মুখে তাঁর ক্যানসার বাসা বেঁধেছিল। ডাক্তার বলেছিলেন বছর পাঁচেকের বেশি বাঁচবেন না।
তারপরেও আজ সাতাশি বছর বয়সেও তিনি সমান ভাবে সক্রিয় ও চিন্তাশীল।
১৯৩৩ সালে আজকের দিনে জন্মেছিলেন অধ্যাপক অমর্ত্য সেন, শান্তিনিকেতনে। তাঁর অমর্ত্য নামটি রাখেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। মা অমিতা সেন ছিলেন রবীন্দ্র স্নেহধন্য। মাতামহ ক্ষিতিমোহন সেন ছিলেন বিশ্বভারতীর উপাচার্য। ক্ষিতিমোহন সেনের পাণ্ডিত্যের অনুরাগী ছিলেন রবীন্দ্রনাথ।
শান্তিনিকেতনের পাঠভবনে বিদ্যালয়ের পাঠ সমাধা করেন তিনি। ১৯৫১ সালে পড়তে আসেন প্রেসিডেন্সী কলেজে, কলকাতায়। বিষয় ছিল অর্থনীতি। ওখানে পড়তে পড়তেই ধরা পড়ল মুখে ক্যানসার। বছর পাঁচেকের বেশি টিঁকতে পারবেন না, আশঙ্কা ছিল। রেডিয়েশন চিকিৎসা হয়েছিল। ইতিমধ্যে প্রেসিডেন্সীতে অর্থনীতিতে স্নাতক হলেন। সেরে উঠে ১৯৫৩ সালে পাড়ি দিলেন কেম্ব্রিজের ট্রিনিটি কলেজে। সেখানে আবার গ্রাজুয়েশন করলেন। ওই অর্থনীতিতেই। সেটা ১৯৫৫ সাল।
তারপর পিএইচডি। সেখানে গবেষণার বিষয় ছিল দি চয়েস অফ টেকনিকস। এই গবেষক ছাত্রকেই যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাঁদের সদ্যগঠিত অর্থনীতি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ করলেন। ১৯৫৬ থেকে ১৯৫৮ অবধি অমর্ত্য সেন সে দায়িত্ব পালন করেছেন। এরই মধ্যে একটা ব্যাপার ঘটে গেল। কেম্ব্রিজে সেন পেলেন প্রাইজ ফেলোশিপ। তার মানে হল পছন্দসই যা কিছু পড়ার অধিকার। সেন আঁকড়ে ধরলেন দর্শনকে। তাঁকে তর্কপ্রিয় করে তুলল ওই দর্শনের প্রগাঢ় পাঠ।
পরবর্তীকালে ২০০৫ সালে তিনি লিখবেন আর্গুমেন্টেটিভ ইণ্ডিয়ান, বা বাংলা করে বলতে গেলে তর্কপ্রিয় ভারতীয়। মতপ্রকাশের অধিকার, যুক্তিবাদ, সুবিচার এর সপক্ষে বলবেন। হিংসা ও সন্ত্রাসের নানাবিধ মূর্তির বিরুদ্ধেও বলবেন।
অর্থনীতির অধ্যাপক হিসেবে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মজীবনে শুরু। ১৯৫৬ – ৫৮। তারপর অধ্যাপনা দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৬৩ থেকে ১৯৭১। এরমধ্যে ১৯৬০ সালে চয়েস অফ টেকনিকস, যা সেনের পিএইচডি থিসিসের বিষয়, তা গ্রন্থ আকারে প্রকাশ পেয়েছে। দশ বছর পর ১৯৭০ সালে গ্রোথ ইকনমিক্স গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। আর ওই ১৯৭০ এই কালেকটিভ চয়েস অ্যাণ্ড সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার। ১৯৭১ সালে লণ্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে লণ্ডন স্কুল অফ ইকনমিক্স এ অধ্যাপক হিসেবে যোগ দিলেন। ওখানে রইলেন ১৯৭৭ অবধি। এই পর্বে ১৯৭৩ সালে বই লিখলেন অন ইকনমিক ইনইকুয়ালিটি। নাগরিকদের একাংশের প্রতি নির্মম বঞ্চনা ও অসাম্য যে কিভাবে একটা গোটা জাতিকে পঙ্গু করে রাখে, তা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বলে চলেছেন অধ্যাপক অমর্ত্য সেন। লণ্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের পর তিনি যোগ দেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পলিটিক্যাল ইকনমি বিভাগের ড্রামণ্ড প্রফেসর হিসেবে। তারপর চলে যান হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। এরপর তিনি কেম্ব্রিজের ট্রিনিটি কলেজে বিশেষ সম্মান জনক পদে যুক্ত হন। তারপর আবার হার্ভার্ডে। ইতিমধ্যে ১৯৮১ সালে দারিদ্র্য ও দুর্ভিক্ষ নিয়ে সেনের বিখ্যাত গ্রন্থ পভার্টি অ্যাণ্ড ফেমিন অ্যান এসে অন এনটাইটেলমেন্ট অ্যাণ্ড ডিপ্রাইভেশন প্রকাশিত হয়।
দুর্ভিক্ষ, তার কারণ, তাকে প্রতিরোধ করার কার্যকর রাস্তা নিয়ে অধ্যাপক সেন যুগান্তকারী মত প্রকাশ করেন। সেন বলেন, বহু ক্ষেত্রেই খাদ্যের উৎপাদন ও যোগানের অভাবের কারণে নয়, নানাবিধ সামাজিক ও অর্থনৈতিক অব্যবস্থার কারণে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। খুব সোজাসুজি ভাবেই সেন দেখাতে থাকেন কিভাবে কালোবাজারি মজুতদার, ফড়ে পাইকার ইত্যাদি মধ্যস্বত্বভোগীদের সাথে রাজনৈতিক দলের যোগসাজশে দুর্ভিক্ষের চিত্রনাট্য রচনা করা হয়।
অধ্যাপক সেন এগুলো বানিয়ে বানিয়ে বলেন নি। এ ছিল তাঁর চোখে দেখা অভিজ্ঞতা। তাঁর নয় বৎসর বয়সে ১৯৪৩ সালে বাংলায় ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। ত্রিশ লক্ষ মানুষ বলি হয়। শিশু হলেও সেন নিজের জীবনে এটা দেখেছেন। গরিব বাঙালি এই হাহাকার ও পথে পথে ফ্যান ভিক্ষা করার দৃশ্য তিনি জীবনে ভুলতে পারেন নি।
সেন এই ক্ষুধার রাজনীতি অর্থনীতি নিয়ে আমাদের গভীরে তাকাতে প্রণোদিত করেন। সেন দেখান, সে সময় যে ভারতে খাদ্য উৎপাদন করা হয় নি, তা নয়। একশ্রেণীর ব্যবসায়ীর ও ইতর শ্রেণীর রাজনীতি করে খাওয়া লোকজনের যোগসাজশে বাংলা ভূমিতে এই অনর্থ ঘটেছে, প্রাণ হারিয়েছে ত্রিশ লক্ষ মানুষ। সেন এই সূত্রে একটা যুগান্তকারী কথা বললেন। তিনি বললেন, মতপ্রকাশের যথার্থ অধিকার সুনিশ্চিত করা গেলে দুর্ভিক্ষ ঠেকানো যায়। আরো বললেন, অর্থনৈতিক উন্নতি ঘটাতে গেলে জনগণের মধ্যে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও অধিকার বোধের জন্ম দেওয়া জরুরি। এই ক্ষুধার সাথে মানবাধিকারহীনতাকে ওতপ্রোত করে দেখান সেন। অন্য অনেক অর্থনীতিবিদ যেখানে আয়, বিকাশ, উপযোগিতা নিয়ে বলেন, সেন সেখানে ব্যক্তিমানুষের ন্যায়সঙ্গত প্রাপ্য, ক্ষমতায়ন, স্বাধীনতা ও অধিকার সচেতনতার কথা বলেন। দারিদ্র্যকে বোঝাতে চেয়ে তিনি বলেন, মানুষের মধ্যে ন্যূনতম কিছু যোগ্যতার জন্ম দিতে না পারলে, তা দারিদ্র্যের জন্ম দেয়।
সেন আরো দেখান, গরিব দেশের মেয়েরা আরো ভীষণভাবে গরিব। গরিবের বাড়ির মেয়েরা বাড়ির লোকজনের হাতেও ভয়াবহ ভাবে বঞ্চিত। গরিব দেশের জন্মহার বিশ্লেষণ করে সেন এক ভয়ঙ্কর সত্যের সামনে আমাদের খাড়া করে দেন। তথ্য বলে গরিব দেশে পুরুষ বাচ্চার তুলনায় মেয়ে বাচ্চা বেশি জন্মায়। আর পুরুষ বাচ্চাদের শৈশব মৃত্যু হারও উঁচু। তবুও কেন গরিব দেশে পুরুষের তুলনায় মেয়ের সংখ্যা কম? প্রশ্ন তোলেন সেন। উত্তরও যুগিয়ে দেন তিনি। বলেন, বাচ্চা ছেলেরা পরিবারের সদস্যদের কাছে গুরুত্ব পায় বেশি। যত্ন পায় বেশি। খাবারের ভাগ পাবার সুযোগ থাকে বেশি। আর মেয়ে বাচ্চারা শৈশব থেকেই বাড়ির লোকের হাতে বঞ্চনার শিকার। ভয়াবহ সত্যের মুখোমুখি হই আমরা।
আজ অধ্যাপক সেনের জন্মদিনে আমার একটাই প্রার্থনা, ভারতে মানবাধিকার ও মতপ্রকাশের অধিকারকে গুরুত্ব দেওয়া হোক। বিচার ব্যবস্থাকে সরল ঋজু আর দ্রুত করা হোক। সরকারি অফিসে স্বচ্ছতা আসুক। শুধু ভোট দেবার গণতন্ত্র নয়, প্রশ্ন করা ও উত্তর পাবার অধিকার প্রতিষ্ঠিত হোক।
মৃদুল শ্রীমানী