সাপ্তাহিক ধারাসম্পাতে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব – ২৩)

আমার কথা

৮৯
আমার মাস্টারমশাই আমাকে একটি কবিতার বই পড়তে দিলেন। কবির নাম বিষ্ণু দে। কাব্যগ্রন্থের নাম ” উত্তরে থাকো মৌন ” । তখন এগারো ক্লাসে পড়ি । জীবনানন্দের কবিতা আর অমিয় চক্রবর্তীর কবিতা পড়লেও বিষ্ণু দে’র কবিতা পড়ি নি তখনো । দেখলাম কবিতার বইটির নাম দিয়ে একটি কবিতা আছে। এমন থাকেই অনেক সময়। বনলতা সেন এ দেখেছি । তার পরের একটি পংক্তি বেশ মনে আছে আমার … কবি লিখেছেন ” আকুতি কি শুধু যৌন ? ”
কবিতায় স্তন, যোনি এই সব শব্দ গুলি লিখেছিলেন বলে সেরা আধুনিক কবি রূঢ় সমালোচনার শিকার হয়েছিলেন শোনা যায় । সত্যি মিথ্যে জানি না, এই সব শব্দ তো অভিধানেও আছে। নাক সিটকানো পণ্ডিত মহল তাহলে কি শব্দদূষণের দায়ে অভিধানকেও দূর করে দেবেন?

৯০
রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘শ্রেষ্ঠ ভিক্ষা ‘ কবিতায় এক গরিব মেয়ের কথা লিখেছেন। বৌদ্ধ ভিক্ষু তাঁর গুরুর জন্যে নাগরিকদের কাছে শ্রেষ্ঠ জিনিসটি ভিক্ষা চাইছেন। ধনীরা কতো দামি দামি জিনিস উপহার দিতে চাইলো । ভিক্ষু তা নিলেন না । ভিক্ষুর যুক্তি এই যে ওগুলি তো ধনীর সর্বস্ব নয়। এমন সময় একটি গরিব মেয়ে কোনোমতে গাছের আড়ালে থেকে নিজের একমাত্র পরিধেয়খানি ভগবান বুদ্ধের জন্যে দান করতে , ভিক্ষু মহা আনন্দিত হলেন।
ভিক্ষু আনন্দিত হলে কি হবে, সমালোচক পণ্ডিত তো আনন্দিত হলেন না। আরে, একমাত্র কাপড়টা দান করে দিলে এলো গায়ে মেয়ে ঘরে যাবে কি করে? অনাবৃত নারী শরীর লোকের লোভী চোখের শিকার হবে না ?
পণ্ডিতের যুক্তি এ রকম। কবির যুক্তির সাথে তার মেলে না । পণ্ডিতে শব্দ নেড়ে চেড়ে দ্যাখে, কবির দেখা অন্য রকম, ভিন্ন মাপের ।

৯১
তাদের পদবী ছিল কুশারী । কুশারীরা ব্রাহ্মণ । ওই কুশারীদের ঘরের কোন সুন্দরী মেয়েকে তুলে নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা । এলাকার উঁচু থাকের সমাজ সমবেতভাবে এই অন্যায়ের প্রতিবিধান করতে পারে নি। বা চায় নি। একটি মেয়েকে দুর্বৃত্তরা তুলে নিয়ে গেলে সে মেয়েকে আর সমাজে নেওয়া চলে না। এই হল সনাতনী রীতি । দুর্বৃত্ত গুলির সাম্প্রদায়িক পরিচয় খতিয়ে দেখে কুশারী পরিবারটিকে সমাজে ব্রাত্য করে দেওয়া হল। রক্ষণশীল সনাতনী হিন্দু সমাজ ওটুকুই পারতো। অন্যায়ের প্রতিবিধান নয়, অনাথার উদ্ধার নয় , শুধু ব্রাত্য করে দাও । কুশারীরা হয়ে গেলেন পীরিলি বামুন ।
ওদের একজন নীলমণি কুশারী কলকাতায় চলে আসেন। ব্রাহ্মণটিকে লোকেরা ঠাকুর বলতো।
অনেক পরে এই বংশেই দ্বারকানাত্থ ঠাকুর জন্মে রাজা রাম মোহনের সংস্পর্শে এসে ব্রাহ্ম ধর্মের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা নেন । এই ঠাকুর পরিবারের লোকেদের বিয়ে হওয়া নিয়ে ভারি সমস্যা হতো। জামাই বাবাজিদের এনে রাখতে হতো নিজেদের ঘরে। সনাতনী হিন্দুদের কতো রকম কীর্তি !

৯২
কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে অন্নদাশঙ্কর রায়ের মূল্যায়ন অনবদ্য । ভুল হয়ে গেছে বিলকুল / আর সব কিছু ভাগ হয়ে গেছে/ ভাগ হয় নি কো নজরুল । একমাত্র গুণীই গুণের কদর জানে। যেভাবে নজরুল হিন্দু মুসলমানের যুক্ত সাধনা ফুটিয়ে তুলছিলেন নিজের সাহিত্য সাধনায়, তা স্রেফ ইন্টেলেকচুয়ালদের ধরা ছোঁয়ার বাইরে। আমার বালক মনকে ভারি নাড়া দিত নজরুলের কবিতা।
ক্রমে ক্রমে শামসুর রাহমান, সৈয়দ মুজতবা আলি, সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ, জসীম উদ্দিন, ওয়ালিউল্লাহ , আখতারুজ্জামান ইলিয়াস …।
যত্নশীল বাঙালি পাঠকের কাছে এঁরা প্রণম্য লেখক। সাম্প্রদায়িক ধর্মের সংকীর্ণ পরিসরে এদের দেখি না । এই লেখকেরাও আমার চিন্তার বৃত্ত বড়ো হতে সাহায্য করেছেন ।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।