সাপ্তাহিক ধারাসম্পাতে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব – ১১)

আমার কথা
৪১
দামিনী নিরুপমা এলা নন্দিনী মৃণাল কিছুতেই নিজের মনুষ্যত্বকে খণ্ডিত হতে দিতে চায় নি। বারে বারে দেখিয়ে দিয়েছে নারীজন্মটাও একটা অত্যন্ত সুন্দর সুযোগ। সেটা একটু মনের জোর থাকলেই সার্থক করা যায়। আর যাই হোক পুরুষের পায়ের তলায় নারীর থাকাটা কিছু প্রকৃতিনির্দিষ্ট নয়।
৪২
এক যে ছিল রাজা। হেজিপেঁজি রাজা নয়, একেবারে দোর্দণ্ডপ্রতাপ রাজা। সেই রকম রাজা, যার হাঁকডাকে বাঘে গরুতে এক ঘাটে জল খায়। রাজার নাম ক্যানিউট। রাজা ক্যানিউটকে ঘিরে থাকে স্তাবকের দল। গিজ গিজ করছে পারিষদেরা, যো হুকুম বলে কান এঁটো করা হাসি বিলাচ্ছে মোসাহেবের দল।
ক্যানিউট নিজের স্তাবক, পারিষদ আর চাটুকারদের দেখে গর্বে ফুলে ওঠেন। তিনি একদিন সমুদ্রের তীরে গিয়ে সমুদ্রের ঢেউকে থেমে থাকতে বললেন। সমুদ্র শুনল না। পর মুহুর্তে আবার ঢেউ পাঠিয়ে দিল। রাজার ধমক চমক কোনো কিছুই সমুদ্রের ঢেউ কানে নেয় না। রাজা ক্রুদ্ধ হলেন, সমুদ্র পাত্তা দেয় না। রাজা ক্ষুব্ধ হলেন, সমুদ্র কানে নেয় না। রাজা বিরক্ত হলেন, সমুদ্র ফিরে চায় না পর্যন্ত। অবিশ্রান্ত আছড়ে পড়তে থাকে তটে। মানুষের শুদ্ধ চিন্তার মতোন।
৪৩
কলকাতায় কত অজস্র মিউজিয়াম। ভারতীয় যাদুঘর তো আছেই, তার সাথে ভিকটরিয়া মেমোরিয়াল, গুরুসদয় রোডের বিড়লা বিজ্ঞান মিউজিয়াম, সায়েন্স সিটি, কলকাতা বিশ্ব বিদ্যালয়ে শতবার্ষিকী ভবনে, বিড়লা প্লানেতারিয়মে আর মৌলালি যুব কেন্দ্রে আর কলকাতা পুলিশ মিউজিয়াম আর জোড়াসাঁকোয় ঠাকুর বাড়িতে, সেও তো মিউজিয়াম বটে।
মনে পড়ছে বড় জেঠামশায়কে। স্ত্রী ও সন্তান হারিয়ে তিনি আমাদের নিয়ে ভুলে থাকতেন। আর কখনো সখনো নিয়ে যেতেন মিউজিয়াম। সাথে নিতেন বাড়িতে তৈরী খাবার। পয়সা বাঁচত, শরীর বাঁচত। সেই মিউজিয়াম ঘোরার দিনগুলি ভুলব না।
৪৪
যে দেশে বিদ্যালয়কে লোকে বিদ্যামন্দির বলে, সেই দেশে ছোটোখাটো বিদ্যালয় বা সাধারণ কলেজে পানীয় জল, আলো ও শৌচাগারের ব্যবস্থা কেন যে পর্যাপ্ত নয়, তা বোঝা শক্ত। সরকারের দায়িত্ব যদি নাও ধরি, যাঁরা রুটি রুজির জন্য দৈনিক সেখানে যাচ্ছেন, তাঁরা এ ব্যাপারে কতদূর কি সচেতন, জানতে ইচ্ছে করে। দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার দুটি একটি স্কুলে এ ব্যাপারে সচেতনতা দেখেছি। আলিপুরদুয়ারের এক প্রবীণ শিক্ষকের কাছে শুনেছি, সরকারি টাকায় স্কুলে শৌচাগার তৈরী হলে ছাত্রদের নিয়ে তিনি প্লাস্টারের পরিচর্যা করতেন। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শিক্ষকেরা তাঁদের অপারগতার কথা বলে উঠতে লেশ মাত্র লজ্জা পান নি।
সেই মেয়েটির কথা মনে পড়ে। দক্ষিণ ২৪ পরগণার একটি ব্লকে ভূমি দপ্তরে নিতান্ত নিচের থাকের কেরানির কাজ পেয়েছিলেন সায়েন্স গ্রাজুয়েট মেয়েটি।
প্রথম দিন অফিসে গিয়ে তিনি মহা বেকায়দায়। বাথরুমে দাঁড়িয়ে আছে , না না উন্নয়ন নয়, ঠিক ধরেছেন, নোংরা বর্জ্য জল। ওরই মধ্যে দুটি থান ইঁট পাতা। তার উপরে ব্যালান্স করে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেবার ব্যবস্থা। মেয়েটির চোখে জল এসেছিল।
উন্নয়ন, তুমি চিরকাল একই থেকে গেলে।
২০০৭ – ২০০৮ এ কোচবিহারের দিনহাটা ১ ভূমি দপ্তরে কাজ করার সময় প্রথম দিকে অফিসে কোনো কার্যকরী বাথরুম ছিল না। বড়বাবু থেকে ছোটবাবু আর আম জনতা সকলে লাইন করে অফিস চত্বরে প্রকাশ্যে হিসি করতেন। মেয়েরা স্বভাবতই পারতেন না। পারার কথাও নয়। পুর এলাকার মধ্যে থাকা অফিসের মহিলা কর্মীরা প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে মাঝামাঝি একটা সময়ে বাড়ি চলে যেতেন। আমি বিষয়টি নিয়ে উঠে পড়ে লাগতে গিয়ে ঠোক্কর খেলাম বিস্তর। বাড়িওয়ালা বললেন, তিনি নিতান্তই নামমাত্র ভাড়া পান। তিনি বাথরুম করে দেবেন না। আর উপরওয়ালা বললেন তিনি ভাড়াবাড়িতে টাকা ঢালবেন না। কর্মস্থলে কর্মচারী সভ্য মাপে বাথরুম পাবে না কেন, সেই প্রশ্ন তুললে বিরক্তি দেখালেন। আমি সহকর্মীদের কাছে হাত পাতলাম। পুরুষ মহিলা নির্বিশেষে সকলে আমায় সাহায্য করলেন। একটি চলনসই বাথরুম দাঁড়িয়ে গেল।
বাড়ির ঘেরাটোপের বাইরে গিয়ে অন্য কোথাও থাকা, আর সাংস্কৃতিক কাজে কর্মে প্রবেশাধিকার পাওয়া, এই সুযোগ আমি ব্যাপক বিস্তৃত আকারে প্রথম পেয়েছি দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার বালুরঘাটে। ওখানে অনেক লিটল ম্যাগাজিন ছিল। আর কমবেশি প্রতিটি বাড়িতেই ছেলে মেয়েরা আঁকা গান, নাচ বা নাট্য চর্চা করত। ব্যাংকের ম্যানেজার বাবুকে গিয়ে সদ্য লেখা কবিতা শোনাতে ভয় করতো না। নেহাত অল্পশিক্ষিত হয়েও সাহিত্য সভায় প্রবেশাধিকার মিলত। চা সিঙ্গারার ভাগে কম পড়ত না।
বলতে গেলে বালুরঘাটে যেন আমার নতুন একটা জন্ম হয়েছিল।