|| গণিত পদার্থ বিজ্ঞানী অলিভার হেভিসাইড || স্মরণলেখায় মৃদুল শ্রীমানী

অলিভার হেভিসাইড ছিলেন একজন প্রতিভাবান বিজ্ঞানী। তাঁর পছন্দের বিষয় ছিল ইলেক্ট্রোম‍্যাগনেটিজম আর ভেক্টর ক‍্যালকুলাস। জেমস ক্লার্ক ম‍্যাক্স‌ওয়েল (১৩ জুন ১৮৩১ – ৫ নভেম্বর ১৮৭৯) তাঁর সময় পর্যন্ত ইলেক্ট্রোম‍্যাগনেটিজম নিয়ে যা কিছু অগ্রগতি হয়েছিল, তার সারাৎসারটুকু কুড়িটি ভ‍্যারিয়েবল নিয়ে তৈরি কুড়িটি সমীকরণের দ্বারা প্রকাশ করেছিলেন। অলিভার হেভিসাইড ম‍্যাক্স‌ওয়েল কৃত সেই কুড়িটি সমীকরণকে গভীরভাবে অধ‍্যয়ন, পর্যবেক্ষণ ও আত্মস্থ করে দুইটি ভ‍্যারিয়েবল নিয়ে তৈরি চারটি সমীকরণে দাঁড় করিয়ে দিলেন।

অলিভার হেভিসাইড (১৮ মে ১৮৫০ – ৩ ফেব্রুয়ারি ১৯২৫) ছিলেন একজন স্বশিক্ষিত গণিতবিদ এবং পদার্থবিদ। তিনি ডিফারেন্সিয়াল ইকুয়েশন সমাধানের একটি নতুন কৌশল আবিষ্কার করেছিলেন আর স্বাধীনভাবে ভেক্টর ক‍্যালকুলাস গড়ে তুলেছিলেন।

এছাড়াও তিনি বলেছিলেন, বাতাসের উপরিতলে আয়নোস্ফিয়ার নামে একটি বিদ্যুৎ পরিবহনে সক্ষম এলাকা আছে। আরো বলেছিলেন, আয়নোস্ফিয়ার রেডিও তরঙ্গকে প্রতিফলিত করে। বলেছিলেন, ওই স্তর রেডিও তরঙ্গকে পৃথিবীর বক্রতলে চলতে সাহায্য করে, ন‌ইলে সরলরেখায় চলে রেডিও তরঙ্গ মহাশূন্যে হারিয়ে যেত।

এই কথা হেভিসাইড ১৯০২ সালের ডিসেম্বর মাসে বলেছিলেন। আজ আমরা পৃথিবীর পৃষ্ঠতলের উপর ৪৮ কিলোমিটার থেকে শুরু করে ৯৬৫ কিলোমিটার অবধি বিস্তৃত আবহমণ্ডলের স্তরকে আয়নোস্ফিয়ার বলে থাকি। এই আয়নোস্ফিয়ারের সর্বনিম্ন স্তরকে ডি স্তর বলে। আবার সর্বোচ্চ স্তরকে এফ স্তর বলে। মাঝখানে ৯০ কিলোমিটার থেকে ১৫০ কিলোমিটার অবধি বিস্তৃত এলাকাটি ই এলাকা হিসাবে চিহ্নিত। কম কড়া এক্স রশ্মি ও চড়া গোছের অতিবেগুনি রশ্মি এই ই এলাকাটিকে আয়নিত করে রেখেছে। হেভিসাইড এই অংশের সম্বন্ধে রেডিও তরঙ্গের প্রতিফলন নিয়ে বলেছিলেন। রেডিও যোগাযোগ ব‍্যবস্থার অন‍্যতম পথিকৃৎ ব্রিটিশ পদার্থবিজ্ঞানী উইলিয়াম হেনরি একলেস ( ১৮৭৫ – ১৯৬৬) ১৯১০ সালে অলিভার হেভিসাইডকে শ্রদ্ধা জানিয়ে এই অংশের নামকরণ করেন হেভিসাইড স্তর। কিন্তু পরে নজরে আসে যে ব্রিটিশ ভারতে জন্মানো একজন আমেরিকান ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার আর্থার এডুইন কেনেলি ( ১৭ ডিসেম্বর ১৮৬১ – ১৮ জুন ১৯৩৯) ওই ১৯০২ সালের গোড়ার দিকে এই স্তর নিয়ে কিছু গবেষণা করেছিলেন। হেভিসাইড এর মৃত্যু হলে, ১৯২৫ থেকে তাঁর সঙ্গে কেনেলির নাম ঐক্যবদ্ধ করে এই স্তরটি কেনেলি-হেভিসাইড স্তর হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।

অলিভার হেভিসাইডের পৈতৃক পরিবার ছিল গরিব। মা একটি বালিকা বিদ্যালয়ে পড়াতেন। সেখানেই তিনি শিশুটিকে পড়তে নিয়ে যেতেন। পড়াশুনায় মেধাবী হলেও প্রতিষ্ঠানের আগলের মধ‍্যে থাকতে তাঁর ভাল লাগত না। তাই প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশুনা তাঁর বিশেষ হয় নি। সারাজীবন ধরে কোনো প্রকৌশল সংস্থা বা বিজ্ঞান গবেষণা প্রতিষ্ঠানের দাক্ষিণ‍্য বা সাহায্য ছাড়াই হেভিসাইড পথ চলেছেন। খুব ছোটবেলায় তিনি স্কারলেট রোগের শিকার হয়ে পড়লে তাঁর শ্রবণশক্তি গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। শ্রবণজনিত সমস‍্যায় পীড়িত হয়ে শৈশব থেকেই তিনি একাকিত্বের শিকার হন। জীবিকার তাগিদে হেভিসাইড স্ব উদ‍্যোগে টেলিগ্রাফ বিদ‍্যা শিখে নেন। তারপর আরো তালিম নিতে ডেনমার্কে গিয়েছিলেন। সেটা ১৮৬৮ সাল। অলিভারের বয়স তখন আঠারো। তাঁর এক মাসি ছিলেন এমা ওয়েস্ট। মাসির সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল টেলিগ্রাফ জগতের একজন পথিকৃৎ চার্লস হুইটস্টোনের। মেসোমশায়ের যোগাযোগেই অলিভারের জন‍্য টেলিগ্রাফ ক্লার্কের কাজ জোটে। ১৮৭০ সালে তিনি কাজে ঢোকেন। বিদ‍্যুৎ ও চৌম্বকত্ব টেলিগ্রাফের কাজের মূল বৈজ্ঞানিক ভিত্তি। এই দুটি বিষয়ে তাঁর গভীর তাত্ত্বিক আগ্রহ থাকায় তিনি ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে কাজের সুযোগ পান।

প্রথমে তিনি অ্যাংলো ডেনিস টেলিগ্রাফ কোম্পানিতে যোগদান করেন। পরে নিউ ক‍্যাসলে গ্রেট নর্দার্ন টেলিগ্রাফ কোম্পানিতে যোগদান করেন। হেভিসাইড তাঁর উঁচু দরের যোগ‍্যতার জন‍্যে চিফ অপারেটর হিসাবে কাজ করতেন। এই সংস্থাটি দূর দূরান্তের দেশের সঙ্গে টেলিগ্রাফের বার্তা আদানপ্রদান করত। এই সংস্থায় কাজ করতে করতেই তিনি বিদ‍্যুৎ নিয়ে গবেষণাপত্র লিখতে থাকেন। এর প্রথমটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে। দ্বিতীয়টি প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দে। বাইশ তেইশ বছরের স্বশিক্ষিত তরুণ অলিভার হেভিসাইড অপরিসীম আত্মবিশ্বাসে নিজের লেখা টেলিগ্রাফার্স ইকুয়েশন পাঠিয়ে দিলেন বিখ্যাত পত্রিকা ফিলজফিক‍্যাল ম‍্যাগাজিনে। তা প্রকাশিত‌ হলে সে লেখা বেশ কয়েকজন গুণী পদার্থবিজ্ঞানীর নজরে এল। তাঁদের একজন বিখ্যাত গণিতপদার্থবিদ ও ইলেকট্রিক‍্যাল ইঞ্জিনিয়ার স‍্যর উ‌ইলিয়াম টমসন (২৬ জুন ১৮২৪ – ১৭ ডিসেম্বর ১৯০৭) অর্থাৎ লর্ড কেলভিন। আর আরেকজন হলেন স্কটিশ গণিতপদার্থবিদ জেমস ক্লার্ক ম‍্যাক্স‌ওয়েল ( ১৩ জুন ১৮৩১ – ৫ নভেম্বর ১৮৭৯)।

১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দে চব্বিশ এপ্রিল তারিখে ম‍্যাক্স‌ওয়েল তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ এ ট্রিটিজ অন ইলেকট্রিসিটি অ্যাণ্ড ম‍্যাগনেটিজম প্রকাশ করেন।

১৮৭৯ খ্রিস্টাব্দে আটচল্লিশ বছর বয়সে অত‍্যন্ত অসময়ে ম‍্যাক্স‌ওয়েল প্রয়াত হলেন। মৃত্যুর আগে তিনি এই ট্রিটিজ ব‌ইটির দ্বিতীয় সংস্করণ তৈরির কাজ করছিলেন। শেষ পর্যন্ত এই দ্বিতীয় সংস্করণ বের হল ১৮৮১ সালে, আরেক স্কটিশ গণিতপদার্থবিদ ও ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার উইলিয়াম ডেভিডসন নিভেন (২৪ মার্চ ১৮৪২ – ২৯ মে ১৯১৭) এর হাত ধরে।

ম‍্যাক্স‌ওয়েল তাঁর ব‌ইটির এই দ্বিতীয় সংস্করণে হেভিসাইডের গবেষণার উল্লেখ করে গিয়েছিলেন। ট্রিটিজ ব‌ইয়ে নিজের গবেষণার স্বীকৃতি মেলায় তরুণ বিজ্ঞানী অলিভার খুব অনুপ্রাণিত হন। কেননা, ম‍্যাক্স‌ওয়েল ছিলেন তাঁর সমসময়ে অত‍্যন্ত নামী বিজ্ঞানী আর তিনি পদার্থবিজ্ঞান ও গণিতের দ্বিতীয় মহা ঐক‍্যসাধন করেছিলেন।

ট্রিটিজ বেরোনোর পরেই হেভিসাইড তা পড়তে শুরু করেন। এই সময় তিনি লিখছেন: আমি ট্রিটিজ ব‌ইখানি অত‍্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে এবং সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে লক্ষ্য করেছি। আমার মনে হয়েছে, এই ব‌ইয়ের ভিতরে তড়িৎ চৌম্বক বিজ্ঞানকে অসামান্য উচ্চতায় পৌঁছে দেওয়ার প্রবল সম্ভাবনা আছে। আমি তখন এই ব‌ইটি পড়তে শুরু করি, এবং যাতে ব‌ইটি সম্পূর্ণভাবে আয়ত্ত্ব করতে পারি, তার জন্য নিষ্ঠার সঙ্গে লেগে পড়ি। ট্রিটিজ ব‌ইয়ের ভিতরে ঢুকতে আমার অনেক সময় লেগেছিল। কয়েকটি বছরের লাগাতার চেষ্টায় তবেই আমি এই ব‌ইটিকে বুঝতে শিখি। তারপর ম‍্যাক্স‌ওয়েলকে সরিয়ে রেখে আমি নিজের মতো পথ কেটে চলতে শুরু করলাম। আর দেখলাম, আমি নিজের ছন্দে অনেক দ্রুত এগিয়ে চলেছি। সমসাময়িক বিখ্যাত আইরিশ পদার্থবিদ জর্জ ফিটজেরাল্ড ( ৩ আগস্ট ১৮৫১ – ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯০১) লিখেছিলেন, মহামতি ম‍্যাক্স‌ওয়েলের ‘ট্রিটিজ’ ভয়ংকর সব যুদ্ধের কারণে চূর্ণ বিচূর্ণ প্রস্তরখণ্ডে সমাকীর্ণ। তার মধ‍্য দিয়ে পাঠককে বহু কষ্টে পথ চলতে হয়। অলিভার হেভিসাইড তাঁর অসামান্য মেধায় সেই সব কঠিন বন্ধুর রুক্ষ পথ অনেক সহজ সরল করে চ‌ওড়া রাস্তা বানিয়ে একটা সমতল বিস্তৃত অঙ্গনে পাঠককে পৌঁছে যেতে সহযোগিতা করেছেন।

অলিভার হেভিসাইড ম‍্যাক্স‌ওয়েলের সমীকরণগুলিকে যে রূপ দিয়েছিলেন, আজও সাধারণভাবে তা সেভাবেই পাঠ করা হয়। টেলিগ্রাফ বার্তা প্রেরণ নিয়ে হেভিসাইড যে গাণিতিক সমীকরণ তৈরি করেন, দীর্ঘদিন অবজ্ঞার অন্ধকারে পড়ে থাকলেও তা শেষ পর্যন্ত স্বীকৃতি পেয়েছিল। সমসাময়িক বৈজ্ঞানিক সমাজ ও সংস্থাগুলি স্বশিক্ষিত হেভিসাইডকে মান‍্যতা ও স্বীকৃতি দানে কুণ্ঠিত হলেও, তিনি যে দূরসঞ্চার বা টেলিকমিউনিকেশন জগৎকে, গণিত এবং বিজ্ঞানের সুচারু প্রয়োগে পাল্টে দিয়েছিলেন, সেটা সত‍্য। হেভিসাইড ট্রান্সমিশন লাইন তত্ত্ব গড়ে তুলেছিলেন, যাকে টেলিগ্রাফারের সমীকরণ বলেও চেনানো হয়। এই সমীকরণটির দৌলতে আটলান্টিক মহাসাগরের নিচে পাতা টেলিগ্রাফের তারের মাধ‍্যমে বার্তাপ্রেরণের হারকে তিনি এক ধাক্কায় দশগুণ বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। আগে যে তার একটি ক‍্যারেকটার এপার থেকে বহন করে ওপারে নিয়ে যেতে দশ মিনিট সময় নিত, হেভিসাইডের গাণিতিক অবদানের ফলে তা মিনিটে একটি ক‍্যারেকটারে উন্নীত হল। টেলিফোনের তারের ক্ষেত্রেও বিদ্যুৎ প্রবাহের কারণে তৈরি চৌম্বক ক্ষেত্রের প্রভাবে বিদ্যুৎ প্রবাহ চলতে কিছু সমস্যা হয়। অলিভার হেভিসাইড এই সমস্ত সমস্যার সমাধান করেন, এবং ১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে ইনডাকট‍্যান্স এর ধারণা ও সংজ্ঞা দেন। তড়িৎ চৌম্বক তত্ত্বে ব‍্যবহৃত অনেকগুলি ধারণার নাম হেভিসাইড দিয়েছিলেন। এগুলি হল, অ্যাডমিট‍্যান্স, ইলাসট‍্যান্স, কনডাকট‍্যান্স, ইলেকট্রেট, ইমপেড‍্যান্স, পারমিয়াবিলিটি, পারমিট‍্যান্স এবং রিলাকট‍্যান্স। পারমিট‍্যান্সকে এখন ক‍্যাপাসিট‍্যান্স বলা হয়।

টেলিগ্রাফ নিয়ে বিস্তর গাণিতিক সাধনা করলেও তিনি টেলিগ্রাফ কোম্পানির চাকরিতে বেশিদিন টিঁকতে পারেন নি। ছোটবেলায় যে অসুখে হেভিসাইড বধিরতার সমস‍্যায় আক্রান্ত হন, সেটিই অনেক বেড়ে গিয়েছিল। তার উপর জুটেছিল স্বাস্থ্যের সমস্যা। ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে টেলিগ্রাফ কোম্পানির চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে নিজেকে পূর্ণমাত্রায় বৈজ্ঞানিক গবেষণার কাজে উৎসর্গ করে দেন। নিয়মিত রোজগার না থাকায় সায়েন্স জার্নালে আর্টিকল লিখে দিন গুজরান করতেন। সারা জীবনে সঙ্গী ছিল গরিবানা। প্রচণ্ড মেধাবী হলেও তিনি একা একা বিচ্ছিন্নভাবে থাকতে পছন্দ করতেন। হয়তো একটু খ‍্যাপাটে গোছের লোক‌ই ছিলেন। লোকেও তাঁকে বিশেষ বুঝতে পারত না। কোনো টেকনিক্যাল বা বৈজ্ঞানিক গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত না থেকেই হেভিসাইড একক প্রচেষ্টায় গবেষণা চালিয়ে গিয়েছেন। অনেক সময় তিনি সমসাময়িক বৈজ্ঞানিকদের সম্বন্ধে ধারণা পোষণ করতেন যে তাঁরা বুদ্ধিগত সামর্থ্যে তাঁর চেয়ে হীন। এই কারণে অনেকের সঙ্গেই তাঁর বনত না, এবং শত্রুতা বেড়ে চলত। বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকতে থাকতেই তিনি বৈজ্ঞানিক গবেষণা পত্রগুলি দি ইলেক্ট্রিশিয়ান নামে ইলেকট্রিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ক ইংরেজি জার্নালে পাঠিয়ে দিতেন। ১৮৮৫, ১৮৮৬ ও ১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দে তড়িৎ চৌম্বকীয় আবেশ এবং তার ছড়িয়ে পড়া নিয়ে এই দি ইলেক্ট্রিশিয়ান জার্নালে তাঁর সন্দর্ভগুলি প্রকাশিত হয়েছিল। এরপরে এই সন্দর্ভগুলি গ্রন্থবদ্ধ হয়ে খণ্ডে খণ্ডে প্রকাশিত হতে থাকে। ইলেকট্রিক‍্যল পেপার্স ব‌ইয়ের প্রথম খণ্ড বেরোলো ১৮৯২ তে। ওর দ্বিতীয় খণ্ড প্রকাশ পেল ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দে। অন অপারেটর্স ইন ফিজিক্যাল ম‍্যাথেমেটিক্স এর প্রথম খণ্ড বেরিয়েছিল ১৮৯২ তে। ১৮৯৩ তে বেরোলো তার দ্বিতীয় খণ্ড।

ইলেক্ট্রোম‍্যাগনেটিক থিওরি হেভিসাইডের আরেকটি বিখ্যাত ব‌ই। এটি তিন খণ্ডে লেখা হয়েছিল। প্রথম খণ্ড বেরোয় ১৮৯৩ তে। ১৮৯৯ এ দ্বিতীয় এবং ১৯১২ তে এর তৃতীয় খণ্ড প্রকাশিত হয়। হেভিসাইডের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনের সময়, ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে তিনটি খণ্ড একত্রিত করে ইলেক্ট্রোম‍্যাগনেটিক থিওরির অখণ্ড সংস্করণ প্রকাশিত হয়।

১৮৯১ খ্রিস্টাব্দে অলিভার হেভিসাইড রয়‍্যাল সোসাইটির ফেলো নির্বাচিত হন। সম্ভবতঃ এটিই হেভিসাইডের জীবৎকালে প্রাপ্ত সবচাইতে বড় প্রাতিষ্ঠানিক মান‍্যতালাভ।

তড়িৎচৌম্বক তত্ত্বের ইতিহাস গবেষক অধ্যাপক জেড জেড বাখ‌ওয়াল্ড ( ১৯৪৯- ) তাঁ ‘ম‍্যাক্স‌ওয়েল টু মাইক্রোফিজিক্স’ গ্রন্থে লিখেছেন, অলিভার হেভিসাইড ছিলেন একজন গণিত চিন্তাবিদ, যিনি তাঁর মেধার প্রাপ‍্য স্বীকৃতি পান নি।

তবে হেভিসাইডকে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন লর্ড কেলভিন। ১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দে ইনস্টিটিউট অফ ইলেকট্রিক‍্যাল ইঞ্জিনিয়ারস এর একটি সভায় সভাপতির ভাষণে লর্ড কেলভিন চল্লিশ ছুঁই ছুঁই হেভিসাইডকে বৈদ্যুতিক তত্ত্বের একজন অথরিটি বলে বর্ণনা করেছিলেন।

এডমণ্ড হুইটটেকার (১৮৭৩ – ১৯৫৬) নামে বিশিষ্ট ফলিত গণিতবিদ ও গণিতের ইতিহাস গবেষক হেভিসাইডের অপারেশনাল ক‍্যালকুলাসকে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধের সবচাইতে বড় তিনটি আবিষ্কারের অন‍্যতম বলে মনে করতেন।

বাতাসের আয়নোস্ফিয়ারে অলিভার হেভিসাইড যেন মিলে মিশে রয়েছেন। ১২ ডিসেম্বর ১৯০১ গুগলিয়েমো মার্কনি আন্দাজ করেন তাঁর প্রেরিত বার্তা আকাশের কোনো একটা আয়নিত স্তর থেকে প্রতিফলিত হয়ে কার্যকারিতা বাড়িয়েছে। আর্থার এডুইন কেনেলি ও পরে হেভিসাইড এ নিয়ে গবেষণা করেন। যে স্তরের কথা তাঁরা ১৯০২ সালে ভেবেছিলেন, উইলিয়াম হেনরি একলেস ১৯১০ খ্রিস্টাব্দ থেকে তাকে হেভিসাইড স্তর বলা শুরু করেন। এই স্তরটি যে বাস্তবেই আছে, গবেষণা করে তা জানলেন এড‌ওয়ার্ড ভি অ্যাপলটন ও মিলেস বারনেট। সেটা ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দ। এটাকে তখনো হেভিসাইড স্তর বলা হত। ১৯২৫ এ আমেরিকান গবেষক গ্রেগরি বেইট এবং মার্ল এ টুভে এই হেভিসাইড স্তরের বিবিধ বৈচিত্র্য ও বৈশিষ্ট্য নিয়ে তথ‍্যসমৃদ্ধ গবেষণা করলেন। তাঁরা হেভিসাইড স্তরের উচ্চাবচতার ম‍্যাপ তৈরি করে ফেললেন। এই ১৯২৫ থেকেই আর্থার এডুইন কেনেলির গবেষণার স্বীকৃতি দিতে হেভিসাইডের সঙ্গে তাঁর নামটি যুক্ত হয়। ১৯২৫ সালে প্রবীণ অবস্থায় হেভিসাইডের জীবনাবসান হল। এরপর ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে স্কটিশ পদার্থবিজ্ঞানী রবার্ট ওয়াটসন ওয়াট আয়নোস্ফিয়ার নামটি দেন। ১৯২৭ এ অ্যাপলটন সামগ্রিক ভাবে আয়নোস্ফিয়ার এর অস্তিত্ব নিশ্চিত করেছিলেন। এইসূত্রে তিনি ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন।

এখন হেভিসাইড স্তরকে আয়নোস্ফিয়ারের ‘ই’ স্তর বলে চেনানো হয়। ১৯৭০ সালে ব্রিটিশ পদার্থবিজ্ঞানী লুই মাগলটন রেডিও তরঙ্গের শোষণ ও প্রতিফলন বিষয়ে গবেষণা করেছেন।

হেভিসাইডের একক নিঃসঙ্গ জীবন যাত্রা, প্রয়োজন বোধকে অতি অল্পে সীমিত রাখা, এবং নিছক মেধাগত পরিশ্রমের বিনিময়ে রুটি রুজি অনেকের মনে সম্ভ্রম উৎপাদন করেছিল। জাগতিক ভোগ বিলাসের হাতছানির বিপরীত মেরুতে হেভিসাইডের সাধুর মতো নির্জন জীবন যাত্রা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সম্ভাবনাপূর্ণ পৃথিবীতে এক অন‍্যরকম মাত্রা পেয়েছিল। ইংরেজ মহাকবি টমাস স্টার্নস এলিয়ট ( ১৮৮৮ -১৯৬৫) অলিভার হেভিসাইডের একক নির্জন জ্ঞানসাধনার কথা জানতেন। একেই তিনি আয়নোস্ফিয়ার এর হেভিসাইড স্তরের সঙ্গে মিলিয়ে দিয়েছিলেন। এলিয়ট তাঁর একটি নাটক দি ফ‍্যামিলি ইউনিয়ন (১৯৩৯) এ এই হেভিসাইড স্তরের কথা বলেন। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে আয়নোস্ফিয়ার নিয়ে গবেষণার স্বীকৃতি তে নোবেল সম্মান পেলেন এড‌ওয়ার্ড ভি অ্যাপলটন। আর ১৯৪৮ এ এলিয়ট সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করলেন‌। এই ১৯৪৮ এই জন্মেছিলেন ইংরেজ সুরকার গীতিকার অ্যান্ড্রু লয়েড ওয়েবার। তিনি এলিয়টের কবিতা ভালবাসতেন। ১৯৩৯ এ এলিয়ট লিখেছিলেন Old Possum’s Book of Practical Cats. এটা কবিতার ব‌ই। এ থেকে অ্যান্ড্রু লয়েড ওয়েবার ক‍্যাটস নামে গীতিনাট্য তৈরি করলেন। তাতে মেশালেন দি ফ‍্যামিলি রিইউনিয়ন থেকে হেভিসাইড স্তরের কথা। গান তৈরি হল জার্নি টু দি হেভিসাইড লেয়ার। সেখানে লেখা হল : up up up past the Russel Hostel/ up up up to the Heaviside Layer.

১৯৮১ তে মঞ্চস্থ হল অ্যান্ড্রু লয়েড ওয়েবার এর স্টেজ মিউজিক‍্যাল “ক‍্যাটস”। খুব মঞ্চ সফল উপস্থাপনা। দর্শক সাধারণের মন কেড়ে রেখেছিল দীর্ঘদিন।

হেভিসাইড তাঁর মৃত্যুর অনেক পরে জনতার কাছে পরিচিত হলেন তাঁর থেকে প্রায় একশত বছরের কনিষ্ঠ অ্যান্ড্রু লয়েড ওয়েবার এর হাত ধরে।

পৃথিবীতে কোনো যথার্থ সাধনা পুরোপুরি বৃথা যায় না।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।