দৈনিক ধারাবাহিক উপন্যাসে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব – ১৫৪)

পর্ব – ১৫৪

রাতেই অরিন্দম ফোন করে জানতে চাইলেন, শ‍্যামলী ভাল ভাবে ফিরেছে কি না।
শ‍্যামলী হেসে বলল, হ‍্যাঁ ভাল ভাবে ফিরেছি।
অরিন্দম বললেন, আমি বসে থাকব ভেবেছিলাম। তোমার বাবা মা বার বার করে বললেন, তাই বাধ‍্য হয়ে চলে আসতে হল।
শ‍্যামলী বলল, ও তাই? আসলে, কাল সকালে আপনার অফিস আছে কিনা, তাই আপনার বিশ্রাম দরকার। সেজন্যই বাবা মা হয়তো বা জোর করেছেন।
অরিন্দম বললেন, অথচ দ‍্যাখো, তুমি রমানাথবাবুর বাড়ি যাবে বলে, আমি নিয়ে যেতে রাজি ছিলাম।
শ‍্যামলী বলল, সে তো আমি জানি। আমি একটি বার মুখ ফসকে বললেই আপনি নিয়ে যেতেন।
অরিন্দম বললেন, না না, শ‍্যামলী, তোমাকে বলতে পর্যন্ত হয় নি, আমি নিজের থেকে প্রস্তাব দিলাম। তুমি আমার সাথে যেতে পছন্দই করলে না। বাইরে থেকে গাড়িভাড়া করে আনালে, তবুও বন্ধুর গাড়িতে চড়ে যেতে চাইলে না। ক্ষোভের সুর ঝরে পড়ে অরিন্দমের গলায়।
শ‍্যামলী সান্ত্বনা দেবার ছলে বলল, আচ্ছা আচ্ছা, ঠিক আছে। আপনার গাড়িতে চড়ে একদিন কলকাতা যাব। আর বিড়লা প্ল‍্যানেটারিয়াম দেখে আসব।
 অরিন্দম বললেন, শুধু যাব যাব বলে টাঙিয়ে রেখে দাও। মোটেও যাবে না তুমি, খুব ভালো করেই সেটা জানি।
শ‍্যামলী বলল, এ মা, এই ছেলেটা ভেলভেলেটা, খুব অভিমান করে বসে আছেন দেখছি।
অরিন্দম বললেন, না, অভিমান হবে না! তোমাকে চড়াবো বলেই নতুন গাড়িটা নিয়েছি, তুমি জানো?
শ‍্যামলী বলল, শুনে দারুণ একটা মজা পেলাম।
অরিন্দম বললেন, মজা? মজা কেন?
শ‍্যামলী বলল, জানেন তো তাজমহল দেখতে গেলে গাইড বলেছিল, শাহজাহান তাঁর স্ত্রী মমতাজ মহলকে ভীষণ রকম ভালবাসতেন। তাই তাঁর তেরোবার গর্ভধারণের উদ্যোগ তিনি নিয়েছিলেন। তেরো নম্বরের সময় শেষের বেলা ঘনিয়ে এল মমতাজের।
পারস্য থেকে বিখ্যাত স্থপতি উস্তাদ ঈশাকে আনালেন তিনি। তার পর কতদিন ধরে হাজার হাজার শ্রমিকের হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমে কত বছর ধরে তাজমহল তৈরি হল। তার পর, সেই তাজমহল তৈরি শেষ হতে, তিনি শিল্পীদের হাত কাটিয়ে দিলেন। যাতে তারা আর কোথাও তাজমহল সৃষ্টি না করতে পারে। দেখুন অরিন্দমবাবু, যথার্থ ভালবাসা মানুষকে বড় করে, উন্নত করে, ছোট করবে কেন? বাদশা  মমতাজ বেগমকে যদি প্রকৃতই ভালবাসতেন, তাহলে কি করলে বেগমের স্বাস্থ্যরক্ষা হবে, সেই দিকে বাদশার মনোযোগ যেত। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আদৌ মমতাজ বেগমকে ভালবেসে বাদশা তাজমহল গড়ান নি। ও তাঁর বাহবা নেবার কৌশল। তাও পাবলিক মানি ট‍্যাক্সপেয়ার্স মানি নয়ছয় করে।
অরিন্দম বললেন, আশ্চর্য করলে তুমি! কোথায় তাজমহল, আর কোথায় আমার গাড়ি! এ কোনো তুলনা হল? তুলনা হয় সমানে সমানে।
শ‍্যামলী হেসে উঠে বলল, ভালবাসা যার থাকে, সে সামান্য গাড়িকেও ভালবাসতে পারে। বিমলের সেই ভালবাসা ছিল। কী তীব্র প‍্যাশন!
 অরিন্দম অবাক হয়ে বললেন, বিমল কে বলো তো? আমি চিনি?
শ‍্যামলী বলল, ওহোঃ, বিমল হল সেই ড্রাইভার লোকটার নাম। গাড়ির নাম জগদ্দল। গাড়ির সঙ্গে মানুষের প্রেম। নুন শো দেখতে গিয়েছিলাম চন্দনাতে। ঋত্বিক ঘটকের ফিল্ম। অযান্ত্রিক। সুবোধ ঘোষের গল্প নিয়ে ফিল্ম।
অরিন্দম বললেন, আজ তোমার চোখে জল পড়ছিল দেখে আমার খুব কষ্ট হয়েছে।
শ‍্যামলী বলল, ভাগ‍্যিস চোখের জলটা আছে। আবেগ বাড়তি হলেই জলটা ঝরিয়ে দিয়ে হালকা হতে সাহায‍্য করে। নইলে টেঁকা মুশকিল হয়ে পড়ত। জানেন অরিন্দমবাবু, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কলমে পড়েছি, তিনি নাকি কাঁদতে পারতেন না। পড়তে পড়তে শিউরে উঠেছি।
 অরিন্দম জানতে চাইলেন, রমানাথের বাড়িতে কী হল।
শ‍্যামলী বলল, পায়েস রাঁধলাম। খাওয়ালাম। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর গান্ধীজি আর কাজী নজরুলের গল্প বললাম।
অরিন্দম বললেন, আশ্চর্য এইসব গল্প করবে, পায়েস বানাবে বলে, তুমি কাঁদতে কাঁদতে ওদের বাড়ি দৌড়লে? অ্যাম আই টু বিলিভ ইট?
 শ‍্যামলী বলল, দেখুন না, আজ নভেম্বরের চার তারিখ। শীত শীত করছে। একই পৃথিবীতে দক্ষিণ গোলার্ধে এখন গ্রীষ্মকাল। আপনি আমি তা জানি। কিন্তু সবাই একথা বিশ্বাস করবে?
একটা জিনিস বিশ্বাস করা, না করা, একটা মানুষের ধারণাশক্তির উপর নির্ভর করে।
ক্রমশ…
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।