বিস্ফোরণ থেকে বিশ্বমানবতা : জন্মদিন উপলক্ষে আলফ্রেড নোবেল স্মরণ – লিখেছেন মৃদুল শ্রীমানী

আজ ২১ অক্টোবর, আলফ্রেড বার্ণহার্ড নোবেল এর জন্মদিন। ডিনামাইট এবং ওই ধরণের উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বিস্ফোরক তৈরির জন্য এই সুইডিশ রসায়নবিদ, প্রকৌশলী ও শিল্পপতি বিখ‍্যাত ছিলেন। ১৮৩৩ সালে ওঁর জন্ম। ৬৩ বছর বয়স পার করে ১৮৯৬ সালে ডিসেম্বর মাসের ১০ তারিখে ওঁর মৃত্যু।
 আলফ্রেডের বাবার নাম ছিল ইম‍্যানুয়েল। মা ছিলেন ক‍্যারোলিন আন্দ্রিয়েতে আলসেল। খুব ছোট বয়স থেকেই আলফ্রেড ছিলেন রুগ্ন। অসুখে বেশি ভুগতেন বলে মায়ের কোল আঁকড়ে থাকা তাঁর অভ‍্যাস হয়ে গিয়েছিল। ছোট বয়স থেকেই জানার আকাঙ্ক্ষা ছিল অপরিসীম। বারুদ এবং বিস্ফোরণ নিয়ে কৌতূহল ছিল যথেষ্ট। তাঁর বাবা ইম‍্যানুয়েলের ছিল ইঞ্জিনিয়ারিং কাজকর্মের ব‍্যবসা। সেই দেখে দেখে অল্প বয়সেই ইঞ্জিনিয়ারিং এর অ আ ক খ শিখে ফেলেন আলফ্রেড। ১৬ বছর বয়সেই রসায়ন নিয়ে বেশ একটা কাজ চালানো দক্ষতা অর্জন করে ফেলেন তিনি। এই সাথে গড়গড়িয়ে বলতে পারতেন ইংরেজি ফরাসি জার্মান ও রাশিয়ান ভাষা। নিজের মাতৃভাষা সুইডিশে দখল তো ছিল‌ই।
 ইম‍্যানুয়েল নিজের এলাকায় ব‍্যবসায়ে সুবিধা করতে না পেরে বছর চারেক বয়সের আলফ্রেডকে ফেলে ১৮৩৭ সালে রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবুর্গে চলে যান। সেখানে তিনি খনি এলাকায় বিস্ফোরক আর নানারকম যন্ত্রপাতির ব‍্যবসা ফেঁদে নাম কেনেন।
১৮৪২ সালে নোবেল পরিবারের বাকি সদস্যেরা স্টকহোম ছেড়ে সেন্ট পিটার্সবুর্গে ইম‍্যানুয়েলের কাছে চলে যান। ১৮৫০ সালে রাশিয়া ছেড়ে ফ্রান্সের পারীতে এসে একবছরের জন‍্য রসায়নের পাঠ নেন আলফ্রেড। তার আগেই অবশ‍্য রসায়নে কাজ চালানো দক্ষতা তিনি অর্জন করেছিলেন। এরপর চার বছর ধরে আমেরিকায় জন এরিকসনের তত্ত্বাবধানে একটা নতুন ধাঁচের যুদ্ধজাহাজ বানানোয় শিক্ষানবিশি শুরু করেন। জাহাজটির নাম ছিল মনিটর। এটি স্টিম ইঞ্জিনে চলত। আর জলের মধ‍্যে স্ক্রু প্রপেলার চালিয়ে এগোতো। তারপর তিনি সেন্ট পিটার্সবুর্গে বাবার কাছে ফিরে এসে বাবার কারখানায় কাজ করতে থাকেন।
কারখানাটি ক্রিমিয়ার যুদ্ধের সময় সামরিক সরঞ্জাম তৈরি করত। ক্রিমিয়ার যুদ্ধ হয়েছিল ১৮৫৩র অক্টোবর থেকে ১৮৫৬র ফেব্রুয়ারি অবধি। তার একপক্ষে ছিল রাশিয়ান রা, আর অন‍্যপক্ষে ছিল ব্রিটিশ ফরাসি আর অটোমান তুর্করা।
 এই ক্রিমিয়ার যুদ্ধের সময়ই ব্রিটিশ নার্স ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল যুদ্ধে আহত সৈনিকদের সেবা শুশ্রূষাকে নার্সিং বিজ্ঞান হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন। এই ব্রিটিশ নার্স তাঁর পিতার কাছে গণিতের পাঠ নিয়েছিলেন। এবং উপযুক্ত নার্সিং করে যুদ্ধে আহত বহু সংখ‍্যক সৈন‍্যকে মোটের উপর সুস্থ করে তোলা সম্ভব, তা তিনি গাণিতিক চিত্রের মাধ্যমে কর্তৃপক্ষের কাছে প্রতিষ্ঠা করেন। যুদ্ধের ভয়াবহতা ও প্রাণহানির মধ‍্যে সিস্টার ফ্লোরেন্স যেন মানবিকতা ও সহমর্মিতার এক দীপ্ত দেবীমূর্তি। যুদ্ধজাহাজ তৈরি, বিস্ফোরক তৈরি, এইসব কাজে যিনি আগ্রহী ছিলেন, সেই আলফ্রেড যে পরবর্তীকালে সারা পৃথিবীতে শান্তি ও সুস্থিতি গড়ে তুলতে নোবেল পুরস্কার চালু করবেন, তার ইশারা ফ্লোরেন্সের জীবন থেকে কিছু মাত্র পান নি, এ আমি বলতে পারব না।
১৮৫৬ তে ক্রিমিয়ার যুদ্ধ মিটে গেলে মিলিটারি সাজ সরঞ্জামের চাহিদা পড়ে গেল। নোবেলরা চেয়েছিলেন যুদ্ধাস্ত্র আর না বানিয়ে সাধারণ জাহাজ তৈরির কাজ করবেন। কিন্তু ব‍্যবসার এই বাঁকবদল নোবেলদের কোম্পানি সামলে উঠতে পারল না। বছর তিনেক বাদে, ১৮৫৯ সালে তাঁদের কোম্পানি দেউলিয়া হয়ে গেল। বাবা মাকে নিয়ে আলফ্রেড ফিরে এলেন নিজেদের পুরোনো জায়গা সুইডেনে। তাঁর দুই ভাই রবার্ট ও লুডভিগ পড়ে র‌ইলেন রাশিয়াতে। নষ্ট হ‌ওয়া ব‍্যবসার যা কিছু খুদকুঁড়ো  এদিক ওদিক পড়েছিল, তা গুছিয়ে তুলতে। বাবার জমিতে ছোট্ট একটা ল‍্যাবরেটরি গড়ে আলফ্রেড বিস্ফোরক বানানোর পরীক্ষা নিরীক্ষা শুরু করলেন। সে সময় খনি থেকে আকরিক তোলার জন্য যে বিস্ফোরক ব‍্যবহার হত, সেই ব্ল‍্যাক পাউডার ছিল বারুদের রকমফের। এই সময়েই নাইট্রো গ্লিসারিন নামে একধরনের তরল বিস্ফোরক আবিষ্কৃত হয়। এর অন‍্য নাম ছিল গ্লাইসেরাইল ট্রাইনাইট্রেট। ১৮৪৬ সালে ইতালিয়ান রসায়নবিদ অ্যাসকানিও সবরেরো এই পদার্থটি তৈরি করেন। গাঢ় নাইট্রিক অ্যাসিড ও গাঢ় সালফিউরিক অ্যাসিডের মিশ্রণে গ্লিসারল যোগ করে এই বিস্ফোরকটি তৈরি হত। ল‍্যাবরেটরির মধ্যে এটির যে আয়তন থাকত, বিস্ফোরিত হলে তার বারোশো গুণ বেশি চেহারা হত। তাপমাত্রা পৌঁছত পাঁচ হাজার ডিগ্রি সেলসিয়াসে। চাপ তৈরি হত, সাধারণ বাতাসের চাপের কুড়ি হাজার গুণ। বাতাস ছুটত সেকেণ্ডে সাত হাজার সাতশো মিটার বা ঘণ্টায় ছাব্বিশ হাজার কিলোমিটার বেগে। কিন্তু নাইট্রো গ্লিসারিন জিনিসটা ছিল খুব সংবেদনশীল। সামান‍্য নাড়াচাড়াতেই তা বিস্ফোরিত হত। তাই এটা নিয়ে হাতে কলমে কাজ করা প্রায় অসম্ভব ছিল।
আলফ্রেড বার্ণহার্ড নোবেল ১৮৬০ সালে কাঠকয়লা বা একধরনের মাটির সঙ্গে মিশিয়ে ডিনামাইট তৈরি করার চেষ্টা করলেন। শেষমেশ ১৮৬৭তে ডিনামাইটের পেটেন্ট পেয়েছিলেন তিনি। নাইট্রো গ্লিসারিনকে আলফ্রেড নোবেল একদিনে বাগ মানাতে পারেন নি। ১৮৬৪তে কারখানার মধ্যে বিস্ফোরণ ঘটে আলফ্রেডের ছোটভাই এমিল সহ আরো অনেক ব‍্যক্তি মারা যান। যাই হোক, ডিনামাইট তৈরির পর, আলফ্রেডের সুখ‍্যাতি সারা পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। পাহাড় কেটে সুড়ঙ্গ তৈরিতে, খাল কাটতে, পাহাড়ের মধ‍্য দিয়ে রেলপথ ও সড়কপথ বানাতে ডিনামাইটের কার্যকারিতা প্রমাণ হল। ১৮৭০ ও ১৮৮০র দশক দুটিতে সারা ইউরোপ জুড়ে অনেক কারখানা আলফ্রেডের তত্ত্বাবধানে ডিনামাইট তৈরি করতে লাগল। এই সূত্রে আলফ্রেড ১৮৭৫ সালে ব্লাস্টিং জিলেটিন নামে উচ্চতর ক্ষমতাসম্পন্ন ডিনামাইট তৈরি করেন। ১৮৮৭তে  আলফ্রেড আনেন ব‍্যালিস্টাইট । তাঁর অর্থাগমে ঈর্ষান্বিত হয়ে প্রতিযোগী ব‍্যবসায়ীরা তাঁর ফরমূলা চুরি করতে চেষ্টা করেন। তাঁদের রুখতে আলফ্রেডকে দীর্ঘদিন মামলা লড়তে হয়েছে।
ইতিমধ্যে তাঁর রাশিয়ায় থেকে যাওয়া ভাইরা, লুডভিগ এবং রবার্ট কাস্পিয়ান সাগরের তীরে বর্তমান আজারবাইজানের বাকু অঞ্চলে তৈলখনি আবিষ্কার করে বিশাল ধনী হয়ে উঠলেন। তাঁদের ব‍্যবসাতে আলফ্রেডের‌ও অংশিদারিত্ব ছিল। ফলে সেই সুবাদে আলফ্রেডও বিপুল অর্থের মালিক হলেন। এই সময়ে তিনি যুদ্ধাস্ত্র তৈরির নামকরা কারখানা বোফর্স কিনে নিলেন।
আলফ্রেড বার্ণহার্ড নোবেল এক অদ্ভুত ধরনের মানুষ ছিলেন। বিপুল অর্থোপার্জন করলেও তিনি ছিলেন সাদাসিধে খানিকটা সাধুগোছের জীবনে বিশ্বাসী। তিনি আজীবন অবিবাহিত ছিলেন।
 সাহিত্য নিয়ে তাঁর আগ্রহ ছিল। নিজে বেশ কিছু কবিতা ও গদ‍্য‌ও লিখেছেন। কিন্তু গণতন্ত্রে নোবেলের আস্থা ছিল না। এমনকি মেয়েরা যে চিন্তা ভাবনা করে ভোট দিতে পারে, এও তিনি বিশ্বাস করতেন না। আলফ্রেড মোটের উপর শান্তিবাদী হলেও মানব সভ‍্যতার ভবিষ্যৎ নিয়ে তিনি আদৌ আশাবাদী ছিলেন না। অনেকে মনে করেন ১৮৮৮তে  একটি কারখানায় বিস্ফোরণের ফলে তাঁর এক ভাই লুডভিগ মারা গেলে কাগজে কাগজে খবর বেরোয় ‘মৃত‍্যুর ফেরিওয়ালা এবার নিজেই মরেছে’। খবর‌ওয়ালারা ধরেই নিয়েছিল দুর্ঘটনায় লুডভিগ নয়, বিস্ফোরণের কারবারী আলফ্রেড‌ই মারা পড়েছেন। তাঁর মৃত‍্যু্তে সংবাদ মাধ‍্যম যে এতখানি উল্লসিত হয়ে তাঁকে “মৃত্যুর ফেরিওয়ালা” বলতে পারে, এ ঘটনাটা তাঁকে খুব মর্মাহত করেছিল।
১৮৯৫ সালে আলফ্রেড নোবেল অ্যানজিনা পেকটোরিস নামে হৃৎপিণ্ডের অসুখে ভুগতে থাকেন। এর সূত্র ধরেই ১৮৯৬ সালে ইতালির সান রেমো তে নিজের আবাসে ৬৩ বৎসর বয়সে তিনি সেরিব্রাল হেমারেজে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।
মৃত্যুর বছরখানেক আগে ১৮৯৫ সালের ২৭ নভেম্বর, তিনি তাঁর বিখ্যাত উইলটি সম্পাদনা করেন । তাঁর বিপুল অর্থভাণ্ডারের প্রায় সমস্তটা দিয়েই তিনি পদার্থবিজ্ঞান রসায়ন বিজ্ঞান, চিকিৎসা বিজ্ঞান, সাহিত্য ও বিশ্বশান্তির সেরা গুণীদের জন‍্য নোবেল পুরস্কারের বন্দোবস্ত করেন। তাঁর পঞ্চম মৃত‍্যুবার্ষিকীতে ১৯০১ সালের ডিসেম্বর মাসের ১০ তারিখে প্রথম নোবেল পুরস্কার বিতরণ করা হয়। পরে, ১৯৬৯ সাল থেকে অর্থনীতিতেও নোবেল সম্মান দেওয়া হতে থাকে।নোবেলের মৃত্যুর পর তাঁর উ‌ইলটি কার্যকর করতে ‘নোবেল ফাউন্ডেশন’ প্রতিষ্ঠিত হয়। তার সূত্রে পুরস্কার প্রাপক বাছাইয়ের জন‍্য চারটি পৃথক পৃথক প্রতিষ্ঠান তৈরি করা হয়।
এর মধ্যে রয়‍্যাল সুইডিশ অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্স পদার্থবিজ্ঞান রসায়ন ও অর্থনীতিতে পুরস্কার প্রাপকদের মনোনীত করে। ক‍্যারোলিনস্কা ইনস্টিটিউট যা তাঁর মায়ের স্মৃতিবাহিনী, সেই প্রতিষ্ঠান চিকিৎসা বিজ্ঞানের পুরস্কার প্রাপকদের মনোনীত করে। সুইডিশ অ্যাকাডেমি নোবেল সাহিত্য পুরস্কার দেয়। এই তিনটিই সুইডেনের সংস্থা। বিশ্বশান্তির পুরস্কার দেয় নর‌ওয়ের নোবেল কমিটি।
নোবেল ফাউন্ডেশন সবার উপরে কাজ করে। কিন্তু কোনো প্রতিষ্ঠানের সিদ্ধান্তে নাক গলায় না। প্রত‍্যেক বছর অক্টোবর বা নভেম্বরে নোবেল পুরস্কার ঘোষণা হলেও তার বছরখানেক আগে থেকেই উপযুক্ত প্রাপককে সন্ধান করার পর্ব শুরু হয়।
প্রত‍্যেকটি আলাদা আলাদা বিষয়ে গড়ে প্রায় একহাজার জন ব‍্যক্তি মনোনয়নকারী হিসেবে প্রাপকের নাম পেশ করেন। এই রকম প্রস্তাবকরা সব মিলিয়ে সংখ‍্যায় প্রায় ছয় হাজার। এঁরা কেউ প্রাক্তন নোবেল পুরস্কার বিজয়ী, কেউ পুরস্কার মনোনয়ন সংস্থার সদস্য, কেউ বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার সুপরিচিত পণ্ডিত, কেউবা নামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ও শিক্ষণ সংস্থার সাথে যুক্ত। এঁরা কোন্ ব‍্যক্তিকে কী অবদানের জন্য মনোনীত করছেন, তা ওই চারটি সংস্থাকে লিখিত ভাবে জানান। তারপর শুরু হয় ঝাড়াই বাছাই পর্ব।
নোবেল পুরস্কার জীবিত ব‍্যক্তিকেই দেবার নিয়ম। দৈবাৎ বার তিনেক মৃত ব‍্যক্তিকেও দেওয়া হয়েছে। শান্তি পুরস্কার কখনো কখনো ব‍্যক্তির পরিবর্তে সংস্থাকেও দেওয়া হয়েছে। এই রকম নামকরা সংস্থার মধ‍্যে রেডক্রস তিনবার নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। এ বৎসর ২০২০ তে বিশ্বশান্তি নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রাম।
কখনো কখনো বিশ্বখ্যাত ব‍্যক্তিরা নোবেল সম্মান বর্জন করেছেন। এঁদের মধ‍্যে সাহিত‍্যিক ও দার্শনিক জাঁ পল সার্ত্র বিখ্যাত। কোনো কোনো সাহিত‍্যিক নোবেল পুরস্কারের সম্মানটুকু নিলেও, অর্থমূল্য নিতে অস্বীকার করেছেন। এঁদের মধ্যে বিখ্যাত আইরিশ নাট‍্যকার জর্জ বার্ণার্ড শ। কোনো কোনো ব‍্যক্তি একাধিক বার নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। যেমন বিজ্ঞানী মারি কুরি। কিন্তু এক‌ই ব‍্যক্তিকে এক‌ই বিষয়ে একাধিক বার পুরস্কার নোবেল কমিটি দেন না।
মারি কুরি একবার ১৯০৩ সালে পদার্থবিজ্ঞানে ও আর একবার ১৯১১ সালে রসায়ন বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। অনেক পরিবারের একাধিক গুণী মানুষ নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন।  মারি কুরির পরিবার এঁদের মধ্যে অন‍্যতম।
অশান্তির পরিবেশে কখনো কখনো নোবেল পুরস্কার দেওয়া বন্ধ থেকেছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এই ঘটনা ঘটেছে।
ভারতে জন্মেছেন, এবং ভারতীয় নাগরিক, বা কোনোভাবে ভারতের সাথে যুক্ত, যাঁরা নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন, তাঁদের মধ্যে সবচাইতে বিখ্যাত বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ১৯১৩ সালে, নিজের গোটা দশেক বাংলা কবিতার বই থেকে বাছাই করা কবিতার ই‍ংরেজি অনুবাদ করে সঙ অফারিংস নাম দিয়ে তিনি প্রকাশ করেন। এইসূত্রে তিনি নোবেল সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছিলেন। চন্দ্রশেখর ভেঙ্কটরমণ, হরগোবিন্দ খোরানা, মাদার টেরেসা, সুব্রহ্মণ‍্যম চন্দ্রশেখর, অমর্ত্য সেন, বিদ‍্যাধর সুরজপ্রসাদ নয়পল, ভেঙ্কটরমণ রামকৃষ্ণণ, কৈলাস সত‍্যার্থী, অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ‍্যোপাধ‍্যায়, ভারতীয় বা ভারতের সাথে যুক্ত এই পরিচয়ে নোবেল সম্মানিত হয়েছেন।
১৯০১ সালের ডিসেম্বর মাসে আলফ্রেড নোবেলের পঞ্চম মৃত্যু বার্ষিকীতে নোবেল পুরস্কার বিতরণ শুরু হয়। পদার্থবিজ্ঞানে প্রথম নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন উইলহেলম কনরাড রণ্টজেন। তিনি এক্স রে পদ্ধতিতে ছবি তুলে চিকিৎসার যুগান্তর ঘটান। ওই বৎসরে রসায়ন বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন জ‍্যাকোবাস এইচ ভ‍্যান টি হফ। গাছ এবং প্রাণীর জীবনে তরলের চাপ নিয়ে যুগান্তকারী গবেষণা করেন তিনি। ডিপথেরিয়া নামক সাংঘাতিক অসুখের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলে এমিল ভন বেহরিং চিকিৎসা বিজ্ঞানে প্রথম নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। যাঁর ইঞ্জিনিয়ার হ‌ওয়ার ইচ্ছে ছিল, তিনি চোখের অসুখে আক্রান্ত হয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া ছাড়তে বাধ্য হয়ে সাহিত্যচর্চায় মনোনিবেশ করেন। সাহিত্য সেবায় প্রাণ ঢেলে দিয়ে ফ্রান্সের সুলি প্রুধোঁ প্রথম নোবেল সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছিলেন। প্রথমবারের জন‍্য নোবেল বিশ্বশান্তি পুরস্কার যৌথ ভাবে পেয়েছিলেন হেনরি ডুনান্ট এবং ফ্রেডরিক পাসি। এঁদের মধ্যে ডুনান্ট ছিলেন আন্তর্জাতিক রেডক্রসের প্রতিষ্ঠাতা।
২০২০ সালের নোবেল শান্তি পুরস্কার ঘোষণা করেছেন নর‌ওয়ের নোবেল কমিটি। তারিখটি ছিল ৯ অক্টোবর, শুক্রবার। বিশ্ব খাদ‍্য কর্মসূচিকে এই পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। পুরস্কারের অর্থমূল্য নব্ব‌ই লক্ষ সুইডিশ ক্রোনর। দুশো একুশ জন ব‍্যক্তি ও একশো সাতটি সংস্থা, এই মোট তিনশো আঠারো জন দাবিদারের মধ‍্য থেকে বিশ্ব খাদ‍্য কর্মসূচি কে বেছে নিয়ে নোবেল কমিটি বিশ্বজোড়া মারণ ভাইরাস করোনার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাদ‍্যের গুরুত্বকে স্বীকৃতি দিয়েছেন।
২০২০তে পদার্থবিজ্ঞানে রজার পেনরোজ, রেইনহার্ড গেঞ্জেল, এবং আন্দ্রেয়া এম ঘেজ এই ত্রয়ী যৌথভাবে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন।
রসায়নে যৌথভাবে  নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন ইম‍্যানুয়েল কার্পেন্তিয়ের এবং জেনিফার এ দোদনা।
চিকিৎসা বিজ্ঞানে যৌথভাবে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন হার্ভে জে অল্টার, মাইকেল হাউটন এবং চার্লস এম রাইস, এই ত্রয়ী।
 সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন আমেরিকান কবি লুইস গ্লাক। অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন দুজন। দুজনেই আমেরিকান। তাঁরা হলেন পল আর মিলগ্রোম, এবং রবার্ট বি উইলসন।
 নোবেল প্রাপ্তির ইতিহাসে প্রাপকরা যে সব বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে যুক্ত, তাদের সংখ‍্যার অনুপাতে স্থানাঙ্ক বিচার করলে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থান প্রথম। তারপরেই কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়। ক্রমে কালিফরনিয়া, চিকাগো, মাসাচুসেটস, কলম্বিয়া, স্ট‍্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থান। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে একশো একষট্টি জন নোবেল প্রাপক যুক্ত। এবং কেমব্রিজের সঙ্গে একশো একুশ জন নোবেল প্রাপক যুক্ত।
দেশ হিসেবে আমেরিকা সবচাইতে বেশি নোবেল পুরস্কার পেয়েছে। তার নোবেল পুরস্কার প্রাপকের সংখ‍্যা সব মিলিয়ে তিনশো ছত্রিশ। এরপরই আছে ইংল্যান্ডের স্থান। একাধিক বার নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন চারজন ব‍্যক্তি। মারি কুরি, ফ্রেডরিক স‍্যাঙ্গার, লিনাস পাউলিং, জন বারডীন।
এক‌ই সাথে নোবেল এবং অস্কার সম্মানে ভূষিত হয়েছেন জর্জ বার্নার্ড শ আর বব ডিলান। বিশ্বশান্তির মহান ব‍্যক্তিত্ব মহাত্মা গান্ধী নোবেল পুরস্কার পাননি। কিন্তু সাত বার তাঁর নাম নোবেল পুরস্কার পাবার যোগ্য হিসেবে গুণী পণ্ডিত ব‍্যক্তিরা মনোনীত করেছিলেন।
পৃথিবীর মধ‍্যে সবচাইতে বেশি বার নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন মাদাম মারি কুরির পরিবার। ১৯০৩ সালে তিনি তাঁর স্বামী পিয়ের কুরি এবং আরেক জন বিজ্ঞানী হেনরি বেকারেলের সাথে একযোগে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। ১৯১১ সালে মারি কুরি পুনরায় রসায়ন বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পান। ১৯৩৫ সালে তার জ‍্যেষ্ঠা কন‍্যা আইরিন ও তাঁর জামাতা পিয়ের জোলিয়ট একযোগে রসায়নে নোবেল পুরস্কার পান।
 মহিলারা সব মিলিয়ে তিপ্পান্নবার নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। এর মধ‍্যে প্রথম মারি কুরি। তাঁর পরে‌ই ১৯০৫ সালে বার্থা ভন সুদনার নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়েছেন।
প্রথম মুসলিম মহিলা নোবেল পুরস্কার বিজয়িনী হয়েছেন ডঃ শিরিন এবাদী। ২০০৩ সালে তিনি নোবেল বিশ্বশান্তি পুরস্কার পেয়েছেন। বিশ্বের কনিষ্ঠতম নোবেল পুরস্কার প্রাপক একজন মুসলিম কিশোরী। ২০১৪ সালে সতেরো বছর বয়সে মালালা ইউসুফজাই  নোবেল বিশ্বশান্তি পুরস্কার পেয়েছিলেন।
 কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের মধ্যে বারোজন নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়েছেন। তিনজন পেয়েছেন নোবেল সাহিত্য পুরস্কার। একজন অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন । কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের মধ্যে প্রথম নোবেল সম্মানিত হয়েছিলেন ১৯৫০ সালের নোবেল বিশ্বশান্তি পুরস্কার বিজয়ী র‍্যালফ বাঞ্চ। কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের মধ্যে সর্বশেষ নোবেল পুরস্কার বিজয়ী হলেন অ্যাবি আহমেদ। তিনি ২০১৯ সালে নোবেল বিশ্বশান্তি পুরস্কার পেয়েছেন। ২০০৯ সালে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা নোবেল বিশ্বশান্তি পুরস্কার পেয়েছেন।
মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রথম নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন মিশরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার আল সাদাত। ১৯৭৮ সালে তিনি বিশ্বশান্তি পুরস্কার পেয়েছেন। পরের বছর  ১৯৭৯ এ আরেকজন মুসলিম নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। তিনি আবদুস সালাম। তাঁর বিষয় ছিল পদার্থবিজ্ঞান। অন‍্যান‍্য মুসলিম সম্প্রদায়ের অন‍্যান‍্য নোবেলজয়ীদের মধ‍্যে অর্থনীতিবিদ মহম্মদ ইউনুসের নাম বলা দরকার।
গ্রামীণ ব্যাঙ্ক প্রতিষ্ঠা করে বাংলাদেশের মানুষের অর্থনৈতিক সামাজিক উন্নয়নে ভূমিকা পালন করার জন্য ২০০৬ সালে মহম্মদ ইউনুসকে নোবেল বিশ্বশান্তি পুরস্কারে ভূষিত করা হয়।
সোভিয়েত রাশিয়ার বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টিতন্ত্রের অমানবিক নিষ্ঠুরতাকে উন্মুক্ত করতে চেয়ে বিতাড়িত হয়েছেন আলেকজান্ডার সলঝেনিৎসিন। ‘গুলাগ আর্কিপেলাগো’ উপন্যাস লিখে তিনি সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টিতন্ত্রের মুখোশ খোলার চেষ্টা করেছিলেন। ১৯৭০ সালে সলঝেনিৎসিন সাহিত্যে নোবেলজয়ী হন।  এর আগে ১৯৫৮ সালে আরেক জন বরেণ্য রাশিয়ান সাহিত্য সাধক বরিস পাস্তেরনাক নোবেল সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছিলেন। ১৯৫৭ সালে বেরিয়েছিল তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস ডঃ ঝিভাগো। সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টিতন্ত্র এই উপন‍্যাসটি সে দেশে প্রকাশ করতে দেন নি। তাই উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি গোপনে ইতালিতে পাঠিয়ে প্রকাশের ব‍্যবস্থা হয়। এই ব‌ই নোবেল পুরস্কারে মনোনীত হলে সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট নেতৃত্ব অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হন এবং তাঁদের রক্তচক্ষুর চাপে বরিস পাস্তেরনাক নোবেল পুরস্কার গ্রহণে অস্বীকৃত হন। ১৯৬০ সালে লেখক ফুসফুসের ক‍্যানসারে প্রয়াত হন। ১৯৮৮ সালে সোভিয়েত রাশিয়ায় খোলা হাওয়া ব‌ইতে শুরু করলে, লেখকের উত্তরাধিকারীরা তাঁর নামে পুরস্কারটি গ্রহণ করেন।
১৯৩৩ সালে নোবেল সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছিলেন রাশিয়ান লেখক ইভান আলেক্সিয়েভিচ বুনিন। তিনিও সোভিয়েত ইউনিয়নের পার্টি নেতৃত্বের পছন্দের মানুষ ছিলেন না। তাঁর সাহিত্যরুচি ও নান্দনিক দৃষ্টিভঙ্গির সাথে সোভিয়েত কমিউনিস্ট নেতৃত্বের দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছিল। দেশ পরিত্যাগ করে বুনিন বিদেশে থাকার সিদ্ধান্ত নেন। সেই সময় তিনি সাহিত্যে নোবেলজয়ী হন।
প্রসঙ্গতঃ, সোভিয়েত ইউনিয়নের খোলা হাওয়া বহানোর কাণ্ডারী মিখাইল গোরবাচভ ১৯৯০ সালে বিশ্বশান্তি পুরস্কার পেয়েছেন।
 নোবেল পুরস্কার জাতি, ধর্ম, বর্ণ, সম্প্রদায় নির্বিশেষে লিঙ্গনিরপেক্ষ ভাবে দেওয়া হয় বলে পৃথিবীতে সবসেরা পুরস্কারগুলির প্রথমেই নজর কাড়ে।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।