• Uncategorized
  • 0

T3 || অবিস্মরণীয় নজরুল || বিশেষ সংখ্যায় মিঠুন মুখার্জী

 সবার উপরে মানুষ সত্য

“জামাল নামের একটি বছর চারেকের শিশু। শ্যাম বর্ণ, শীর্ণ শরীর । হারিয়ে যাওয়ার সময় পরনে ছিল একটি নীল রংঙের জামা ও কালো রংঙের প্যান্ট। ডান হাতের বাহুর পরে একটি কালো তিল আছে। কোন সহৃদয় ব্যক্তি খোঁজ পেলে যোগাযোগ করবেন ৯৪৭৪১৭১৭৯৭ নাম্বারে” — খবরের কাগজে ছেলে হারিয়ে যাওয়ার বিজ্ঞাপনটি এভাবেই দেওয়া হয়েছিল। আজ হারিয়ে গিয়েছে ছয় বছর হয়েছে। বাবা সমীরুদ্দী মোল্লা ও মা খাদিজা বিবির সঙ্গে রমাকান্তপুর- এর মেলায় ঘুরতে এসেছিল জামাল। হঠাৎ করে প্রচণ্ড ভিড়ের মধ্যে জামাল তার মার হাত থেকে ছুটে গিয়ে হারিয়ে গিয়েছিল। অনেক চেষ্টা করেও তারা তাদের বাচ্চাকে খুঁজে পাইনি। খাদিজাদির সে কান্না আজও আমি ভুলতে পারি নি। আমি খাদিজা দিদির মামাতো ভাই নজরুল মন্ডল। একমাত্র সন্তানকে হারিয়ে বাবা-মা দুজনেই পাথরের মত হয়ে গিয়েছিল । কারো মুখে একটুও হাসি ছিল না। দেখে যেন মনে হয়, এদের মধ্যে প্রাণের স্পন্দন নেই।
আজ ছয় বছর হয়ে গেল, এমন কোন জায়গা নেই যে, জামালের খোঁজ চালানো হয়নি। কিন্তু খুঁজে পাওয়া যায় নি জামালকে। দিদি-দাদাবাবুকে অনেক সান্ত্বনা দিয়েছি। কিন্তু সন্তান হারানোর যন্ত্রণার কাছে এসব তুচ্ছ। সন্তান দত্তক নেওয়ার কথা বলেও ওদের আমি রাজি করাতে পারিনি।
আমি জন্মসূত্রে মুসলমান হলেও জাত-পাত মানি না। আমার বেশিরভাগ বন্ধু হিন্দু। তাদের বাড়িতে আমার ওঠাবসা, অনুষ্ঠানে খাওয়া-দাওয়া হয়। মনে মনে ঠিক করেছি, বিয়ে করলে, হিন্দুর ঘরের মেয়েই বিয়ে করবো। ডায়মন্ডহারবার-এর ‘শান্তিনিকেতন উচ্চ বিদ্যালয়’-এ বাংলায় শিক্ষকতা দেখতে দেখতে দশ বছর হয়ে গেল। বিনয়-রাজেশ-গণেশ-পরেশ আমার খুব কাছের বন্ধু। আমি মুসলিম বলে ওরা কখনো আমাকে ঘৃণা করে না। আমরা সকলেই দুঃস্থ মানুষদের সাহায্যের জন্য কাজ করে থাকি। কারো মেয়ের বিয়ে হচ্ছে না, কারো ছেলের পড়ার আগ্রহ আছে অথচ পড়তে পারছে না, কারোর রক্ত লাগবে, কারো পরিবারে খাওয়া হচ্ছে না — আমরা সবাই তাদেরকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিই। রাজেশ আমাদের একদিন বলেছিল — “তোদের সম্মতি থাকলে, আমরা “হাত বাড়াও” নামে একটি সংস্থা করতে পারি, যার উদ্দেশ্য হবে, গরীব, দুস্থ, পিছিয়ে পড়া মানুষদের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া।” আমরা সকলে রাজেশের এই প্রস্তাবকে সমর্থন করে এই সংস্থাটি তৈরি করি তিন বছর আগে। আমরা সকলেই সরকারি চাকরি করায় এটি চালাতে আমাদের অনেক সুবিধা হয়েছে।
কলকাতার অনেক ‘অনাথ আশ্রম’-এর সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ হয়েছে এই কবছরে। এই পর্যন্ত একশোর উপর শিশুদের আমরা অনাথ আশ্রমে রেখেছি। সেদিন আমি, পরেশ ও গনেশ দুজন অনাথ শিশুকে নিয়ে গিয়েছিলাম কলকাতার একটি অনাথ আশ্রমে। ঢুকতে যাবো, হঠাৎ একটি বাচ্চাকে আমার খুব চেনা চেনা মনে হল। আমি বাচ্চাদের দায়িত্বে থাকা বিকাশদাকে ছেলেটির কথা জিজ্ঞাসা করায়,সে আমাদের জানায়- “রমাকান্তপুরের রবীন্দ্রনাথ নামের এক চাষী ছেলেটিকে এখানে বছর ছয়েক আগে রেখে গিয়েছে। তারপর আর আসেনি। ছেলেটি খুব শান্ত ও ভালো।” আমার বুঝতে অসুবিধা হলো না এ তার হারিয়ে যাওয়া ভাগ্নে জামাল। আমার দু চোখে আনন্দ অশ্রু দেখা দিল। আমি জামাল সম্পর্কে বিকাশদাকে সব খুলে বললাম। আমার আনন্দ অশ্রু দেখে বললেন — “এতো ‘মেঘ না চাইতে জল’। ভালোই হলো, তোমার দিদির ছেলে যখন, তুমি নিয়ে যাও। আমাদের কোনো আপত্তি নেই।”
কতক্ষণে আমি বাড়ি যাব, আনন্দে আমার তর সইছিল না। আমার সঙ্গে দিদি জামালকে দেখে বিশ্বাসই করতে পারছিল না। আনন্দে ও দুঃখে জামালকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে ও । আমাকে বলে — “কোথায় পেলি একে !” আমি সব ঘটনা খুলে বললাম দিদিকে। ও আমাকে বলল — “আমি তোর কাছে ঋণী, আর ঋণী আল্লাহর কাছে।” এতদিন পর জামালকে ফিরে পেয়ে দিদি যে কত আনন্দিত, তা আমি ভাষায় বলতে পারব না। দিদির সঙ্গে সঙ্গে আমিও ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানালাম।” রাখে হরি মারে কে।”
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।