|| প্রেমের বাসন্তী চিঠি সংখ্যায় || মৃদুল শ্রীমানী (গদ্য)

নদীকে যে নামে ডাকো
সরস্বতী একটি নদীর নাম। নদীই গড়ে তুলত সভ্যতাকে। মিশরীয় সভ্যতাকে বলা হত নীলনদের দান। ব্লু নীল আর হোয়াইট নীল। নীলনদে প্রতি বৎসর বন্যা হত। নতুন পলি এসে উর্বর করে দিত ক্ষেত। তবে জমির সীমানা আবার ঠিক করতে হত। ওই থেকে জ্যামিতি। পাইথাগোরাস। ইউক্লিড। আর গণিত। সুমেরীয় সভ্যতা টাইগ্রিস ইউফ্রেটিস নদীর দান। আর সিন্ধুর পাঁচটি উপনদী। ওরা হল বিপাশা, বিতস্তা, চন্দ্রভাগা, ইরাবতী আর শতদ্রু। পাঁচ নদীর জলে পুষ্ট পঞ্জাব। চৈনিক সভ্যতায়ও নদীর কথা । ইয়াংসি আর সিকিয়াং। আর হোয়াংহো ছিল চীনের দুঃখ।
পৃথিবীর বড়ো বড়ো নদীগুলির নাম জানতাম মহাদেশ ধরে ধরে। আমাজন, রাইন, সীন, টেমস, ভলগা, দন, মেকং, কঙ্গো, জাইরে, অরেঞ্জ, কতো নদী।
আমাদের সংস্কৃত সাহিত্য পড়তে গিয়ে প্রথমেই পড়েছি অস্তি গোদাবরীতীরে বিশাল শাল্মলীতরু… । একটি নদীর নাম ছিল তুঙ্গভদ্রা। সেই নদীর নাম নিয়ে বাংলায় উপন্যাস আছে। রাহুল সাংকৃত্যায়নের লেখা ভলগা থেকে গঙ্গা আমি অনুবাদে যখন পড়েছি, তখন নিশ্চয়ই কৈশোর শেষ হয় নি। তিস্তা পারের বৃত্তান্ত নিয়ে একটু চর্চা হল ভূমি দপ্তরে কাজ শিখতে এসে। তার আগেই অদ্বৈত মল্লবর্মণের তিতাস একটি নদীর নাম জানতাম। কানে শুনতে পেতাম ‘শিক্ষিৎ হও’। অমিয়ভূষণ মজুমদারের মহিষকুড়ার উপকথা পড়েছিলাম একটানে। আর পদ্মানদীর মাঝি। আমায় ধরো ক্যান্ মাঝি, কলস ধরো…
ভারতের গুরুত্বপূর্ণ নদীগুলির নাম মুখস্থ বলে যেতে পারতাম শৈশবেই। মহানদী, কৃষ্ণা, কাবেরী, নর্মদা, তাপ্তী, শোণ…আমরা শৈশবে কুলুকুলু জাহ্নবী তীরে দাঁড়িয়ে গাইতাম গঙ্গা সিন্ধু নর্মদা কাবেরী যমুনা ওই, বহিয়া চলেছে আগের মতো, কই রে আগের মানুষ কই?
আমাদের ছোটবেলায় পিসির বাড়ি যেতে গেলে গঙ্গা পেরোতে হত। মামার বাড়ি যেতে গেলেও গঙ্গা পেরোতে হত। পিসির বাড়ি যেতে বিবেকানন্দ সেতু, আর মামাবাড়ি যেতে হলে রবীন্দ্র সেতু। গঙ্গার কত নাম জানতাম। ভাগীরথী, জাহ্নবী। আর তার সঙ্গে ভগীরথের গঙ্গা আনয়ন আর সগররাজার ষাট হাজার ছেলের গল্প। আশ্রম ভাসিয়ে দিয়েছে বলে, জহ্নুমুনি এক গণ্ডুষে পান করে ফেললেন গঙ্গাকে। তখন ভগীরথের সে কি কান্নাকাটি। মুনি দয়া করে নদীকে মুক্ত করে দিলেন। গঙ্গা আকাশে বইতেন মন্দাকিনী হয়ে। মর্ত্যে অলকানন্দা। পাতালে ভোগবতী। বাণের আঘাতে শরশয্যায় ভীষ্ম পিতামহের তৃষ্ণা মিটিয়েছিলেন তৃতীয় পাণ্ডব। গঙ্গা এসে তাঁর সন্তানের তৃষ্ণা হরণ করেছিলেন। গঙ্গা আর শান্তনু আর দেবব্রত ভীষ্মের কত গল্প। অনেক পরে জেনেছি শিবের গান শুনে নারায়ণের পদযুগল গলে গঙ্গার সৃষ্টি।
সরযূ নদীর কথা জানতাম রামায়ণ পড়ে। আর সেই যে তমসা নদীতে নেমে লক্ষ্মণ ভাই চিরকালের জন্য দাদাকে ছেড়ে চলে গেলেন। ফল্গুনদী বিপদের দিনে সীতাকে সাপোর্ট করে নি। শক্তের দাপটে চুপ করে থেকেছে। তাইতে সীতা ক্ষোভে ওকে অভিশাপ দিলেন। নদীকে ফল্গুধারা হতে হল। আমাদের কৈশোরে নদীতে নদীতে ভেসে বেড়াতেন রবীন্দ্রনাথ। নতুনদাদার সঙ্গে পদ্মায় এপার ওপার। আর আবদুল মাঝির গল্প। আর চরে কাছিমের ডিম। শক্তিনাথবাবু নৌকো রাঙালেন লাল রঙে। নাম দিলেন রক্তজবা। ইন্দ্রনাথের সঙ্গে রাত্রি হলেই মাছ চুরি করতে যেতাম স্বপ্নে। নিজের খাবার জন্য নয়। দিদিকে দেব বলে। দিদির বর শাহজী সাপুড়িয়া। বড় অর্থকষ্টে চলে তাদের। আর মায়ের ডাকে দামোদর পেরিয়ে গেলেন বিদ্যাসাগর। মান্না দে গান গাইছেন, এক ডুবে ভরানদী করে দেব পার, আমি কাটব সাঁতার, আমি রাজি, রাখো বাজি…
কাশীর মহিষী করুণা স্নান করতে গেলেন বরুণা নদীতে। রাণির নাম করুণা, মনে তাঁর করুণার লেশমাত্র নেই। অশোক ছিলেন চণ্ডাশোক। কলিঙ্গ দেশে নরহত্যা করিয়ে দয়া নদীর জল লাল করে দিলেন। নদীর নাম দয়া, মানুষের রক্তে লাল হয়ে গেছে তার জল। তারপর রাজাকে বাধা দেবার আর কেউ নেই বুঝতে পেরে হিসেব কষে চণ্ডাশোক হয়ে উঠলেন ধর্মাশোক। ধর্মের অপার মহিমা!
গঙ্গার তীরে দাঁড়িয়ে কর্ণ সন্ধ্যা সবিতার স্তব করছেন। তিনি যে সূর্যপুত্র। মা তাকে জন্মের পরেই জলে ভাসিয়ে দিয়েছেন। রাধা আর অধিরথ, সুতদম্পতির ঘরে বড় হয়েছেন কর্ণ। কিন্তু জিন যাবে কোথায়। কর্ণের সমস্ত শরীর মন ব্যক্তিত্ব জুড়ে সৌরবিভা। শূরশ্রেষ্ঠ তিনি। কুন্তী কত নীচ হয়ে গেলেন। কর্ণ বলছেন, বীরের সদ্গতি থেকে ভ্রষ্ট নাহি হই।
নদী ওই কথা শেখায়। নদীকে বাঁধলে সে আর নদী থাকে না। নদী আপনবেগে পাগল পারা। হেসে খলখল গেয়ে কলকল তালে তালে তালি দিয়ে সে বলে আমি ঢালিব করুণাধারা, আমি ভাঙিব পাষাণ কারা… জাগ্রত জনমত ওই নদীর মতো চিত্ত যেথা ভয়শূন্য, উচ্চ যেথা শির, জ্ঞান যেথা মুক্ত। যে ক্যানিউট তাকে লাগাম পরাতে চায়, তাকে শেষ হয়ে যেতে হবে। পৃথিবীর ইতিহাস সেই কথা বলে।