গঙ্গা। গঙ্গা এলেন কেমন করে? সেই কথার গোড়ায় আছে নারদের গল্প। নারদ গান শিখেছেন। তাই শুনে রাগ রাগিণীর অবস্থা খারাপ। তারা স্বর্গে লকডাউন করে দিয়েছে। অলকাপুরীতে হৈচৈ। নারদ অপ্রস্তুত। বেজায় কাঁচুমাচু। লকডাউন উঠবে কী করে? রাগ রাগিণীরা সমবেত স্বরে বলল, আগে ভাল গান শোনাও। তবে লকডাউন উঠবে।
নারদ চললেন ভাল সংগীতকারের খোঁজে। কে এমন ব্যক্তি আছেন, যাঁর গানে লকডাউন ওঠানো সম্ভব! মনে পড়ল শিবের কথা। কথায় আছে না, ধান ভানতে শিবের গীত! তাহলে দেবাদিদেবকেই স্মরণ করা যাক। নারদের রিকোয়েস্ট ফেলতে পারেন না ভোলা মহেশ্বর। কিন্তু একটু দর কষাকষি না করলে আজকাল কেউ পাত্তা দেয় না। ত্রিশূলধারী পিনাকপাণি বললেন, তো গান যে গাইব, সমঝদার শ্রোতা তো চাই। যাকে তাকে গান শোনাতে বোলো না আমাকে। একাকী গায়কের নহে তো গান…রবি ঠাকুরের ওই কথাটা শিব ঠাকুর নারদকে শুনিয়ে দিলেন।
নারদ হাত জোড়করে বললেন, হে ত্রিগুণাতীত, হে পশুপতি, কেমন শ্রোতা পেতে ইচ্ছে করছে আপনার?
শংকর বললেন, তা বিষ্ণু আর ব্রহ্মা যদি অডিয়েন্সে থাকেন, গান গাইতে আমার আপত্তি নেই। ওঁরা না এলে, আমায় বোলো না গাহিতে বোলো না…
দুরুদুরু বক্ষে নারদ ছুটলেন বিষ্ণুলোকে, আর তারপরে ব্রহ্মার কাছে। শিব গাইবেন শুনে ওঁরা গানের আসরে আসতে রাজি হয়ে গেলেন।
বিষ্ণু আর ব্রহ্মাকে দেখে শিব মহাখুশি হয়ে গান ধরলেন। সে যে কী গান, কী গান! পায়ে পড়ি শোনো বলি গাইয়ে…
ব্রহ্মার চারটি মুখে আটটি কান। শিবের গান এককান দিয়ে শুনে আর সাতটি কান দিয়ে বের করে তিনি সুস্থ বোধ করলেন। কিন্তু বিষ্ণুর পা গলে জল হয়ে গেল। ওই গলে যাওয়া বিষ্ণুচরণ হতে গঙ্গা আবির্ভূতা হলেন।
গঙ্গা তো আবির্ভূতা হলেন। স্মার্ট আল্ট্রা মডার্ন মেয়ে গঙ্গা। তিনি অনেক কাণ্ড ঘটাবেন। গঙ্গার তীব্র যৌবনের দিকে তাকিয়ে পলক পড়ে না শিবের। সেই দেখে শিবজায়া অন্নপূর্ণা অভিমান করলেন। গঙ্গা নামে সতা তার তরঙ্গ এমনি…
ওদিকে সগর রাজার ষাটহাজার ছেলে মুনির অভিশাপে ভস্ম হয়ে রয়েছে। গঙ্গার পাবনী ধারা নইলে তারা পুনর্জীবন পায় না। তো সগররাজার বংশধর দিলীপ তপস্যা করতে করতে বুড়ো হয়ে গেলেন। তাঁর ছেলে ভগীরথ তপস্যা করতে এলেন। গঙ্গার মর্ত্যলোকে অবতরণ চাই। বহু তপস্যায় ভগীরথের প্রতি দয়া হল গঙ্গার। বেশ বাপু, তোমার জন্য আমি মর্ত্যলোকে আসছি। কিন্তু এই অ্যাত্তো উঁচু স্বর্গলোক থেকে আমি মর্ত্যলোকে নামব, আমার মোমেন্টাম কতটা হবে, আন্দাজ করতে পার? বলি, ফিজিক্স তো একটু আধটু পড়েছ?
তাই তো, অমন ভরবেগ কে ধারণ করবেন? আবার শিব। করুণাঘন শিব ভোলা মহেশ্বর। ভগীরথের কাকুতি মিনতিতে আদিনাথ তো রাজি হলেন গঙ্গার বেগ ধারণ করতে। বেশ একটা পোজ় দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন কৃত্তিবাস। এবার ঝাঁপিয়ে পড়লেন গঙ্গা। তো রসিক চূড়ামণি শিব ভরযুবতী গঙ্গার সঙ্গে একটু ফস্টিনস্টি করার উদ্দেশ্যে জটার পাকে পাকে তাকে জড়িয়ে নিলেন। গঙ্গা আর বেরোনোর পথ পান না। ভগীরথ তো কেঁদে কূল পায় না। বহু কান্নাকাটির পর শিবের ইচ্ছে হল গঙ্গার বেগ মুক্ত করেন। কিন্তু অতো জলের তোড় মর্ত্যলোকে সইবে কেন? তাই গঙ্গা কে তিনটি স্রোতে বিভক্ত হতে হল। স্বর্গে তিনি মন্দাকিনী হলেন। পাতালে হলেন ভোগবতী। আর মর্ত্যলোকে অলকানন্দা। ভগীরথের আনন্দ আর ধরে না। আগে যান ভগীরথ শঙ্খ বাজাইয়ে, পাছু পাছু যান গঙ্গা। কবি বললেন, ওগো নদী আপনবেগে পাগলপারা… কিন্তু জহ্নুমুনির আশ্রম জলস্রোতে ভেসে যেতে তিনি এক গণ্ডূষে গঙ্গার স্রোতধারা পান করে নিলেন। ভগীরথ পড়ল আরেক বিপদে। শেষে মুনিঠাকুরের পায়ে ধরে অনেক কান্নাকাটি করায় তিনি গঙ্গাকে মুক্তি দিলেন। জহ্নুমুনির অভ্যন্তর থেকে গঙ্গার মুক্তি মিলল দেখে গঙ্গার আরেকটি নাম হল জাহ্নবী। বিগলিত করুণা জাহ্নবী যমুনা। এইভাবে বহু কষ্টে সগররাজার ছেলেদের উদ্ধার হল।
তো তারপর অসামান্য রূপবতী গঙ্গা দেবসভায় ঘোরেন। মর্ত্যলোকের রাজা প্রতীপ প্রভূত পুণ্যবলে দেবসভায় এন্ট্রি পেতেন। গঙ্গা সেদিন সিথ্রু পোশাক পরে সভায় গিয়েছিলেন। পবনদেব একটু দুষ্টুমি করে গঙ্গার মসলিনটা উড়িয়ে দিলেন। অলক মেঘের মতো ঊর্ধ্বাকাশে ভেসে গেল বরবর্ণিনীর পোশাক। গঙ্গা পোস্ট মডার্ন মেয়ে। বডি শেমিং মানেন না। নিলাজ সুন্দরী হাসিমুখে রইলেন দাঁড়িয়ে। দেবতাদের মন চঞ্চল হয় না। চঞ্চল হল একটা মানুষের। তিনি মর্ত্যলোকের রাজচক্রবর্তী প্রতীপ। দেবসভা হতে বিদায়ের ঘণ্টা বাজল প্রতীপের।
মর্ত্যে কুলুকুলু বইছে পতিতপাবনী। প্রতীপ স্বচ্ছতোয়া নদীর তীরে ভাবাবিষ্ট হয়ে বসে। গঙ্গার অনিন্দ্যকান্তি তাঁর চোখে ভাসছে। বত্তিচেল্লি যেমন করে বার্থ অফ ভেনাস এঁকেছেন, রবীন্দ্রনাথ যেমন করে বলেছেন, কুন্দশুভ্র নগ্নকান্তি সুরেন্দ্রবন্দিতা/ তুমি অনিন্দিতা…. মুক্তবেণী বিবসনে, বিকশিত বিশ্ববাসনার/ অরবিন্দ-মাঝখানে পাদপদ্ম রেখেছ তোমার/ অতি লঘুভার, এমন করেই ভাবছিলেন প্রতীপ। এমন সময় গঙ্গা এসে তাঁর কোলে বসলেন।
কন্যা এবং প্রেয়সী, কে কোন্ কোলে বসবেন, তা শাস্ত্রমতে নির্দিষ্ট আছে। গঙ্গা তো অতসব জানেন না। কিন্তু প্রতীপ জানেন। রাজাকে লোকধর্ম মেনে চলতে হয়। প্রতীপ স্থির করলেন গঙ্গা তাঁর পুত্রবধূ হবেন। পুত্র শান্তনুর সঙ্গে বিবাহ হল গঙ্গার।
বিয়ে হলে বেশিরভাগ মেয়েই ন্যাতাজোবড়া হয়ে যায়। গঙ্গা তো তেমন মেয়ে নন। আল্ট্রা মডার্ন কন্যে গঙ্গা শান্তনুকে শুনিয়ে দিলেন, রাজার ব্যাটা হও আর যাই হও, আমি তোমার কথা শুনে চলতে পারব না। তোমাকেই আমার কথায় উঠতে বসতে হবে। গঙ্গার মারকাটারি রূপে শান্তনু ফিদা হয়ে আছেন। যা বলবেন তাতেই রাজি। ওই লক্ষ্য করেই বার্ট্রান্ড রাসেলের মনে বিয়ে সম্বন্ধে অতো কিছু মনে হয়েছিল। ম্যারেজেস অ্যাণ্ড মরালস নামে বইই লিখে ফেললেন তিনি। তো সংসার চলছে। গঙ্গার কথায় শান্তনু ওঠেন, বসেন। এদিকে অষ্টবসু এক মুনির কোপে মর্ত্যে জন্মাতে বাধ্য হলেন। তাঁরা গঙ্গার সঙ্গে কন্ট্রাক্ট করলেন। তাঁরা গঙ্গার সন্তান হিসেবে জন্মগ্রহণ করবেন। আর জন্মের পরেই গঙ্গা তাঁদের জলে ভাসিয়ে মুক্তি দেবেন। যে কথা সেই কাজ। একটা করে বাচ্চা প্রসব হয়, আর তাকে ভাসিয়ে দেন মা। শান্তনুর বুক হু হু করে। নাড়ি ছেঁড়া ধনকে এভাবে কেউ ভাসিয়ে দিতে পারে? হ্যাঁ পারে। পৃথা কুন্তী পেরেছিলেন কর্ণকে ভাসিয়ে দিতে। সে অবশ্য অনেক পরের কথা। শেষ বাচ্চাটার বেলা শান্তনু আর থাকতে পারলেন না। আপত্তি তুললেন। ঠোঁট বেঁকিয়ে গঙ্গা বললেন, রইল তোমার ঘরসংসার, আমার সঙ্গে চুক্তি করেছিলে, সবসময় হরবখৎ আমার কথায় উঠবে বসবে। তা যখন ভাঙলে, তোমার উপর আর কোনো মায়া নেই আমার। আমি চললুম। হাঁ হয়ে গেলেন শান্তনু। ছোট ছেলেটা বেশ বড় হয়ে গেল একদিন। নাম হল দেবব্রত। তারপর ভীষণ একটা প্রতিজ্ঞা করে ভীষ্ম।
ভীষ্ম হয়েছিলেন। কিন্তু মাকে ভুলতে পারেননি। কোনো বীর সন্তানই মাকে ভুলতে পারে না। কর্ণকুন্তী সংবাদে আলগোছে সে কথা শুনিয়ে রেখেছেন রবীন্দ্রনাথ। কর্ণ কুন্তীকে বলেছেন, তব কণ্ঠস্বর / যেন পূর্বজন্ম হতে পশি কর্ণ-‘পর/ জাগাইছে অপূর্ব বেদনা। কর্ণ বলছেন, আজ রাতে / অর্জুনজননী কণ্ঠে কেন শুনিলাম/ আমার মাতার স্নেহস্বর!
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে শিখণ্ডীকে দেখে অস্ত্র ত্যাগ করেন কৌরবদের সেনাপতি ভীষ্ম। তারপর শরশয্যা ও ইচ্ছামৃত্যু। তৃষ্ণার্ত পিতামহের জন্য সুবর্ণভৃঙ্গারে সুপেয় জল আনিয়ে ছিলেন দুর্যোধন। ভীষ্ম সেই জল গ্রহণ করেন নি। তৃতীয় পাণ্ডব বুঝতে পেরেছিলেন, ইচ্ছামৃত্যুকালে শরীর ছেড়ে যাবার আগে মাতৃস্তন্য পুণ্যপীযূষধারা প্রার্থনা করছেন অষ্টবসুর শেষ বসু। কৌন্তেয় অর্জুন শরসন্ধান করে পাতালে তীর ছুঁড়লেন। ছলকে উঠল ভোগবতীর স্রোত। গভীর তৃপ্তিতে সেই উৎসারিত জল পান করলেন পিতামহ ভীষ্ম। তাঁর গঙ্গাপ্রাপ্তি হল।
আজ গঙ্গা পূজা। নদীকে যেন আমরা লোভের পাশে না বাঁধি। নদীকে নদীর মতো থাকতে দিই।