T3 || নারী দিবস || সংখ্যায় মৃদুল শ্রীমানী

মেরি দামিনী

আন্তর্জাতিক নারীদিবসে চতুরঙ্গ উপন্যাসের দামিনীকে স্মরণ করি। এই উপন‍্যাসটি পুস্তকাকারে প্রকাশ করেছিলেন ইন্ডিয়ান প্রেস। সময়টা ১৯১৬ সাল। উপন্যাসটি তার ঠিক আগের বছর সবুজপত্র পত্রিকায় অগ্রহায়ণ থেকে ফাল্গুন পর্যন্ত চারটি সংখ‍্যায় চারটি গল্প আকারে বেরিয়েছিল।
গল্পের কাহিনিতে দামিনী একজন তরুণী বিধবা। স্বামী শিবতোষের সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছিল কিন্তু শিবতোষ তাকে ঘরের একটা আসবাব ছাড়া অন‍্য কিছু মনে করত না। শিবতোষ ছিল ধর্মোন্মাদ এবং ধর্মের চোলাইতে আপাদমস্তক ডুবে থেকে সে মৃত্যুর পূর্বে তার গুরু লীলানন্দস্বামীর কাছে নিজের স্থাবর অস্থাবর সব সম্পত্তির সঙ্গে তার স্ত্রী দামিনীকেও উৎসর্গ করে দিয়েছিল। ভারতীয় আধ‍্যাত্মিক গুরুদের বৈষয়িক বুদ্ধি যথেষ্ট পরিমাণে থাকে। ইদানীং সংবাদ মাধ্যমে রাম রহিম, আশারাম বাপু সহ অনেক ধর্মগুরুর অবৈধ নারীলিপ্সা ও দণ্ডযোগ‍্য শালীনতাহানির ঘটনা উঠে এসেছে। আদালতে তা নিয়ে মামলা হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে লঘু হলেও কিছুটা শাস্তিও হয়েছে। কিন্তু সমাজে ঢি ঢি পড়া যাকে বলে, ভারতীয় ধর্মগুরুদের কখনই তেমন অবস্থায় পড়তে হয়নি।
চতুরঙ্গ উপন্যাসের শিবতোষের ধর্মগুরু লীলানন্দস্বামীকেও আমরা দেখি অত‍্যন্ত সুকৌশলে শিষ‍্যের স্ত্রীকে নিজের পরিমণ্ডলের মধ‍্যে নিয়ে নিতে। কিন্তু দামিনী শুধুমাত্র বিধবা তরুণীই ছিল না, তার মগজে যথেষ্ট পরিমাণে বুদ্ধি এবং আত্মবিশ্বাস ছিল। শিবতোষের গৃহিণী হিসাবে তার যে খুব বেশি পিছুটান ছিল, তা কিন্তু নয়। বস্তুতঃ শিবতোষের সঙ্গে দামিনীর দাম্পত্য সম্পর্কটা সেভাবে গড়েই ওঠেনি। লীলানন্দস্বামীর কামনার কাছে ধরা দেবার হীনমন্যতা ও রুচির দৈন‍্য তার ছিল না। এমনকি লীলানন্দস্বামীকে বুদ্ধি কৌশলে দূরে রাখার সবরকম সক্রিয় ইচ্ছা তার ছিল। লীলানন্দস্বামীর বাস্তব বুদ্ধি ছিল প্রখর।
জোর খাটালে দামিনী বিগড়ে গিয়ে কী করে বসে, এ ব‍্যাপারে তিনি সতর্ক থাকতেন।
তিনি গুঁড়ি মেরে এগোচ্ছিলেন।
এই ধরনের ধর্মগুরুরা অনেকেই খুব চৌকস হন। নানা বিষয়ে তাঁদের জানাশোনা থাকে। ওই সঙ্গে তাঁদের প্রচুর পরিমাণে বাক কুশলতা থাকে। নৈতিক দিক থেকে দেউলিয়া হলেও ওই রকম কিছু উপরিতলের চটকদারি কৌশল আয়ত্ত করে তাঁরা দিব‍্য ভক্তকুল গড়ে তুলতে পারতেন এবং জাগতিক সুখ ও আরামের কোনো ঘাটতি তাঁদের থাকত না।
এখনও থাকে না। তো এহেন লীলানন্দস্বামী প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ বৃত্তিওয়ালা ব্রিলিয়ান্ট স্কলার শচীশকে নিজের পকেটে পুরে ফেললেন। সর্বসমক্ষে তাকে দিয়ে নিজের পা টেপালেন। অথচ শচীশ ছিল তার নাস্তিক জ‍্যাঠামশায়ের অন‍্যতম শিষ্য
এবং জাঁদরেল তার্কিক। সে যুগে ধর্মগুরুরা এমন অনেক বড় বড় মেধাবী তার্কিক নাস্তিকদের নিজের দলে ভিড়িয়ে অনুগত ভক্ত বানিয়ে শ্লাঘা বোধ করতেন। শচীশের টানে এসে পড়ল তার ঘনিষ্ঠ সহপাঠী শ্রীবিলাস। সেও যথেষ্ট মেধাবী।
লীলানন্দস্বামী তাঁর কারবার ফেঁদেছিলেন প্রয়াত ভক্ত শিবতোষের বাড়িতেই। আর সেখানেই এসে জুটল প্রথমে শচীশ এবং তার পিছনে শ্রীবিলাস। শচীশ লীলানন্দস্বামীর ভক্ত হলেও দামিনীকে দেখতে অস্বস্তিবোধ করল না এবং দামিনীও তাকে দেখল। লীলানন্দস্বামী তাঁর এই দুই ব্রিলিয়ান্ট ভক্তের কাণ্ড
দেখলেন এবং মুখে কিছু বললেন না।
মানুষের সমাজ ভগবানের জন্ম দিয়েছে অনেক পরে। কিন্তু তার ভিতরে যৌনচেতনার অস্তিত্ব বহু পুরোনো। তাই ভগবানের টানে লীলানন্দের দলে ভিড়লেও দামিনীর টান শচীশ ও শ্রীবিলাস, দুজনেই একটু বেশি অনুভব করত। আর দামিনীও দুজন তরুণ বুদ্ধিদীপ্ত মানুষকে এক‌ই বাড়িতে পেয়ে তাদের সঙ্গে সময় কাটাতে পছন্দ করত। দামিনীর ভিতরের টান ছিল শচীশের দিকে, কিন্তু শচীশ নিজেকে একটু ভাবে ভোলা হিসেবে দেখাত। শ্রীবিলাস ছিল দামিনীর অনুরাগী এবং দামিনীর কাছে কাছে থাকতে সে পছন্দ করত। সেটা আবার শচীশ পছন্দ করত না। অথচ খুব একটা কিছু বলতেও পারত না। কেননা, দামিনী যে বিধবা!
এইভাবে একটা চমৎকার গল্প বলতে থাকেন রবীন্দ্রনাথ। ১৯১৬ সালে চতুরঙ্গ উপন্যাস আকারে বেরোনোর বছর তিনেক আগে তিনি নোবেল পুরস্কার পেয়ে গিয়েছেন। আর ততদিনে শান্তিনিকেতনে তাঁর কর্মকাণ্ড বিপুল বেগে চলছে। এই সময়েই কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের পল্লীসমাজ গ্রন্থাকারে বেরিয়েছে। সেখানেও রমা একজন বালবিধবা, আর অন্তরের গভীর থেকে রমেশকে নিজের মনে করে, অথচ সমাজের রক্তচক্ষু ও নিজের ব‍্যক্তিত্বের দুর্বলতায় তা প্রকাশ করে উঠতে সংকুচিত থাকে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজের জমিদারিতে চাষি জোলার উন্নয়নে কৃতসংকল্প। নিজের নোবেল পুরস্কারের টাকা দিয়ে দিয়েছেন চাষির জন‍্য সমবায় ব‍্যাঙ্ক গড়তে জমিদার হিসেবে তিনি যে প্রকৃত‌ই জনদরদী তা সেটেলমেন্ট অফিসারদের রিপোর্টে উঠে এসেছে। তা এমনকি রাজশাহী জেলার গেজেটিয়ারে উল্লেখ করা হয়েছে।
সুভাষচন্দ্র বসুর বিরুদ্ধে প্রেসিডেন্সি কলেজে অধ‍্যাপক ‌ওটেন সাহেবকে লাঞ্ছনার অভিযোগ উঠেছে। এই সুযোগে শুরু হয়ে গেল সরকারের বিকট ছাত্রদমননীতি। ছাত্রশাসনতন্ত্র প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ দমননীতির প্রতিবাদ জানালেন।
এই ১৯১৬ সালেই বাঁকুড়ার দুর্ভিক্ষ পীড়িতদের সাহায‍্যার্থে টিকিট করে রবীন্দ্র নাটক অভিনীত হয়েছে। পঞ্চান্ন বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথ অন্ধ বাউলের ভূমিকায় ফাল্গুনী অভিনয় করেছেন। তারিখটা ৩০জুন। ৮০০০ টাকা দুর্ভিক্ষ ফাণ্ডে দেওয়া হল। ফেব্রুয়ারি মাসের ২ তারিখে উত্তরবঙ্গের জমিদারিতে কলেরার প্রকোপ দেখা দিয়েছিল। নিবারণের চেষ্টায় নিজে সেখানে কাজ করতে গিয়েছিলেন। এই সময়েই রবীন্দ্রনাথ বলাকার কবিতাগুলি লিখে চলেছেন। শঙ্খ কবিতার সূত্রে রবীন্দ্রনাথ ভেবেছিলেন, বলাকার শঙ্খ বিধাতার আহ্বানশঙ্খ, এতেই যুদ্ধের নিমন্ত্রণ ঘোষণা করতে হয় — অকল‍্যাণের সঙ্গে পাপের সঙ্গে অন‍্যায়ের সঙ্গে। উদাসীন ভাবে এ শঙ্খকে মাটিতে পড়ে থাকতে দিতে নেই। সময় এলেই দুঃখ স্বীকারের হুকুম বহন করতে হবে, প্রচার করতে হবে। রম‍্যাঁ রলাঁ, বার্ট্রান্ড রাসেলের নাম উল্লেখ করে তিনি বলেন, এরা যুদ্ধের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল বলে অপমানিত হয়েছে, জেল খেটেছে; সার্বজাতিক কল‍্যাণের কথা বলতে গিয়ে তিরস্কৃত হয়েছে। এই ১৯১৬ সালেই ডিসেম্বর মাসে লক্ষ্ণৌতে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের যৌথ অধিবেশনে লক্ষ্ণৌ চুক্তি হয়। স্থির হয়, প্রাদেশিক ও কেন্দ্রীয় আইনপরিষদে নির্দিষ্ট সংখ্যক মুসলিম আসন থাকবে- বিনিময়ে মুসলিম লীগ কংগ্রেসের স্বরাজ আদর্শকে সমর্থন জানাবে। প্রমাণ হল হিন্দুমুসলিম বিরোধ অনিবার্য নয়, ধর্মে পৃথক হলেও তারা জাতীয় আন্দোলনের ক্ষেত্রে ঐক্যবদ্ধ হতে পারে। পল্লীসমাজ উপন‍্যাসে আকবর লাঠিয়াল চরিত্রটিকে শরৎচন্দ্র মনুষ্যত্বে উদ্দীপিত করে দেখিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর‌ও চতুরঙ্গ উপন‍্যাসে জ‍্যাঠামশায়ের বাড়ির এলাকার অধিবাসী মুসলমানদের শুভকাজে বলিষ্ঠ ও সংগঠিত সমর্থক হিসাবে দেখিয়েছেন। দুটি উপন‍্যাসেই ঘনিষ্ঠ পরিচিত হিন্দু ব্রাহ্মণরা পরস্পরের মধ‍্যে অশান্তি বিদ্বেষ তৈরি করছে, আর নিচের তলার মুসলমান ঐক্য ও প্রীতির সম্পর্ক গড়তে এগিয়ে আসছে। ন‍্যায়ের পক্ষে দাঁড়াতে চাইছে।
এই ১৯১৬ তেই বোম্বাইতে ভারতের প্রথম নারী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হয়েছে। ১৯১০ সালে কবি নিজের পুত্রের বিবাহ দিলেন বাড়ির‌ই বিধবা মেয়ে প্রতিমার সঙ্গে। প্রতিমা ছিলেন গগনেন্দ্রনাথের বোন বিনয়িনী দেবীর বিধবা কন‍্যা। প্রতিমাকেই তাঁর খুব ছোটবেলায় পুত্রবধূ হিসেবে মনোনীত করে রেখেছিলেন কবিপত্নী মৃণালিনী দেবী। কিন্তু প্রতিমার অন‍্যত্র বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। অল্পবয়সেই প্রতিমা স্বামীহারা হলে প্রয়াত স্ত্রীর ইচ্ছার মর্যাদা দিতে রবীন্দ্রনাথ এই বিবাহ ঘটান এবং এটাই ঠাকুরবাড়িতে প্রথম বিধবা বিবাহ।
এছাড়া এই ১৯১৬ তেই চিত্তরঞ্জন দাশের কন‍্যা অপর্ণা দেবীর বিবাহ হয়। সেটি হিন্দু শাস্ত্রানুসারে প্রথম অসবর্ণ বাঙালি বিবাহ। এর কিছুদিন আগে, ১৯১৫ সালের ৬ মার্চ গান্ধীজি শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্র সকাশে আসেন। ১৯১৪ সালের নভেম্বরে গান্ধীর নাটালের ফিনিক্স বিদ‍্যালয়ের ছাত্র ও শিক্ষকেরা এসে শান্তিনিকেতনে আশ্রয় নেন। ১৯১৪ সালের ৪ আগস্ট প্রথম বিশ্বযুদ্ধ বেধে গিয়েছে। এর আগে ১৯১৩ সালে চীনদেশে আফিঙের নেশার কুপ্রভাব নিয়ে বিশ্বের গুণীজন সোচ্চার হয়েছেন। ইংরেজ চীনদেশে শাসনকে দীর্ঘায়ত করার লক্ষ্যে এই অপকীর্তি করেছে। রবীন্দ্রনাথ এর বিরুদ্ধে কলম ধরেছেন। পর্তুগালের লিসবন এ বন্দর কর্মীরা ধর্মঘট ডেকেছেন। ১৯১১ সালে ইংল‍্যাণ্ডে পার্লামেন্টে বিল এর দৌলতে হাউস অফ কমনস এর কাজের উপর হাউস অফ লর্ডস এর প্রতিবন্ধকতামূলক ভেটো প্রয়োগের ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া হয়েছে। গোটা ব্রিটেন জুড়ে শ্রমিকশ্রেণী জেগে উঠেছে। মেয়েদের ভোটাধিকারের দাবিতে জঙ্গি আন্দোলন মাথা চাড়া দিয়েছে।
১৯১১সালে ক্লারা জেটকিনের নেতৃত্বে ১৯ মার্চ গোটা ইউরোপ জুড়ে মহিলারা রাস্তায় বেরিয়ে এলো। মহিলাদের ভোট দেওয়ার অধিকার, জনপ্রতিনিধি হওয়ার অধিকার এবং একই কাজের একই মজুরির দাবিতে উত্তাল হয়ে উঠলো ইউরোপের শহরগুলো। ঐ ইংল্যান্ডে মহিলাদের ভোটাধিকারের দাবীতে শহীদ হলেন এমিলি ডেভিডসন। ভারতের বিপ্লবীদের ওপর যে অত্যাচার পদ্ধতি প্রয়োগ করতো ব্রিটিশ সরকার, সেই একই পদ্ধতি প্রয়োগ করা শুরু হলো প্রতিবাদীদের ওপর – জেলে অনশনরত মহিলাদের গলা বা নাক দিয়ে জোর করে টিউব ঢুকিয়ে তাদের খাওয়ানোর চেষ্টা চললো। ডিভোর্স, অ্যাবর্শন, যৌনতা, মাতৃত্ব – নারীদের অধিকারের কথা তুলে জনজাগরণের চেষ্টা চালিয়ে গেলেন আলেকজান্দ্রা কোলোনতাই, ক্লারা জেটকিন, রোজা লাক্সেমবার্গ। প্রেম, ভালোবাসা, বিবাহ, যৌনতা, পরিবার, মাতৃত্ব, সম্পত্তি, উত্তরাধিকার – সমস্ত প্রশ্নে নারীদের সামনে এক নতুন চেতনার উন্মেষ ঘটলো। লড়াইয়ের সাফল‍্যে শেষ পর্যন্ত ১৯২৮ এ ইংল্যান্ডের মহিলারা ভোটাধিকার পেলো।
বাংলায় নারীদের শিক্ষা সচেতনতা ও স্বনির্ভর হবার সক্রিয় উদ‍্যোগ নিয়েছিলেন ভগিনী নিবেদিতা। তিনি জগদীশচন্দ্র বসু, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর সহ বাংলার বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবীদের উৎসাহ উদ্দীপনা যোগাতেন। ১৯১১ সালের ১৩ অক্টোবরে মাত্র চুয়াল্লিশ বছর বয়সে প্রয়াত হলেন তিনি। স্বাধীনতা পিপাসু বিপ্লবীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন, তাদের প্রতি সহমর্মিতা দেখান, এই অভিযোগে তাঁকে রামকৃষ্ণ মিশন থেকে বিতাড়িত হতে হয়েছিল।
১৯১৬ তে চতুরঙ্গ বেরোনোর আগে এই বছর পাঁচেকের ইতিহাসটা আমরা বিবেচনার মধ‍্যে রাখতে পারি। চতুরঙ্গের কাহিনি বিয়োগান্তক হলেও তার মধ‍্যে মিলনের একটা ছবি আছে। দামিনী সমস্ত শরীর মন দিয়ে শচীশকে চেয়েছিল। কিন্তু শচীশ দামিনীকে সেভাবে গ্রহণ করতে পারে নি, আবার দূরেও ঠেলতে পারেনি। এই জায়গাটায় একটা আলোকমুখীন ভূমিকা নিয়েছিল শ্রীবিলাস। সে ঘনিষ্ঠ শুভার্থীর মতো দামিনীকে লীলানন্দস্বামীর কবল থেকে উদ্ধার করে এবং সমাজের নানা চোখরাঙানি, কটু কাটব‍্য এবং আক্রমণ থেকে তাকে সুরক্ষিত রাখে। বাইরের লোকের চোখে তারা স্বামী স্ত্রীর মতোই থাকত, কিন্তু নিজেরা জানত তারা আসলে খুব ভাল বন্ধু। তাদের দুজনের মধ্যে শচীশের‌ও জায়গা ছিল।
এইসূত্রে আমি ইউরোপের এক গুণী বৈজ্ঞানিকের কথা বলতে চাই। মাদাম মেরি কুরি তেজস্ক্রিয়তা আবিষ্কারের সঙ্গে জড়িত থেকে মোট দুইবার নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। প্রথমে ১৯০৩ সালে পদার্থবিজ্ঞানে স্বামী পিয়ের কুরি এবং প্রবীণ বিজ্ঞানী হেনরি বেকারেল এর সঙ্গে। পরে বিশুদ্ধ রেডিয়ম তৈরির পদ্ধতি আবিষ্কার করে ১৯১১ সালে রসায়নে। মেরি কুরি শুধুমাত্র গবেষণা করেই ক্ষান্ত দেন নি, রেডিয়ম দিয়ে যাতে ক‍্যানসারের চিকিৎসা সম্ভব হয়, সেজন্য ফিজিক্স কেমিস্ট্রি বায়োলজি ও মেডিসিন, এই চারটি বিভাগের বিশ্বমানের ল‍্যাবরেটরি তৈরি করেছিলেন স্বপ্রতিষ্ঠিত রেডিয়ম ইনস্টিটিউটে। এছাড়া প্রথম বিশ্বযুদ্ধে আহত সৈনিকদের এক্স রে পরিষেবা নিশ্চিত করে শল‍্যচিকিৎসার মাধ‍্যমে তাঁদের বাঁচাতে তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণ হাতে করে ঘুরে বেড়াতেন। সাথে নিয়ে যেতেন তাঁর সপ্তদশী কন‍্যা আইরিনকে।
এইজন্য তিনি নিজের হাতে এক্স রে মেশিন চালাতে শিখেছিলেন, আর শিখেছিলেন অ্যানাটমি। আহত সৈনিকদের কাটা ঘায়ে জীবাণু সংক্রমণ ঠেকাতে তিনি নিজের কাছে রেডিয়মের সূঁচ রাখতেন। আর পোর্টেবল এক্স রে মেশিন‌ওয়ালা অনেকগুলি গাড়ি এবং শল‍্যচিকিৎসার সাজসরঞ্জাম কিনতে তিনি নোবেল পুরস্কারে পাওয়া টাকা উজাড় করে দিয়েছিলেন। অন্ততপক্ষে দশলক্ষ আহত সৈনিকের চিকিৎসা পরিষেবা নিশ্চিত করে ছিলেন তিনি। কাজে যাতে সহযোগিতা পান, তাই অনেক মহিলাকে নার্সিং শিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে উদ‍্যমী হয়েছিলেন। কিন্তু নিজের শরীরকে এক্স রে বিকিরণ থেকে বাঁচাতে পর্যাপ্ত সুরক্ষা ব‍্যবস্থার আয়োজন করে উঠতে পারেন নি তিনি। নিজে আক্রান্ত হয়েছিলেন অ্যাপ্লাসটিক অ্যানিমিয়ায়।
অথচ মাদাম কুরির জীবনে আঘাত কিছু কম আসেনি। ১৯০৬ সালে প‍্যারিসের রাস্তায় অতর্কিত পথদুর্ঘটনায় পিয়ের কুরির মৃত্যু হয়। দুটি নাবালিকা কন‍্যা নিয়ে মেরি কুরি ভেঙে পড়েন নি। পিতৃহারা বালিকাদের যত্ন নিয়েও উচ্চ মানের গবেষণায় ডুবে থেকেছেন। এই সময় কাজ করতে করতে আরেকজন পদার্থবিজ্ঞানী পল ল‍্যাঙ্গেভিনের সঙ্গে তাঁর হৃদ‍্যতা ও ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে। পল ল‍্যাঙ্গেভিন ছিলেন পিয়ের কুরির ছাত্র। মেরির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হবার কিছু আগে তাঁর বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে গিয়েছিল। তার উপর ল‍্যাঙ্গেভিন ছিলেন মেরি কুরির থেকে বছর পাঁচেকের ছোট। এই পরিস্থিতিতে ল‍্যাঙ্গেভিনের সঙ্গে মেরি কুরির সম্পর্ককে কুৎসিত আকারে দেখিয়ে কেচ্ছা পরিবেশনে মেতে ওঠে বেশ কয়েকটি সংবাদপত্র। নোবেল কমিটির প্রধান আরহেনিয়াস এই কেচ্ছা শুনে বিচলিত হয়েছিলেন। তথাপি নোবেল কমিটি মেরিকে রসায়নে পুরস্কারের জন‍্য মনোনীত করে। তখন আরহেনিয়াস মেরিকে পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে উপস্থিত হতে নিষেধ করেন। কিন্তু মেরি কুরি হার মানেননি। বাঘিনীর দাপটে তিনি বলেছিলেন আমাকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে আমার বৈজ্ঞানিক গবেষণার জন্য। আমার শোবার ঘরে আমি কী করছি, লোকজনের সেখানে উঁকি মারার দরকারটা কী?
বলা দরকার, পিয়ের কুরির সঙ্গে সম্পর্ক মেরির গড়ে ওঠে কাজ করতে গিয়ে। মেরি ছিলেন পোল‍্যাণ্ডের মেয়ে। স্নাতক স্তরে স্বর্ণপদক পেয়েও যখন উচ্চতর শিক্ষার সুযোগ পোল‍্যাণ্ডে মিলল না, তখন গরিব বাড়ির মেয়ে মেরি চলে এসেছিলেন ফ্রান্সে। পর্যাপ্ত পরিমাণে খাবার তাঁর জুটত না। শীত কাটাতে রাতে তাঁকে নিজের সবকয়টি পোশাক গায়ে চাপিয়ে নিতে হত।
এই পরিস্থিতিতে গবেষণার জায়গা খুঁজে পাওয়া ছিল একটা চ‍্যালেঞ্জ। পিয়ের কুরির সঙ্গে ভাগাভাগি করে ল‍্যাবরেটরি ব‍্যবহার করবেন, এমন একটা আয়োজন থেকে তাঁদের মধ‍্যে সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ক্রমে পিয়ের কুরি নিজের গবেষণার বিষয় পাশে সরিয়ে রেখে মেরির কাজে যুক্ত হয়ে যান‌। এমনকি, মেরিকে পেতে চেয়ে পিয়ের কুরি নিজের দেশ ছাড়তেও প্রস্তুত ছিলেন।
তবে মেরির প্রথম ভালবাসা ছিল অন‍্যত্র। আগেই বলেছি পোল‍্যাণ্ডে মেয়েদের উচ্চশিক্ষার সুযোগ তেমন ছিল না। তাই গ‍্রাজুয়েট হবার পর মেরির প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশুনার সুযোগ জুটল না। গরিব বাড়ির মেয়ে মেরি কাজ নিতে বাধ‍্য হল এক জমিদার পরিবারে‌। ওদের বাড়িতে একটি ছেলেকে বড় ভাল লাগত মেরির। কাজিমিয়ের্জ জোরাওয়াস্কি নামে ছেলেটিও তাঁকে ভালবাসতে‌ন। কিন্তু ছেলের বাপ মা গরিব বাড়ির মেয়ের সঙ্গে ছেলের বিয়ে দিতে সাংঘাতিক অশান্তি করেন।
বিয়ে হল না‌ যদিও কাজিমিয়ের্জ আজীবন মেরির প্রতি অনুরক্ত ছিলেন, তিনি খুব নামী গণিতবিদ অধ্যাপক হয়েছিলেন। ছেষট্টি বৎসর বয়সে মেরির মৃত্যুর পর তাঁর প্রতিষ্ঠিত গবেষণাগারের সামনে মেরি কুরির স্ট‍্যাচুর পদতলে বসে আনমনে সময় কাটাতেন সেই কাজিমিয়ের্জ।
বিয়ে কোনো জন্ম জন্মান্তরের সম্পর্ক নয়। জীবনের প্রতিটি বাঁকে বাঁকে অপার সম্ভাবনা লুকিয়ে থাকে। আর এই জীবন মানুষ পায় মাত্র একটিবার। তাই জীবনে কোথাও হতাশার কাছে ব‍্যর্থতার কাছে মাথা না নামিয়ে নতুন করে নিজেকে আবিষ্কার করার মধ‍্যেই রয়েছে মনুষ্যত্বের অভিজ্ঞান। আজ চতুরঙ্গের দামিনী আর বাস্তবের অসমসাহসী মেয়ে মেরিকে স্মরণ করতে ভাল লাগছে।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।