সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব – ৩)

আবেল পুরাণ: নিলস হেনরিক আবেল স্মরণলেখ

নিলস হেনরিক আবেল ( ৫ আগস্ট ১৮০২ – ৬ এপ্রিল ১৮২৯) গণিতের বিভিন্ন বিস্তীর্ণ ক্ষেত্রে পথিকৃতের ভূমিকা পালন করে গিয়েছেন। তাঁর অনন্যসাধারণ কাজগুলির মধ‍্যে অন‍্যতম হল যে তিনিই সর্বপ্রথম সামগ্রিক ভাবে প্রমাণ করে দেখালেন যে, র‍্যাডিক‍্যালের জেনারেল কুইনটিক ইকুয়েশন সমাধান করা অসম্ভব।
আবেলের পূর্বে আড়াই শো বছর ধরে এই প্রশ্নটি অমীমাংসিত অবস্থায় ছিল। আবেলের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার হল ইলিপটিক ফাংশন, এবং আবেলিয়ান ফাংশন। এছাড়াও তিনি গড়ে তোলেন আবেলের বাইনোমিয়াল থিওরেম, আবেল ইকুয়েশন, আবেল একসটেনসন, আবেলিয়ান গ্রুপ, আবেলের আইডেনটিটি, আবেলের ইনইকুয়ালিটি, আবেলস থিওরেম, আবেল ট্রানসফরমেশন, আবেলিয়ান ভ‍্যারাইটি, আবেলের সামেশন ফরমূলা এবং আবেলের ইররিডিউসিবিলিটি থিওরেম।
মনে রাখতে হবে যে, আবেল নরওয়ের রয়‍্যাল ফ্রেডেরিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৮২২ খ্রিস্টাব্দে বিএ পাশ করেছেন। তখন তাঁর কুড়ি বছর বয়স। আর আবেল মারা যান ১৮২৯ এ। তখন তাঁর ছাব্বিশ বছর বয়স।
এই যে ছয় সাতটা বৎসরের কর্মজীবন, মাত্র এই কয়টা বৎসরেই তিনি গণিতবিশ্বে এই বিপুল পরিমাণ অবদান রেখে গিয়েছেন।
র‍্যাডিক‍্যালের কুইনটিক ইকুয়েশন নিয়ে আবেল কাজ শুরু করেন ১৮২১ এ। তখন তাঁর ঊনিশ বছর বয়স। আগেই বলেছি, আড়াইশো বছর ধরে বিষয়টি অমীমাংসিত থেকে গিয়েছিল। ওই ১৮২১ এ আবেল ভাবলেন যে তিনি এর সমাধানটি পেয়ে গিয়েছেন। তখন তিনি রয়‍্যাল ফ্রেডেরিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। তখনকার ক্রিশ্চিয়ানিয়া, এখনকার অসলো-র দুজন নামজাদা অধ‍্যাপক, সোরেন রাসমুসেন এবং ক্রিস্টোফার হ‍্যানস্টিন আবেলের গবেষণা ও ফরমূলা লক্ষ্য করে কোথাও কোনো ত্রুটি ও গোলযোগ খুঁজে পেলেন না। তখন অধ‍্যাপকদ্বয় আরো পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে আবেলের কাজ পরীক্ষা নিরীক্ষা করার জন‍্য সমসাময়িক বিখ্যাত গণিতবিদ কার্ল ফার্দিনান্দ দেগেন (১৭৬৬ – ১৮২৫) এর কাছে পাঠালেন। দেগেনও আবেলের কাজে কোনো খুঁত বা অস্পষ্টতা, আড়ষ্টতা খুঁজে পেলেন না। তবুও ডেনমার্কের এই প্রাজ্ঞ প্রবীণ গণিতবিদের ভরসা হল না যে, যে সমস্যা নিয়ে বিগত আড়াইশো বছর ধরে বড় বড় গণিতবিদেরা নাজেহাল হয়ে গিয়েও সমাধান করতে পারেন নি, তা কি করে ক্রিস্তিয়ানিয়ার মতো একটা প্রত‍্যন্ত এলাকার নতুন একটা ছেলে সমাধান করে ফেলবে।
১৮২৩ এ আবেল প্রমাণ করে দিলেন যে র‍্যাডিক‍্যালের ক্ষেত্রে কুইনটিক অর্থাৎ পঞ্চম এবং আরো উচ্চতর ডিগ্রির ইকুয়েশন সমাধান করা অসম্ভব।
আবেল নিজের উদ‍্যোগে এই গবেষণা পত্রটি প্রকাশ করার চেষ্টা করেন। কিন্তু গরিব তরুণটি গবেষণা পত্রটি মুদ্রণের জন‍্য যথেষ্ট ব‍্যয়সংকুলান করে উঠতে পারেননি। মাত্র ছয়টি পাতায় মুদ্রণ সীমিত রাখতে গিয়ে কোথাও কোথাও অতিরিক্ত কঠিন থেকে গিয়েছে, কোথাও কোথাও দুর্বোধ্য ও দুর্লঙ্ঘ‍্য রয়ে গিয়েছে। পরে, ১৮২৬ এ এই গবেষণাপত্রের একটি বিস্তৃততর পাঠ ক্রেলস জার্নালের প্রথম খণ্ডে প্রকাশিত হয়। ১৮২৫ – ২৬ এ আবেল তাঁর নরওয়ের বাসিন্দা বন্ধুদের নিয়ে বার্লিনে গিয়ে শীতকালটা সেখানেই কাটিয়েছিলেন। বার্লিনে তাঁর সঙ্গে অগাস্ট লিওপোল্ড ক্রেল নামে এক সিভিল ইঞ্জিনিয়ারের ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। ক্রেল স্বশিক্ষিত গণিত উৎসাহী ছিলেন। ক্রমে ক্রেল আবেলের উৎসাহদাতা সমর্থক হয়ে উঠলেন। আবেলের প্রগাঢ় অংশগ্রহণে ক্রেল একটি গণিত বিষয়ক জার্নাল প্রতিষ্ঠা করেন। তার নাম হল জার্নাল ফর পিওর অ্যাণ্ড অ্যাপ্লায়েড ম‍্যাথমেটিকস, সংক্ষেপে, ক্রেলস জার্নাল। এই ক্রেলস জার্নালের বিভিন্ন সংখ‍্যায় আবেলের অনেকগুলি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।