রম‍্যকথায় মৃদুল শ্রীমানী

হনুমানের আশ্চর্য কথা

শ্রীরামচন্দ্র ভ্রাতৃগণসহ রাজসভায় বসিয়া আছেন। হনুমান, সুগ্রীব, নল, অঙ্গদ প্রমুখ পদস্থ মহাকপিগণ এবং মহাভল্লুক জাম্ববান নিজ নিজ মর্যাদার উপযোগী আসনে সমাসীন। সুগন্ধি তৈলে ঘন কেশদামে বহুমূল্য মুকুতামালা জড়ানো মদিরাক্ষী সুস্তনী সুন্দরী রক্ষনারীগণ ব্যজন করিতেছে। সভাসদ দিগের সম্মুখভাগে রক্ষিত রজতপাত্রে দ্রাক্ষা, আম্র, পনস কোষ, দাড়িম্ব, কদলী প্রভৃতি বিভিন্ন সুপুষ্ট ফল রক্ষিত। সুবর্ণ ভৃঙ্গারে শ্যাম্পেন রম শেরি ক্লারেট ইত্যাদি বহুমূল্য আসব রক্ষিত। পবননন্দন নিজের আজানুলম্বিত বাহু দুটি শ্লথভাবে কোলের উপর রাখিয়া বাতায়ন পথে কোন সুদূরের পানে চাহিয়া রহিয়াছেন । বিভীষণ আপাদমস্তক শ্বেত কৌষিক বসনে সজ্জিত। সারা গায়ে কোনো অলঙ্কার সজ্জা না করিয়া কেবল পাদুকা দুটিতে দুটি দ্যুতিময় স্বচ্ছ বর্ণহীন হীরকখণ্ড স্থাপিত করিয়া নিজ আভিজাত্যের সমুচ্চতা প্রতিষ্ঠা করিয়াছেন। শ্রীরাম ও ভ্রাতাগণের সর্বশরীর হিরণ্য অলঙ্কারে জুয়েলারী বিপণিকে লাজনম্র করিয়া ঝলসিয়া উঠিতেছে। শ্রীরাম একখানি কোট পরিয়াছেন। উহাকে দশলাখি স্যুট কহে। নরেন্দ্র শ্রীরাম ইদানীং এই ধরণের কোটেই অঙ্গরক্ষা করিতে অভ্যস্ত হইয়াছেন। সংসারের প্রতি সুতীব্র বৈরাগ্যবশতঃ তিনি দেশের কোষাগারের বহু অর্থব্যয়ে নিয়মিতভাবে বিদেশ ভ্রমণ করিয়া থাকেন। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যে নরেন্দ্র শ্রীরাম একান্তভাবে দায়বদ্ধ। শ্রীরামের আর্থিক নীতি লইয়া রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর রীতিমতো মৌলিক প্রশ্ন তোলায়, রঘুনাথ তাহাকে ছুটি দিয়েছেন। না, গভর্নরটি বিজ্ঞ বটে। দেশে বিদেশে হার্ভার্ডে সম্মানিত অধ্যাপক হইলে কি হয়, শ্রীরাম অর্থনীতিতে তাঁহার ভক্তি ও আস্থা নাই। তাই রঘুনাথ রিজার্ভ ব্যাঙ্কে অর্থনীতি বিষয়ে অকিঞ্চিৎকর জ্ঞানের অধিকারী ব্যক্তিকে আসীন করিয়াছেন। কলি যুগে ভক্তিই সব। শ্রী পাদপদ্মে পর্যাপ্ত ভক্তি থাকিলে আলাদাভাবে কোনো কেতাব পড়িতে হয় না। জ্ঞানাঞ্জনশলাকয়া … প্রভুর জ্ঞানই অযোধ্যারাজ্য পরিচালনার পক্ষে সুপ্রচুর। কোশল দেশে ইদানীং কখনো অন্য কাহারও জ্ঞানের ভাণ্ডারটি মুক্ত করার প্রয়োজন পড়ে না।
হনুমানের চোয়াল দেখিয়া বোঝা যাইতেছিল তাহা ঝুলিয়া আছে। বিভীষণ নতনেত্রে নিজ পাদুকার কৃষ্ণাজিনের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করিতেছিলেন।
ভরত ও শত্রুঘ্ন কিঞ্চিৎ গুম মারিয়া বসিয়া আছেন। বিশেষতঃ ভরতের মামাবাড়ি নন্দীগ্রাম, যাহা বর্তমানে বঙ্গে অবস্থিত, সেখানে শ্রীরামের পার্টি নিজ পরিস্থিতির উন্নতিসাধনে বদ্ধপরিকর। কিন্তু তাহাতে ভরত সংশয়াচ্ছন্ন। নন্দীগ্রাম ভরতের মাতুলালয়ের সূত্রে প্রাপ্ত রাজত্ব। যেহেতু উহা পৈতৃক নহে, সেহেতু উহাতে অন্য ভ্রাতৃগণের বিশেষতঃ শ্রীরামের কিছুই বলিবার নাই। কিন্তু বর্তমানে নরেন্দ্র রাম বঙ্গ ব্যাপারে অধিকতর সংবেদনশীল হইয়া উঠিয়া ভরতের অস্বস্তি উৎপাদন করিতেছেন।
শত্রুঘ্নও ভরতের দেখাদেখি তূষ্ণীম্ভাব অবলম্বন করিয়া আছেন। তাঁহার নাম শত্রুঘ্ন। শত্রুদের ব্যাপারে ব্যবস্থা গ্রহণ করা তাঁহারই এক্তিয়ার বটে। কিন্তু ইদানীং নরচন্দ্রমা সে ব্যাপারে নিজেই বক্তব্য রাখেন। শত্রুঘ্ন শত্রুরাষ্ট্র ব্যাপারে কিছু বলিবার আগেই নরেন্দ্র রাম যাহা মন প্রাণ চায় বলিয়া দেন। মিডিয়া পারসনগুলিও হইয়াছে তেমনই। কোন ব্যাপারে সাংবিধানিক এক্তিয়ার কাহার, তাহার তোয়াক্কা না করিয়া রাষ্ট্রপতি হিসাবে শ্রীরামকেই সকল প্রশ্ন করেন। ইহা শত্রুঘ্নকে নিজ ভবিষ্যৎ সম্পর্কে অনিশ্চিত বার্তা দিতেছে।
সুগ্রীব, বিভীষণ, এবং গুহক রাজা যথাক্রমে কিষ্কিন্ধ্যা, শ্রীলঙ্কা ও চণ্ডাল রাজ্যের অধিপতি হইয়াও নিয়মিতভাবে নরেন্দ্র শ্রীরামের দরবারে হাজিরা দিতে বাধ্য থাকেন। নিজেদের রাজ্যে যাঁহার যতটুকু কাজ না করিলে নয়, সে ব্যাপারে নরচন্দ্রমার কাছে আবেদন করিলে দূর্বাদলশ্যাম তাঁহাদের রাজ্য ব্যাপারে পদক্ষেপগুলি নিজেই স্থির করিয়া আমলাদিগকে স্বয়ং নির্দেশ দিয়া থাকেন। এ কারণে নিজ নিজ রাজ্যে সুগ্রীব, বিভীষণ, ও গুহক চণ্ডাল ক্রমেই ব্রাত্য হইয়া পড়িতেছেন। সমস্ত ক্ষমতা কুক্ষিগত করিয়াছেন নরেন্দ্র রাম ও তাঁহার যোগ্য দোসর লক্ষ্মণ।
রামরাজ্য বলিতে সুশীল সমাজ যাহা বুঝে, তাহা আর নাই। দশলাখি কোটের ভিতর সমস্ত অন্তর্হিত হইয়া আছে। এদিকে পেট বড় বালাই। পেটের দায় বড় দায়। তাহা সত্যস্বরূপকে চিনাইয়া দেয়। ভূরিপরিমাণ বাক্যরাশির অন্দরমহল হইতে সারসত্য তুলিয়া আনে।
হনুমান এমতাবস্থায় নিজের হীন অবস্থা সম্পর্কে ক্রমশঃ অধৈর্য হইয়া উঠিতেছেন। তিনি বিরাট বংশের সন্তান। তাঁহার মা বানররাজ কেশরীর রানী অঞ্জনা। অঞ্জনা ছিলেন আরেক বানররাজের কন্যা। কেশরী রাজা ঊর্ধ্বরেতা হওয়ায় অঞ্জনা পবনদেব কর্তৃক গর্ভবতী হন। সেই বাবদে হনুমানের শরীরে রাজরক্ত ও ব্রহ্মরক্ত একসাথে বহিতেছে। কিন্তু আড়াল হইতে বালীবধ করিয়া শ্রীরাম বানরকুলে এক বিপুল প্রতিপত্তি অর্জন করিয়া বসিয়া আছেন। সুগ্রীব যেন পৈতৃক কিষ্কিন্ধ্যা নয়, নেহাত রামের দয়ার দানে রাজপদ পাইয়াছেন, লোকারণ্যে ইহাই চালু। হনুমানেরও যে কেশরীসূত্রে রাজপদ প্রাপ্য, তাহা লোকে কবেই ভুলিয়াছে। হনুমান এখন ভাবেন যে তিনি দলিত। কেননা তাঁহাকে ঠকানো হইয়াছে। ভালো লাফালাফি করিতে পারেন বলিয়া তাঁহাকে লঙ্কায় সর্বাগ্রে পাঠানো হইয়াছিল। সেখানে তিনি মর্কটের ছদ্মবেশে সকল খবরাখবর লইয়া নরেন্দ্রকে পাচার করিতেন। সীতাকে অশোকবনে চেড়িদল পরিবৃত অবস্থায় হনুই লক্ষ্য করেন। আজকাল ড্রোন নামে যন্ত্র উদ্ভাবিত হওয়ায় হনুর সেই অলোকসম্ভব অণিমা প্রভৃতি গুণের কোনোই কদর নাই। ড্রোন প্রচুর পরিমাণে ছবি তুলিয়া মুহূর্তে পাঠাইতে পারে। কিন্তু হনুসদৃশ কৌতুক ড্রোনের সাধ্যাতীত। সেই যে রাবণের সাধের আম্রকাননটি লণ্ডভণ্ড করা, পরে ব্রহ্মাস্ত্রের জেরে চুপ করিয়া পড়িয়া থাকা, আবার নির্বোধ রাক্ষসদের কাপড়চোপড় আনিয়া বাঁধায় ব্রহ্মাস্ত্র থেকে মুক্তি পাইয়া লেজে আগুন লাগায় লঙ্কাকাণ্ড বাধানো, পরে ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশে খোদ মন্দোদরীর কাছ থেকেই রাবণের মৃত্যুবাণ চাহিয়া আনা, এই কাজগুলো লোকে ভুলিয়াছে। যদিও প্রবাদ বাক্যে লঙ্কাকাণ্ড চিরস্থায়ী আসন পাইয়াছে, তবুও হনুমান নিজেকে বড়ই বঞ্চিত ভাবেন। সীতা জীবিত থাকিলে সীতার থেকে কিছু কিছু আদায় হইলেও হইতে পারিত, কিন্তু তুখোড় পলিটিশিয়ান নরেন্দ্র রামচন্দ্র সীতাকে জনস্বার্থের দোহাই পাড়িয়া নানাভাবে হেয় করিয়া নির্বাসিত করিয়া আত্মহত্যা করিতে বাধ্য করেন। কে কবে শুনিয়াছে, কোনো সভ্যলোকে গর্ভবতী স্ত্রীকে বনবাস দেয়। রামের জানা উচিত ছিল যে সত্যযুগের সাধ্বী বেদবতীর অভিশাপের কারণেই রাবণের পক্ষে বলপূর্বক অন্য মহিলাকে ধর্ষণ সম্ভব ছিল না। আধুনিক জুরিসপ্রুডেন্স বলে যে ধর্ষিতা কেবল একজন সাক্ষী মাত্র। ধর্ষণ অপকাণ্ডে তার কোনো ভূমিকাই নাই। কিন্তু সে সব এই জম্বুদ্বীপে কে আর বোঝে! সুতরাং হনুমান বিমর্ষ মুখে বসিয়া বসিয়া নিজের হীন দলিত অবস্থা কাটাইবার জন্য একটি বড়সড় আন্দোলনের মতলব ভাঁজিতেছিলেন।
ঠিক এমন সময় রসিকতা করিয়া নরেন্দ্র শ্রীরাম বলিলেন, “কি রে ব্যাটা হনু, এত দুঃখী মুখ করে বসে আছিস কেন?”
লক্ষ্মণ ফস করিয়া বলিয়া বসিলেন, “বাঁদুরে পোড়া মুখের কথা মনে পড়ে গিয়েছে বোধ হয়।”
হনুমানের ব্রহ্মরক্ত রাজরক্ত একসাথে চলকাইয়া উঠিল। ব্রহ্মরন্ধ্রে দ্রিমি দ্রিমি তালবাদ্য বাজিয়া উঠিল। এমন সময় নরেন্দ্র শ্রীরাম বলিলেন, “হ্যাঁ রে, লেজের আগুন নেবাতে আর কিছু না পেয়ে শেষে মুখের ভিতর পুরলি?”
হনুমানের মনে পড়িল সাগর দেবতার ত্রস্ত ভয়ব্যাকুল মুখখানি। নম্রশিরে যুক্তকরে তিনি বলেছিলেন “ভগবন, আপনার লাঙ্গুলের ওই আগুন এই জলে দিলে গোটা সাগরের এনভায়রনমেন্টাল ক্রাইসিস আসিবে। বায়ো ডাইভার্সিটি বিলুপ্ত হইবে। খাদ্য শৃঙ্খল বিপর্যস্ত হইবে। মহাশয় রক্ষা করুন।”
হনুমান সেই কাতর আবেদন রক্ষা করেছিলেন। সেই পরিস্থিতি মনে পড়িতে সরোষে সক্ষোভে তিনি বলিলেন, “রাজা, মুখ আমার পোড়ে নি। পুড়েছে তোমার। নিজের ক্ষমতা হাসিল করবার জন্য তুমি যুদ্ধ বাধাও। আবার দীনদয়াল সেজে তুমি নিরপরাধকে শাস্তি দাও। রাজা, মুখ যদি কারো পুড়ে থাকে, সে একমাত্র তোমার মত অহংকারী লোকের। রাবণ তোমারই লোক। রাবণ তোমারই কর্মচারী। দারোয়ান। তাকে তুমিই রাক্ষস সাজিয়েছিলে। এ সব তোমার চক্রান্ত। রাজা, সব ফাঁস হবে। মুখ পুড়িয়েছ একমাত্র তুমি। ”
হনুমানের বজ্রকণ্ঠ শুনে সকলে শিহরিত হয়ে উঠলেন।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *