|| অ্যালবার্ট আইনস্টাইন: জন্মদিনে স্মরণলেখা || মৃদুল শ্রীমানী

অ্যালবার্ট আইনস্টাইন (১৮৭৯ – ১৯৫৫)

ই ইকোয়াল টু এম সি স্কোয়ার। মাস বা ভরকে শক্তিতে রূপান্তরের সূত্র। কোনো পদার্থের খানিকটাকে শক্তিতে রূপান্তরিত করলে কতটা শক্তি তৈরি হবে? এম বা মাসকে সি বা আলোর গতিবেগের বর্গফল দিয়ে গুণন করুন। আলোর গতিবেগ শূন‍্য মাধ‍্যমে সেকেন্ডে প্রায় তিনলক্ষ কিলোমিটার। তার বর্গফল দিয়ে গুণন। খুব বড়ো একটা সংখ‍্যা। অর্থাৎ সামান্য পরিমাণ ভরকেও শক্তিতে রূপান্তরিত করলে বিপুল পরিমাণ শক্তি নির্গত হবে। অথবা এও বলা যায়, সামান্য একটু ভর বিপুল পরিমাণ শক্তির ঘনীভূত রূপ। তো আইনস্টাইন এই সূত্রটি আমাদের উপহার দিলেন। এরজন্য তাঁকে নোবেল পুরস্কার দেবার মানে হয় না। দেওয়া হয়ও নি। ১৯০৫ সালটা ছিল আইনস্টাইনের জন‍্য একটা আশ্চর্য বছর। মিরাকল ইয়ার। চার চারটে গবেষণাপত্র লিখলেন। প্রথমটা ফোটো ইলেকট্রিক এফেক্ট নিয়ে। দ্বিতীয়টির বিষয় ব্রাউনিয়ান মোশন। তৃতীয়টি বিশেষ আপেক্ষিকতাবাদ। আর চতুর্থটিতে ভর ও শক্তির সম্পর্ক বিন‍্যাস লিখলেন। সবগুলিই প্রকাশ করা হয়েছিল অ্যানালেন ডার ফিজিক নামে বিজ্ঞান জার্নালে। ১৯০৫ সালেই। চতুর্থটি প্রকাশ হয়েছিল নভেম্বরের একুশ তারিখে।
আজ অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের জন্মদিন। ১৮৭৯ খ্রিস্টাব্দে এমন একটি চৌদ্দ মার্চ তিনি জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে ১৮ এপ্রিল তারিখে প্রয়াত হন।
১৯০৫ সালে অ্যালবার্ট আইনস্টাইন (১৮৭৯ – ১৯৫৫) অ্যানালেন ডার ফিজিক বিজ্ঞান জার্নালে চার চারটি গবেষণাপত্র বের করে বিজ্ঞানচর্চায় নবযুগ এনে দিয়েছেন। এর মধ‍্যে তৃতীয় গবেষণাপত্রটি ছিল বিশেষ আপেক্ষিকতাবাদ নিয়ে। ১৯০৫ সালের ৩০ জুন তিনি গবেষণা পত্রটি পত্রিকা দপ্তরে পাঠান আর ওই বছরেই ২৬ সেপ্টেম্বরে তা প্রকাশিত হয়েছে। এরপরে ১৯০৭ থেকে ১৯১৫ অবধি আইনস্টাইন এই বিষয়ে আরো গবেষণা করে চলেন।
এভাবে জন্ম নিয়েছিল সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ। আইনস্টাইন বললেন, আমরা যাকে মাধ‍্যাকর্ষণ বলে চিনি, তা আসলে স্পেস টাইম বা স্থান কালের বক্রতা থেকে উদ্ভূত। ভারি জিনিস তার চারপাশের স্পেস টাইম বা স্থান কালকে বাঁকিয়ে তোলে। ওতেই আমরা দুটি ভরযুক্ত পদার্থের মধ‍্যে ভারাকর্ষণের ঘটনা লক্ষ করি।

১৯০৫ সালে প্রকাশিত তৃতীয় গবেষণাপত্রটির নাম ছিল অন দি ইলেকট্রোডাইনামিক্স অফ মুভিং বডিস, বা চলন্ত বস্তুর বৈদ‍্যুতগতি সম্পর্কে।

১৯০৭ সালে আপেক্ষিকতাবাদের নিয়মকানুন আর তা থেকে কী বোঝা যায় তা নিয়ে তিনি একটা গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন। তাকেই আরো বিকশিত করে আইনস্টাইন ১৯১১ সালে লিখলেন, আলোক বিচ্ছুরণের সময়ে ভারাকর্ষণের প্রভাব। এইসব সময়ে এডিংটন গ্রীণিচ মানমন্দিরে কাজ করেন। একজন ডাচ গণিতবিদ জ‍্যোতির্বিজ্ঞানী উইলিয়াম দে সিত্তার ( ০৬ মে ১৮৭২ – ২০ নভেম্বর ১৯৩৪) আর্থার এডিংটনকে আইনস্টাইনের গবেষণার সঙ্গে পরিচিত করিয়ে দেন। দে সিত্তার নিজেও এ নিয়ে গবেষণা করে চলেছিলেন। তিনি বলতেন, চতুর্মাত্রিক স্পেস টাইম বিষয়টা সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদের ধারণার ভিত্তিতে গড়ে তোলা কসমোলজিক‍্যাল বা বৈশ্বিক মডেলের সঙ্গে বেশ খাপ খেয়ে যায়। আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতাবাদের প্রজ্ঞায় জ‍্যোতির্বিজ্ঞান চর্চার কোন্ কোন্ অগ্রগতি হতে পারে দে সিত্তার তা লক্ষ করছিলেন। তাঁর কাছে আইনস্টাইনের গবেষণা সম্বন্ধে জানতে পেরে এডিংটনের জানার আকুতি দীপ্ত হয়ে ওঠে।
গভীর আগ্রহে এডিংটন আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতাবাদ বিষয়ক গবেষণাপত্র পাঠে প্রবৃত্ত হন এবং তা নিয়ে সহজ করে ব‌ই লিখতে থাকেন। ব‌ইগুলি বেস্টসেলার হয়ে উঠেছিল। অথচ আইনস্টাইনের সঙ্গে এডিংটনের আলাপ পরিচয় হয়নি। এমনকি সরাসরি চিঠিপত্র পর্যন্ত লেখা হয়ে ওঠেনি।
এডিংটন ছিলেন পারিবারিক সূত্রে একজন কোয়েকার খ্রিস্টান।কোয়েকাররা ধর্মীয় অনুষ্ঠান পছন্দ করতেন না। তাঁরা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে পাদ্রি পুরোহিতের ভূমিকায় আস্থাবান ছিলেন না। আর ধর্মীয় পরিসরে তাঁরা নারীপুরুষের সমানাধিকারের পক্ষপাতী ছিলেন। কোয়েকাররা বিশ্বশান্তির সপক্ষে কথা বলেছেন ও দাসপ্রথা উচ্ছেদে ও নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় কাজ করেছেন। তো মনেপ্রাণে একজন কোয়েকার হিসেবে এডিংটন বুঝতে পেরেছিলেন আইনস্টাইনের গবেষণাকে বিশ্বের কাছে পৌঁছে দেওয়া দরকার।
এডিংটন তাঁর মজবুত গাণিতিক বোধ দিয়ে আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতাবাদের গভীরে ডুব দিলেন, তাঁকে আত্মস্থ করলেন, এবং আপেক্ষিকতাবাদ নিয়ে সহজ ইংরেজি ভাষায় ব‌ই লিখতে শুরু করলেন।

আইনস্টাইন বলেছিলেন, যখন আলো কোনো একটি বিপুল ভরবিশিষ্ট বস্তুর পাশ দিয়ে চলে, সূর্যের মতো বিপুল ভরের কোনো নক্ষত্র, তখন তার ভারাকর্ষণের ফলে যৎসামান্য হলে আলো বেঁকে যায়। অর্থাৎ, দূরবর্তী কোনো নক্ষত্রের আলো, ওই বিপুল ভরের বস্তুর পাশ দিয়ে আসতে গিয়ে বেঁকে যাবার কারণে মনে হবে নক্ষত্রটি যে সামান্য একটু সরে গিয়েছে, মনে হবে নক্ষত্রটি একটি ভুল অবস্থানে রয়েছে।
নক্ষত্রটি ঠিক কতটুকু সরে গিয়েছে বলে মনে হবে তাও আইনস্টাইন বলে রেখেছিলেন।
সেটা হল ১.৭ আর্ক সেকেন্ড। ফটোগ্রাফে তা এক মিলিমিটারের ১/৬০ ভাগ সরে রয়েছে বলে মনে হবে।
এ জিনিসটা মাপজোক করে দেখানো বেশ শক্ত, তবুও ধৈর্য ও যত্নে তা না মাপজোক করতে পারার কিছুই নেই।
মুশকিল হল এই যে দিনের বেলায় নক্ষত্র আলোকের চলনপথ নিয়ে গবেষণা করা দুঃসাধ্য। তাই এই ধরনের পরীক্ষার জন‍্য পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ প্রশস্ত। ওদিকে আরেক অশান্তি হল যে পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ জিনিসটা বেশ বিরল গোছের মহাজাগতিক ঘটনা, আর তা স্বল্পক্ষণ‌ই স্থায়ী হয়। আর তা ভাল করে দেখতে গেলে অনেক দূরে যেতে হয়।
আইনস্টাইন নিজেই নিজের বক্তব্যটা যাচাই করতে চেয়ে বছরের পর বছর ধরে চেষ্টা করে চলেছিলেন। কিন্তু সাফল‍্য পান নি। এডিংটন ভাবলেন, তিনিই কাজটা করে দেখাবেন। অথচ তখনও তাঁর সঙ্গে মহাবিজ্ঞানীর ন‍্যূনতম যোগাযোগটুকু হয়ে ওঠে নি। এরপর এডিংটন হিসাব করে দেখলেন ১৯১৯ সালের মে মাসের ২৯ তারিখে একটি পূর্ণগ্রাস সূর্য গ্রহণ রয়েছে। তা ভাল করে দেখা যাবে দক্ষিণ গোলার্ধের দেশগুলি থেকে। অথচ এই সময় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলছে।
১৯১৪ সালের ২৮ জুলাই তারিখে যুদ্ধ বেধে গিয়েছিল। ১৯১৮ সালের ১১ নভেম্বর যুদ্ধ থামে।
এডিংটন ছিলেন একজন কোয়েকার। আগেই বলেছি কোয়েকাররা মন, মানসিকতা আর চিন্তার গঠনে শান্তিকামী। তাই কোয়েকাররা অনেকেই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে চাননি, এমনকি স্পষ্ট ভাষায় আপত্তি জানিয়েছিলেন। যুদ্ধে যোগদানের বিষয়ে কোয়েকারদের এই নির্লিপ্তি ও আপত্তি রাষ্ট্রশক্তিকে খুব বিরক্ত করেছিল। যুদ্ধযাত্রায় আপত্তি জানানোর জন্য রাষ্ট্রীয় রোষে বহু কোয়েকার কঠোর কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছিল।

এডিংটনেরও সেই দশাই হত। তবে তাঁকে বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন ফ্রাঙ্ক ডাইসন। তিনি ছিলেন অ্যাসট্রোনোমার রয়‍্যাল। প্রশাসনের উপরমহলে ডাইসনের প্রভাব প্রতিপত্তি ছিল। যুদ্ধের পরিবেশে সাগরপাড়ি দিয়ে দূর দেশে যাবার আয়োজন করে দিলেন ডাইসন। খরচ খরচাও যোগাড় করে দিলেন তিনিই।

টাকা পয়সার যোগাড় হলেও যুদ্ধের পরিবেশে পরীক্ষা নিরীক্ষার সাজ সরঞ্জাম যোগার করাও ছিল বিরাট চ‍্যালেঞ্জ। ডাইসনের প্রভাবে বাধা বিপত্তি কাটিয়ে অভিযানের সুযোগ হল।

দুটি অভিযাত্রী দল বের হল। একটি যাবে ব্রাজিলে। অন‍্যটির নেতা এডিংটন স্বয়ং। সেটি যাবে পশ্চিম আফ্রিকার প্রিন্সিপে দ্বীপে। গায়না উপসাগরে বিষুবরেখার উপরে এই দ্বীপ।

অবশেষে এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ‌ , ১৯১৯ সালের ২৯ মে। মাত্র ছয় মিনিট একান্ন সেকেন্ডের পূর্ণগ্রাস। তার মধ‍্যেই যা ছবি তোলার তুলে নিতে হবে।

সূর্যের মুখ ঢেকে দিল চাঁদ। এর আগে সেই ১৪১৬ সালের ২৭ মে তারিখে এমন দীর্ঘক্ষণ ধরে সূর্য গ্রহণ দেখা গিয়েছে। পাঁচ শত বছরেরও বেশি সময় পরে আবার সুযোগ এসেছে। হায়াদেস তারামণ্ডলের কাপা টাউরি তারা থেকে আলো আসছে। তার ফটোগ্রাফ তুললেন আর্থার এডিংটন। আইনস্টাইনের কথার প্রমাণ মিলল। প্রতিষ্ঠিত হল এক বিশ্বসত‍্য।

১৯০৫ সালে অ্যালবার্ট আইনস্টাইন তড়িৎচৌম্বকীয় তরঙ্গের শক্তির ন‍্যূনতম কণা বা কোয়ান্টাম নির্ধারণ করেন। ওই যেন কোয়ান্টাম জগতের সিংহদুয়ার খোলা। এই যে কোয়ান্টা, মানে এই ছোট্ট এতটুকু একটা জিনিস, এটা একটা তড়িৎ নিরপেক্ষ কণা। এর নাম দেওয়া হল ফোটন কণা। যদিও ফোটন নামটা পরিচিতি পেয়েছে পরবর্তীকালে। আইনস্টাইন বলেছিলেন আলোক কোয়ান্টা। এর মধ্যেই ১৯০০ সালে ম‍্যাক্স প্ল‍্যাঙ্ক ( ২৩ এপ্রিল ১৮৫৮ – ৪ অক্টোবর ১৯৪৭) দেখিয়েছিলেন একটা ফোটনের শক্তি আর তার কম্পাঙ্ক বা ফ্রিকোয়েন্সির মধ‍্যে একটা গাণিতিক সম্পর্ক আছে। ওই সম্পর্কের মান নির্ধারণ করা যায়। ওই হল প্ল‍্যাঙ্ক ধ্রুবক। শক্তি কোয়ান্টা নিয়ে গবেষণার স্বীকৃতিতে ১৯১৮ সালে ম‍্যাক্স প্ল‍্যাঙ্ককে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল।

আলোর কোয়ান্টা নিয়ে আইনস্টাইনের ১৯০৫ সালের গবেষণার সূত্রে রবার্ট অ্যানড্রুজ মিলিকান বিস্তারিত গবেষণা করে জানান আইনস্টাইনের ধারণা সত‍্য। তখন, ১৯২১ সালে, গবেষণা পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হবার বছর পনেরো ষোল পরে আইনস্টাইনের নোবেল সম্মান জোটে। মিলিকান প্ল‍্যাঙ্কের ধ্রুবকের নিখুঁততর মান নির্ধারণ করেছিলেন।

অণু পরমাণুর সংখ্যা নিয়ে চর্চা করতে গেলেও আইনস্টাইনের গবেষণার কথা এসে যায়। অনেক আগেই ডালটনের সমসময়ে খাঁটি বৈজ্ঞানিকের অন্তর্দৃষ্টি নিয়ে পদার্থের প্রাথমিক গঠনের গভীরে তাকিয়েছিলেন অ্যামেদিও অ্যাভোগ‍্যাড্রো। লোরেঞ্জো রোমানো অ্যামেদিও কার্লো অ্যাভোগ‍্যাড্রো ছিলেন ইটালিয়ান ভদ্রলোক। ৯ আগস্ট তাঁর জন্মদিন। ১৭৭৬ সালে জন্মেছিলেন। মারা গিয়েছিলেন ১৮৫৬ সালের ৯ জুলাই। ১৮১১ সালে, যখন অ্যাভোগ‍্যাড্রোর বয়স পঁয়ত্রিশ, তখন একটি বৈজ্ঞানিক সন্দর্ভ লিখে তিনি বললেন, সমান তাপমাত্রা আর চাপে একই পরিমাণ গ‍্যাসে একই সংখ্যক অণু থাকবে। চাপ ও তাপে গ‍্যাসের আয়তনের হেরফের নিয়ে বয়েল, চার্লস আর গে লুসাক নানা পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছিলেন। অ্যাভোগ‍্যাড্রো বললেন, একই রকম পরিবেশে সমান তাপমাত্রা ও সমান চাপে সম পরিমাণ গ‍্যাসের প্রাথমিক পদার্থের, সেটা অণু পরমাণু যাই হোক না কেন, তার সংখ‍্যাটা একই রকম। এটাকে তিনি বললেন প্রকল্প বা হাইপথিসিস। হাইপথিসিস কেন? না, তখনো তো যুক্তি ও বিজ্ঞানের কষ্টিপাথরে জিনিসটা প্রমাণিত হয়নি। ওই যে কথাটা অ্যাভোগ‍্যাড্রো বললেন, ওই কথার সূত্র ধরে ১৮৬৫ সালে যোহান যোসেফ লসচমিট একটা অণুর আয়তন সম্বন্ধে ধারণা করলেন। ১৯০৯ সালে জাঁ ব‍্যাপটিস্ট পেরিন এই অণুর সংখ্যা নিয়ে গভীর আলোকপাত করলেন।

এইসূত্রে রবার্ট ব্রাউনের নামটাও উল্লেখ করতে হয়। রবার্ট ব্রাউন (২১ ডিসেম্বর ১৭৭৩ – ১০ জুন ১৮৫৮) ছিলেন উদ্ভিদবিদ। তিনি ক্লারকিয়া পুলচেলা নামের উদ্ভিদের পরাগরেণুকে জলে ডুবিয়ে অণুবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে লক্ষ করছিলেন। সেটা ১৮২৭ সাল। ব্রাউন লক্ষ করলেন যে, তরল বা গ‍্যাসে অর্থাৎ ফ্লুইডে যদি কোনো কণা রাখা থাকে, তখন সেই কণাটার একটা অনিয়ন্ত্রিত এলোমেলো খেয়ালখুশির চলন দেখা যায়। আশেপাশের গতিশীল অণুরাই কণাটাকে ঠেলাঠেলি করে ওভাবে দৌড় করায়।
১৮২৮ সালে ব্রাউন তাঁর এই গবেষণা সম্পর্কে একটা প্রতিবেদন প‍্যামফ্লেট আকারে প্রকাশ করে বলেন, এই ঠেলাঠেলির সম্পর্কটা পদার্থের একটা সাধারণ ধর্ম। অর্থাৎ সর্বত্র এটা দেখা যাবে।
এর প্রায় আট দশক পর, ১৯০৫ সালে, অ্যালবার্ট আইনস্টাইন বললেন যে, পরাগরেণুর ওই যে চলন এটা প্রতিটি একক জলের অণুর ঠেলায় হচ্ছে। অ্যানালেন ডার ফিজিক এ তাঁর যে চারটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছিল, এটি তারই একটি।
আইনস্টাইনের এই বক্তব্য নিয়ে বিশদে পরীক্ষা নিরীক্ষা করেন ফরাসি বৈজ্ঞানিক জাঁ ব‍্যাপটিস্ট পেরিন ( ৩০ সেপ্টেম্বর ১৮৭০ – ১৭ এপ্রিল ১৯৪২)। বিস্তারিত অনুসন্ধান করে পেরিন জানালেন আইনস্টাইনের ব‍্যাখ‍্যা সঠিক এবং পদার্থ পরমাণু দিয়ে তৈরি। এজন‍্য পেরিন ১৯২৬ সালে নোবেল সম্মানে ভূষিত হন।

আইনস্টাইন ১৯০৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর তারিখে স্পেশাল রিলেটিভিটি নিয়ে গবেষণাপত্র প্রকাশ করলেন। ১৯১৬ তে প্রকাশ করেন সাধারণ রিলেটিভিটি। ১৯১৭তে বিশ্বজগতের গঠন কেমন, তা সাধারণ রিলেটিভিটি দিয়ে ব‍্যাখ‍্যাও করলেন। স্পেস টাইমের বক্রতা নিয়েও বললেন। বললেন বিরাট মাপের ভরের অস্তিত্ব আলোর গতিপথকেও বাঁকিয়ে দেবে। কিন্তু সবাই পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেয়ে যান, আইনস্টাইনকে আর নোবেল কমিটি পুরস্কার দিতে চাননা। এমন সময়, ১৯১৯ সালের ২৯ মে তারিখে আফ্রিকার পশ্চিম কূল থেকে একটি সূর্যগ্রহণ দেখতে গিয়ে স‍্যর আর্থার স্ট‍্যানলি এডিংটন (১৮৮২ – ১৯৪৪) দেখিয়ে দিলেন, আইনস্টাইন যা বলেছেন, তা একেবারেই নির্ভুল। গ্রহণে সৌর আলোকচাকতিটি চাঁদের আড়ালে ঢাকা। অন্ধকারে দেখা গেল সুদূরের তারার থেকে খসা আলো সৌরভরের প্রভাবে বেঁকে যাচ্ছে। মাধ‍্যাকর্ষণের প্রভাব আলোও কাটাতে পারে না, আইনস্টাইনের এই কথা হাতে কলমে প্রমাণ করে দিলেন আর্থার এডিংটন। ১৯২১ সালে আইনস্টাইন পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেলেন।সংবাদমাধ‍্যমে তাঁর ও তাঁর তত্ত্বের ভূয়সী প্রশংসা লক্ষ করে পল ডিরাকের ইচ্ছা গেল ওই আপেক্ষিকতাবাদ নিয়ে কাজ করবেন। সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ হল ভারাকর্ষণের মেট্রিক তত্ত্ব। আর এর অন্তর্বস্তু হল আইনস্টাইনের ফিল্ড ইকুয়েশন।
মহাজগতে যে পদার্থ ও বিকিরণ রয়েছে, তা স্পেস এবং সময়কে প্রভাবিত করে। ওই স্পেস ও সময়ের জ‍্যামিতিক বিন‍্যাসকেই আইনস্টাইনের ফিল্ড ইকুয়েশন বর্ণনা করে।
পল ডিরাকের ইচ্ছা করেছিল তিনি আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতাবাদ নিয়ে গভীরভাবে চর্চা করবেন। যে সময় আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ নিয়ে আকৃষ্ট হয়েছেন, তার প্রায় একশত বৎসর আগে ১৮২৮ সালে কার্ল ফ্রিডরিশ গাউস ( ৩০ এপ্রিল ১৭৭৭ – ২৩ ফেব্রুয়ারি ১৮৫৫) লাতিন ভাষায় তাঁর রিমার্কেবল থিওরেম লিখেছিলেন। মোটের উপর তাতে বলা ছিল যে, একটি তলের বক্রতা তার উপরের পথগুলির দূরত্বের পরিমাপ করে নির্ধারণ করা যায়। গেওর্গ ফ্রিডরিশ বার্নহার্ড রীম‍্যান ( ১৭ সেপ্টেম্বর ১৮২৬ – ২০ জুলাই ১৮৬৬) অনেক বেশি ডাইমেনশনের বা বহুমাত্রিক স্পেসে বিকশিত করলেন। একে বলা হল ম‍্যানিফোল্ড। এখানে দূরত্বের সঙ্গে কোণও মাপা হল আর ওই সঙ্গে বক্রতার ধরনকেও ব‍্যাখ‍্যা করা হল। আলবার্ট আইনস্টাইন রীম‍্যানের এই তত্ত্বের ভিত্তিতে আরো অগ্রসর হলেন।

রীম‍্যানিয়ান জ‍্যামিতিক ধারণার সাহায্যে আইনস্টাইন সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদের মূল গাণিতিক কাঠামো দাঁড় করালেন, আর সেই কাঠামোয় ভারাকর্ষণের বাস্তব ধারণাগুলি তিনি চাপালেন।
আইনস্টাইনের দেওয়া সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদের ধারণা নিউটনের দেওয়া ভারাকর্ষণের বৈশ্বিক ধারণাকে শুদ্ধতর ও বিকশিত করেছে‌। এর মাধ্যমে ভারাকর্ষণকে স্পেস এবং সময়, বা স্পেস ও সময়ের চতুর্মাত্রিক ধারণাকে ঐক্যবদ্ধ ও সুসংহত জ‍্যামিতিক ধারণা হিসেবে বিকশিত হল। সুনির্দিষ্ট ভাবে বলতে গেলে, স্পেস ও সময়ের যে বক্রতা, তা বিরাজমান পদার্থ ও বিকিরণের শক্তি ও ভরবেগের সঙ্গে সরাসরি ভাবে সম্পর্কিত‌।
১৯৩৯ সালের এপ্রিল মাসের তিন তারিখ। পোল‍্যাণ্ডের উপর আগ্রাসন চালাবেন বলে জার্মান মিলিটারিকে আদেশ দিয়েছেন হিটলার। আইনস্টাইন উদ্বিগ্ন। সারা পৃথিবীর শান্তিপ্রিয় মানুষ উদ্বিগ্ন। উদ্বিগ্ন গান্ধিজিও। ১৯৩৮ সালেই বিজ্ঞানীদ্বয় অটো হান আর ফ্রিৎস স্ট্রাসমান পরমাণু ভাঙার কৌশল আবিষ্কার করেছেন। তার তাত্ত্বিক কাঠামো গড়ে দিয়েছেন অন‍্য দুই বিজ্ঞানী লিসে মিটনার আর অটো ফ্রিশচ। পরমাণু নিয়ে গবেষণা খুব ঘোরালো রূপ নিয়ে ফেলেছে। তেইশে জুলাই ১৯৩৯ তারিখে গান্ধিজি হিটলারকে চিঠি লিখলেন, ভাইটি আমার, যুদ্ধ পাকিয়ে তুলো না। ইংরেজি ভাষায় হিটলারকে সম্বোধন করলেন, My friend. বড় মানুষ তিনি। চেষ্টা করলেন। আইনস্টাইন রাতে ঘুমাতে পারছেন না। যদি তাঁর তত্ত্ব নিয়ে বোমা বানিয়ে ফাটান হিটলার? লিও জিলার্ড আর ইউজিন উইগনার নামে বিজ্ঞানীদ্বয়ের চেষ্টায় একটা চিঠি মুসাবিদা করা হল। তাতে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্টের কাছে অনুরোধ করা হল, ইউরেনিয়াম দিয়ে অ্যাটম বোমা বানানো হোক। হিটলারকে চাপে রাখা দরকার। চিঠিতে স‌ই করাতে হবে মহাবিজ্ঞানী আইনস্টাইনকে দিয়ে। সভ‍্য সমাজে ওঁর গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নাতীত। আইনস্টাইনের অনুরোধ আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ফেলতে পারবেন না। আগস্টের দুই তারিখে চিঠিতে স‌ই দিলেন আইনস্টাইন। সেপ্টেম্বর মাসের পহেলা তারিখে যুদ্ধ বেধে গেল‌ই। অক্টোবরের এগারো তারিখে আইনস্টাইনের স্বাক্ষরিত চিঠি আমেরিকার প্রেসিডেন্টের হাতে পৌঁছাল। তারপর ম‍্যানহাটান প্রজেক্ট। রবার্ট জে ওপেনহাইমার তার দায়িত্বে। পরমাণু বোমা তৈরি হল। পরীক্ষাও হল। বোমার নাম ট্রিনিটি। নিউ মেক্সিকোর মরুপ্রান্তরে পরমাণু বিস্ফোরণ কর্মসূচির নেতৃত্বে ওপেনহাইমার। তারিখটা ১৬ জুলাই, ১৯৪৫। তার কয়েকটি দিন পর আগস্টের ছয় ও নয় তারিখে জাপানের হিরোশিমা নাগাসাকি শহরে পরমাণু বোমা হামলা।
আইনস্টাইন আর দশটি বছর বেঁচেছিলেন। তিনি ছিলেন যথার্থ শান্তিবাদী মানুষ। অনুতাপ তাঁকে কুরে কুরে খেত। ১৯৫৫ সালের ১৮ এপ্রিল তারিখে আইনস্টাইন সমস্ত দুঃখ যন্ত্রণার অতীত হয়ে গেলেন।

আইনস্টাইন সারাজীবন দুঃখ করেছেন, আমি যদি ঘুণাক্ষরে টের পেতাম যে হিটলার পরমাণু বোমা বানাতে পারবে না, তাহলে কিছুতেই রুজভেল্টকে বোমা বানাতে বলতাম না।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।