিটি গঠন করেন। এডুইন মন্টাগু, তৎকালীন ভারতসচিব লর্ড উইলিয়াম হান্টারকে প্রেসিডেন্ট মনোনীত করে এই কমিটি ঘোষণা করেন। এর সরকারি নাম ডিজঅর্ডার ইনকোয়ারি কমিটি হলেও সাধারণ মানুষের কাছে কমিটির প্রেসিডেন্ট লর্ড উইলিয়াম হান্টারের নামে এটি হান্টার কমিশন বলে পরিচিত হয়।
লর্ড হান্টার ছিলেন নামকরা আইন বিশেষজ্ঞ। তিনি ছিলেন স্কটল্যান্ডের প্রাক্তন সলিসিটর জেনারেল এবং স্কটল্যান্ডের কলেজ অফ জাস্টিস এর সেনেটর।
কমিটিতে বিচারপতি জর্জ সি র্যাঙ্কিন অন্যতম সদস্য ছিলেন। কমিটির ভারতীয় সদস্যদের মধ্যে ছিলেন বম্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য স্যর চিমনলাল হরিলাল শীতলবাদ। ইনি আবার বম্বে হাইকোর্টের আইনজীবীও ছিলেন। কমিটির অন্যান্য ভারতীয় সদস্যগণ সকলেই আইনজীবী ছিলেন। তাঁরা হলেন পণ্ডিত জগৎনারায়ণ ও সর্দার সাহিবজাদা সুলতান আহমেদ খান। এই হান্টার কমিশনের সেক্রেটারি ছিলেন এইচ সি স্টোকস। তিনি স্বরাষ্ট্র সচিবালয়ের সদস্য ছিলেন।
১৪ অক্টোবর তারিখে গঠিত হবার পর, হান্টার কমিশন ২৯ অক্টোবর, ১৯১৯ তারিখে দিল্লিতে তার প্রথম বৈঠক করেন। ১৯ নভেম্বর তারিখে কমিশন জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের পরিচালনায় থাকা কর্ণেল রেজিনাল্ড এডওয়ার্ড হ্যারি ডায়ারকে সমন করেন। কমিশনের সামনে উপস্থিত হয়ে রেজিনাল্ড ডায়ার খুব ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করে অহংসর্বস্ব ভাষায় জবাবদিহি করেন। কমিশন তাঁদের চূড়ান্ত রিপোর্ট প্রকাশ করেন ১৯২০ সালের ০৮ মার্চ তারিখে। তাতে কমিশন ঐক্যবদ্ধ হয়ে ডায়ারের আচরণের তীব্র নিন্দা করে বলেন
১. বৈশাখী মেলায় প্রতিবাদ সমাবেশটি আগে থেকে নিষিদ্ধ ঘোষণা না করে, ও জনগণকে আগে থেকে সতর্ক না করে রেজিনাল্ড ডায়ার ভুল করেছেন।
২. দীর্ঘ সময় ধরে একটানা গুলি চালিয়ে রেজিনাল্ড ডায়ার মারাত্মক ধাঁচের ত্রুটি করেছেন।
৩. রেজিনাল্ড ডায়ার তাঁর আইনি একতিয়ার অতিক্রম করে বাড়াবাড়ি করতে গিয়ে ত্রুটি করেছেন।
৪. বৈশাখী মেলায় আগত, ও সমাবেশে অংশগ্রহণ করা পঞ্জাবি জনতার তরফে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে কোনো ষড়যন্ত্রমূলক অভিসন্ধি ছিল না।
কিন্তু হান্টার কমিশন গঠনের সময়ই তাকে ব্রিটিশ সরকার যথেষ্ট দুর্বল করে রেখেছিলেন। সেই জন্মকালীন গঠনগত দুর্বলতার কারণে আইনি বিশেষজ্ঞ ও বিচারপতিদের নিয়ে গঠিত হলেও, এই কমিশন আদালতের সম মর্যাদায় অধিষ্ঠিত ছিল না। তাই সঙ্গত কারণেই রেজিনাল্ড ডায়ারকে নিন্দা করলেও, তাঁর বিরুদ্ধে কোনো দণ্ডাজ্ঞা বা কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা কমিশন নিতে পারেন নি।
তবে ভাইসরয় একজিকিউটিভ কাউন্সিল বলেছিলেন, রেজিনাল্ড ডায়ার নির্বোধের মতো ও পাষণ্ডের মতো কাজ করেছেন। দায়িত্বশীলতার সঙ্গে কর্তব্য পালন বলতে কী বোঝায়, রেজিনাল্ড ডায়ার তা বোঝেন না। এরপর ২৩ মার্চ তারিখে ওঁকে ওই উচ্চপদ থেকে অব্যাহতি দিয়ে অপসারিত করা হয়। তৃতীয় আফগান যুদ্ধে পরাক্রম প্রদর্শনের জন্য সম্মানপ্রাপক হিসেবে বিবেচিত হয়েছিলেন ডায়ার। কিন্তু ১৯২০ সালের ২৯ মার্চ তারিখে সেই সম্মানলাভের তালিকা থেকে ডায়ারের নাম অপসারণ করা হয়।
ডায়ারের নেতৃত্বে এই অমানুষিক কাণ্ডের প্রতিবাদে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সংবাদ মাধ্যম সক্রিয় হয়ে ওঠে। ডায়ারের অমানবিক কার্যকলাপের বিরুদ্ধে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন বিখ্যাত ব্রিটিশ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব উইনস্টন চার্চিল। তদানীন্তন ব্রিটিশ সরকারের যুদ্ধ বিষয়ক দপ্তরের রাষ্ট্রীয় সচিব ছিলেন তিনি। ১৯২০ সালের আট জুলাই তারিখে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় রেজিনাল্ড ডায়ারের কাজের তীব্র নিন্দা করেন তিনি। চার্চিল বলেন, নিরস্ত্র ও শান্ত জনতার উপর এহেন সীমাহীন বর্বর আক্রমণ ব্রিটিশ রাজের আধুনিক ইতিহাসে অভাবনীয়। চার্চিল লিখিতভাবে ভারতসচিবকে জানিয়েছিলেন, এই জালিয়ানওয়ালাবাগে ডায়ারের কাজ মানুষ খুন করার সমপর্যায়ের। সে কসাইয়ের মতো করে গণহত্যা করেছে।
আট জুলাই তারিখে হাউস অফ কমনস বা ব্রিটিশ পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষে চার্চিলের এই চাঁচাছোলা বক্তব্যের পর ভোটাভুটিতে ডায়ারের বিরুদ্ধে ২৪৭টি ও পক্ষে ৩৭টি ভোট পড়ে।
প্রাক্তন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এইচ এইচ আসকুইথও ডায়ারের কাজকে তীব্র ভাষায় ধিক্কার জানিয়েছিলেন।
তবে সামগ্রিক ভাবে ব্রিটিশ সরকারের তরফে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের জন্য মাথা নত করে ক্ষমা চাইবার নমনীয়তা দেখানো হয় নি। অতি সম্প্রতি ২০১৯ সালে এই ঘটনার জন্য ব্রিটিশ সরকার দুঃখপ্রকাশ করেছেন। তবে, সবাই বুঝতে পারবেন, দুঃখপ্রকাশ আর নিঃশর্তভাবে ক্ষমাপ্রার্থনা, দুটো জিনিস মৌলিক ভাবেই আলাদা।
সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থগোষ্ঠীর পক্ষে অবমানিতের পাশে দাঁড়ানো শক্ত। তাতে তার সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থটি বিপন্ন হয়। তাই ব্রিটিশ ক্ষমাপ্রার্থীর ভূমিকায় কিছুতেই যেতে চায় নি। সাম্রাজ্যবাদ মূলগতভাবে মানবতাবিরোধী। তার আইনকানুন, পার্লামেন্ট, কমিশন, সব আসলে প্রসাধন। ভারহীন শব্দের করুণ প্রদর্শনী। একথা জানতেন বলেই ভারতীয় বিপ্লবী উধম সিংহ (২৬.১২.১৮৯৯ – ৩১.০৭.১৯৪০) জালিয়ানওয়ালাবাগ কাণ্ডের নেপথ্য নায়ক স্যর মাইকেল ও’ডায়ারকে গুলিবিদ্ধ করে হত্যা করেন। ততদিনে রেজিনাল্ড ডায়ার মৃত।
তারিখটা ছিল ১৩ মার্চ, ১৯৪০। লণ্ডনের ক্যাক্সটন হলে ছিলেন স্যর মাইকেল ও’ডায়ার। উধম সিংহ তাঁকে গুলি করেন। বইয়ের মধ্যে করে লুকিয়ে মারণাস্ত্র নিয়ে গিয়েছিলেন উধম সিংহ। বছর চল্লিশের যৌবনোদ্দীপ্ত স্বাধীনতা উপাসক। তিনি গুলি করে পালিয়ে যান নি। সদর্পে আত্মসমর্পণ করেন। জালিয়ানওয়ালাবাগের নেপথ্য নায়ক মাইকেল ও’ডায়ারকে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি যে ভাষা বোঝে, সেই ভাষায় বুঝিয়ে দিয়ে তৃপ্তি লাভ করেছিলেন বিপ্লবী। তাঁকে বাঁচানোর সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়। কেননা, তিনি সহজ ও স্পষ্ট ভাষায় ডায়ারের বিরুদ্ধে পরিকল্পিত প্রতিশোধের কথা আদালতে ঘোষণা করেন। তিনি কারারুদ্ধ অবস্থায় বিয়াল্লিশ দিন অনশন ধর্মঘট করেছিলেন। লণ্ডনের কারাগারে ১৯৪০ সালের জুলাই মাসের একত্রিশ তারিখে উধম সিংহের ফাঁসি কার্যকর হয়।
উধম সিংহ স্বদেশানুরাগী মানুষের কাছে অন্যতম শ্রেষ্ঠ শহীদ হিসেবে সম্মান অর্জন করেছেন।