রম্য রচনায় মৃদুল শ্রীমানী

ধর্ম মূষিক কথা
মহারাজ যুধিষ্ঠির রাজপেয় যজ্ঞ সমাধা করিয়াছেন। অতঃপর ভ্রাতাগণকে লইয়া দরবারে বসিয়াছেন। ময়ূর, রাজহংস, শুকপক্ষী, পারাবত ইত্যাদি রাজপ্রসাদপুষ্ট সকল পোষ্য একে একে সুললিত ভাষায় বিশেষণমণ্ডিত করিয়া গুণকীর্তন করিতেছে। মহারাজ আহ্লাদে ভাসিতেছেন। একে একে তিনি পোষ্যদের ডাকিতেছেন, বলিতেছেন, তোমার কেমন লাগিল! অমনি পোষ্যটি গদগদস্বরে মহারাজের গুণব্যাখ্যান শুরু করে। এমন সময় একটি ইঁদুর মূর্তিমান রসভঙ্গের মতো বলিল, মহারাজ, আমার কিছু বলিবার আছে।
যুধিষ্ঠির ইঁদুর দেখিয়া বিরক্ত হইয়া চাকর বাকরদের দিকে তাকাইয়া বলিলেন, অ্যাই, কে কোথায় আছিস, ইঁদুরটাকে তাড়াইয়া দে। ইঁদুর বলিল, মহাত্মন্, আমিও এই রাজ্যের বাসিন্দা। সুতরাং আমার বলিবার অধিকার আছে। আমাকে মতপ্রকাশের অধিকার হইতে বঞ্চিত করা আপনার গৌরবের পক্ষে অসম্মানজনক। মহারাজ দৃশ্যতঃ অপদস্থ হইয়া বলিলেন, কে এই ইঁদুরকে এখানে প্রবেশাধিকার দিয়াছে? ইহা তো আমার পোষ্যদিগের জন্য আয়োজিত সভা। এখানে ইঁদুর ঢুকিল কী করিয়া? অর্জুন তুমি এখনি এই জানোয়ারের সদ্গতি করো। জ্যাকর্ষণ করিয়া চিরতরে ইহার কণ্ঠরোধ করিয়া দাও। পার্থ ইতস্ততঃ করিয়া মিনমিনে কণ্ঠে বলিলেন, মহারাজ, আমার এই গাণ্ডীব দেবরাজ ইন্দ্রের গিফট। ইহাতে বাণ সংযোজন করিয়া তুচ্ছ ইঁদুর মারিলে তিনি কুপিত হইবেন। ইঁদুর বলিল, মহারাজ, আপনি নিজের সুনামের প্রতি সুবিচার করিবেন, ইহাই কাঙ্ক্ষিত। যুধিষ্ঠির অর্থ হইল সর্বদা যিনি স্থিতপ্রজ্ঞ থাকেন। আমার কথা উচ্চারিত হইবার আগেই যেভাবে আপনি উদ্বিগ্ন হইতেছেন, তাহাতে মহান পৌরব বংশের সম্মান ক্ষুণ্ন হইল। আমাকে মারিলে বিশেষ ক্ষতিবৃদ্ধি হইবে না।
ন জায়তে ম্রিয়তে বা কদাচিন্
নায়ং ভূত্বা ভবিতা বা ন ভূয়ঃ ।
অজো নিত্যঃ শাশ্বতোহয়ং পুরাণো
ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে ।।
এই আত্মা জন্মগ্রহণ করেন না, তিনি মরেনও না, এই আত্মা শাশ্বত, অগ্নি ইঁহাকে পোড়াইতে পারে না, জল ইঁহাকে ভিজাইতে পারে না.. কিন্তু লোকচক্ষে আপনি বড়োই হেয় হইবেন। তাহার চাইতে আপনি আমার বক্তব্য শ্রবণ করুন। সভায় সর্বদা আপনি নিজেই বাগবিস্তার করিয়া থাকেন। গদগদ স্তাবকতা ভিন্ন অন্যের কথা শ্রবণ করিতে আপনার প্রচণ্ড অনীহা।
যুধিষ্ঠির ক্রোধে ফুঁসিতে ফুঁসিতে ভীমসেনকে কহিলেন তোমার পদাঘাতে উহার মস্তকচূর্ণ করিয়া দাও। ইঁদুর বলিল, ভীমসেনকে এমন তুচ্ছ একটি কাজের দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দিয়া আপনি পবনদেবকে রুষ্ট করিবেন না। আমার কথাটি শ্রবণ করুন। জগতে আপনার খ্যাতিবৃদ্ধি হইবে।
যুধিষ্ঠির বলিলেন, এ আমার পোষ্যদিগের সভা। তুমি তো আমার পরিবারের সদস্যদের কাহারও পোষ্য নহ। তোমার মতো তুচ্ছ ইতর জানোয়ার এখানে প্রবেশ করে কোন্ সাহসে?
এমন সময় দ্রৌপদী হাসিয়া বলিলেন, যিনি রাজ্যের অধীশ্বর, রাজ্যের সকলেই তাঁহার পোষ্য। নিন মহারাজ, প্রথম রাউন্ডে আপনার হার হইয়াছে। উহাকে বক্তব্য পেশ করিতে দিন।
যুধিষ্ঠির বলিলেন, কিন্তু পাঞ্চালী, ইঁদুরকে আমার পোষ্যদিগের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করিল কে?
যাজ্ঞসেনী বলিলেন, আমার রন্ধনশালায় উহার আনাগোনা। পরিচয় অনেক দিনের।
যুধিষ্ঠির বলিলেন, আমার অগোচরে কাহাকেও আশ্রয় দিয়া তুমি ভাল করো নাই।
দ্রুপদনন্দিনী কহিলেন, মহারাজ, কিছু মনে করিও না, বায়োলজিতে তোমার অধিকার কিঞ্চিৎ কম দেখিতেছি। মানুষ পৃথিবীতে আবির্ভূত হবার বহুযুগ আগেই বিস্তর জানোয়ার ছিল। ইহাদের মধ্যে অনেকেই মেরুদণ্ডবান এবং তাহাদের মধ্যে অনেকেই মাতৃদুগ্ধ পান করিয়া বড় হয়।
মেরুদণ্ডী স্তন্যপায়ীদের মধ্যে প্রথমে নেকড়ে জাতীয় প্রাণী মনুষ্যসঙ্গ পছন্দ করিতে শুরু করে। মানুষের ভুক্তাবশিষ্ট পাওয়ার লোভেই। উহারা উচ্ছিষ্টভোজী আর কি! গরু মহিষকে পোষ মানানো অনেক পরের ঘটনা।
যুধিষ্ঠির ভ্রূকুঞ্চিত করিয়া বলিলেন, হে অনিন্দিতা, তোমার বচননৈপুণ্যে প্রতিষ্ঠিত হইল যে ইঁদুর কখনোই পোষ্যদিগের মধ্যে গণ্য হইতে পারে না।
নকুল বলিলেন, মহারাজ আমি কখনো কখনো দেখিয়াছি, দ্রৌপদী রন্ধনশালায় আছেন, ইঁদুর ঘুরিয়া বেড়াইতেছে।
দ্রৌপদী বলিলেন, মহারাজ উহাকে বলিতে দিন।
তিক্তমুখে যুধিষ্ঠির চক্ষু বুজিয়া রহিলেন।
ইঁদুর বলিল, মহারাজ, আপনি যজ্ঞ করিলেন, রাজকোষ হইতে সকল ব্যয়নির্বাহ হইল, অথচ আপনি বলিতেছেন, আমি দিয়াছি, আমি দিয়াছি। মহারাজ, এত আমি আমি করা উচিত নহে। প্রজাদিগের করের টাকায় সরকারি কোষাগার ভরে, ইহা আপনি মনে রাখিতে পারেন নাই।
সভাকক্ষে পিন পতনের শব্দ শোনা যাইবে। ইঁদুর বলিল, গৌরবে বহুবচন বলিয়া একটা কথা আছে। ভদ্রলোকে নিজে কিছু করিলেও বলে আমরা করিয়াছি। নিজের চেষ্টায় বাড়ি বানাইলে বলে আমরা করিয়াছি। আমি দিই, আমি করি, এইভাবে আস্ফালন করিতে লজ্জাবোধ করে।
যজ্ঞ করিবেন বলিয়া রাজ্য জুড়ে ফ্লেক্স হোর্ডিংএ ছয়লাপ করা হইয়াছে, আর তাহাতে বড়ো করিয়া আপনার মুখচ্ছবি দেওয়া। রাজ্যের আর কেহ নাই, সকলই আপনার অনুপ্রেরণায় চলিতেছে। ইহা দেখিয়া মহারাজ আমাদের যে লজ্জায় মাথা কাটা যায়!
সহদেব ক্রুদ্ধ হইয়া বলিলেন, চুপ কর্ হারামজাদা! জানিস, কার সামনে কথা কইছিস? জিভ টেনে ছিঁড়ে নেব।
ইঁদুর হাসিয়া বলিল, মহাশয়, আপনি রাজভ্রাতা, এমন তুচ্ছ কাজ করিয়া নিজেকে খেলো করিবেন না।
দ্রৌপদী সহদেবকে চোখ টিপিয়া চুপ করিতে ইঙ্গিত করিলেন।
যুধিষ্ঠির বলিলেন, আমি রাজ্যের তাবৎ মহিলাকে কমলা ভাণ্ডার দিয়াছি। মাসে মাসে ভাতা মিলিবে। রাজ্যের বালিকাদের পড়াশুনার জন্য নন্দিনীশ্রী সহযোগিতা চালু করিয়াছি। তাহা কিছুই নহে বলিতে চাও? জান, সমগ্র জম্বুদ্বীপে আমার নন্দিনী শ্রী প্রকল্পের জয়জয়কার হইয়াছে।
ইঁদুর কহিল, কমলা ভাণ্ডার বলুন, নন্দিনীশ্রী বলুন, সব প্রকল্প জনগণের করের টাকায় হয়। কিন্তু এগুলি আসলে আপনার ব্যর্থতার সরকারি স্বীকৃতি ছাড়া অন্য কিছুই নহে।
যুধিষ্ঠির বলিলেন, কিসের ব্যর্থতা?
ইঁদুর বলিল, আপনি যদি সঠিকভাবে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করিতে পারিতেন, শিল্প কারখানা চালু রাখিতে পারিতেন, তাহা হইলে এভাবে করের টাকা নয়ছয় করিয়া ডোল দিতে হইত না। কর্মঠ যুবা বেতনের টাকায় পুত্র কলত্রের অন্নসংস্থান করিত। ব্যবসা করিয়া লোকে লক্ষ্মী লাভ করিত। নিজের পরিশ্রমজাত অর্থে সংসার প্রতিপালনের যে একধরনের মহত্ত্ব আছে, তাহা তো সহজেই বোঝা যায়।
রাজ্যের বেকার যুবক যুবতীদের ভিক্ষা লইতে দেখিয়া বীরগতিপ্রাপ্ত পূর্বপুরুষবর্গের চক্ষে জল পড়িতেছে। দিনে দিনে আরো কারখানা লাটে উঠিতেছে। বস্তুতঃ শ্রী এই শব্দটিকে আপনি ধূলিধূসরিত করিয়া দিয়াছেন। শ্রীহীন রাজ্যে সরকারি প্রকল্পের নামেই শুধু শ্রী। বাকি সকলই বিশ্রী।
যুধিষ্ঠির ইঁদুরের উদ্দেশে বলিলেন, দেখ, তুমি বড়ই একচোখো। তুমি দেখ না, রাজ্যের অর্থ বাঁচাইতে আমি হাওয়াই চপ্পল পরি, মুড়ি তেলেভাজা খাইয়া ভোজন সারি।
ইঁদুর কহিল, আপনার হাওয়াই চপ্পল কথা জগৎবিদিত।
আত্মতৃপ্তির সহিত যুধিষ্ঠির বলিলেন, তবে?
ইঁদুর বলিল, আপনার হাওয়াই চপ্পল দর্শন আপনার তাজা ভাইয়েরা কেহই গ্রহণ করেন নাই। সকলেই বহুমূল্য ব্রাণ্ডেড জুতা ব্যবহার করেন। শোনা যায় , আপনার পদশোভার জন্য প্রতি বেলায় নূতন নূতন হাওয়াই চপ্পল আসে। ইহার চাইতে প্রতি সপ্তাহে নূতন জুতা পরিলে রাজ্যের অর্থব্যয় কম হইত। আর মুড়ি তেলেভাজা খাইয়া অর্থ বাঁচাইবার কথা বলিতেছেন? আপনার বদখেয়ালে কত যে বাজে খরচ বাড়িয়াছে কী বলিব। খেলা এবং মেলা বাবদে রাজ্যে র্যালাপর্ব দেখিলে চোখে জল আসে। যুধিষ্ঠির খেপিয়া উঠিয়া বলিলেন, আমার যা কিছু ব্যক্তিগত খরচ সকলই আমার গানের রয়্যালটি হইতে আসে। কোষাধ্যক্ষ মহাশয় জানেন।
ইঁদুর বলিল, আপনার গানের রয়্যালটি যিনি দেন, অন্যভাবে তাঁহার ক্ষতিপূরণ করা হয়। আপনি রাজভোগে অভ্যস্ত থাকিলে খরচ অনেক কম পড়িত।
যুধিষ্ঠির রাগিয়া বলিলেন, কে আছিস, এই ইঁদুরকে এখনই শূলে চড়া।
অমনই মূষিকবাহন লম্বোদর গজানন গণনায়ক গণপতি সভাকক্ষে আবির্ভূত হইয়া বলিলেন, এইভাবে গণতন্ত্রের কণ্ঠরোধ করিবার জন্য তোমাকে অভিশাপ দিলাম, পরজন্মে তুমি পাণ্ডববর্জিত দেশে জন্মিবে এবং পরিবর্তন নাম করিয়া যাহা করিবে তাহাতে তোমাকে লইয়া বিস্তর হাসাহাসি হইবে।
যুধিষ্ঠিরের চোয়াল ঝুলিয়া গেল।