।। ত্রিতাপহারিণী ২০২০।। T3 শারদ সংখ্যায় মুনমুন লায়েক

আমু

বছর চারের ছোট্ট একটি বাচ্চা মেয়ে নাম আমু, সে আম খুব ভালোবাসে বলে মা তার নাম রেখেছে এই “আমু” আর ভালো নাম অইন্দ্রী। মাঝারি বর্ণে, রোগা-পাতলা, কোঁকড়ানো চুল ছোট-ছোট দুটি চোখে ঘন চক্ষুপল্লব, যেন তার ভয় পাওয়া, দুষ্টুমি, অবাক হওয়া এই সব অভিব‍্যক্তি চোখ দুটি থেকে ঠিকরে বেরোচ্ছে। ক্ষুদ্র মানুষটির বায়না বা দুষ্টুমি কিন্তু ক্ষুদ্র বা লঘু হয় না। দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পরে বাবা হয়তো একটু বিশ্রাম নিচ্ছে ওমনি আমু কোথা থেকে একটা খবরের কাগজকে সাপ বানিয়ে নিয়ে বসলো বাবার পিঠে বা হয়তো দূর থেকে দৌড়ে এসে বাবার গায়ে জ‍্যাম্প দিয়ে পড়লো। মা, ঠানমার উপর আমুর অত‍্যাচার তো লেগে আছে, আর সেটা তাদেরও গা-সওয়া হয়ে গেছে। সাধারণ বাচ্চারা খেলে, দুষ্টুমি করে আবার কথাও শুনে, কিন্তু আমু কথা শুনে না, কাউর কথায় না, বেশি বারন বা বাধা দিলে ওর বদমাসির পরিমাণ বাড়ে। তবু মা মাঝেমধ্যে দু-চার ঘা দেয়। যে বছর আমুর দাঁত বেরোবে উফ্ সে কি কামড়ানো দৌরাত্ম্য মা, ঠানমার হাত, গাল, বাবার পিঠে, দুধ দিয়ে যাই গোয়ালার হাত আরোও কত জানা-অজানা লোক ওর শিকার হয়েছে কে জানে, দুধের দাঁত বিষদাঁতে পরিনত হয়েছিলো। এখনও মাঝে-মধ্যে বাড়ি লোকদের কামড়ে জব্দ করে। ঠানমা বলে―ওর ভুল লগ্নে জন্ম হয়েছে, তাই ওরকমে হয়েছে। অবশ্যই আমুর বয়সি বাচ্চারা বর্ণপরিচয়, টেবিল, এবিসিডি, ইংরেজী ছড়া-কবিতা কত কি জানে। কেউ কেউ তো ইদুঁর দৌড়ে আগের সিড়িতেই পা-দিয়ে দিচ্ছে। আমুকেও সেই ভেবে সামনে ক্লাবের নাসারিং-তে ভর্তি করা হয়। কিন্তু প্রথম দিনেই নাকি কোন বাচ্চার মাথায় ওয়াটার বোতল দিয়ে আলু বানিয়ে দিয়েছে।সেই বাচ্চার বাবাও কম যায় না, পার্টির লোকজন নিয়ে বাড়িতে এসে শাসিয়েও গেছে। সেই থেকে আমুর বাবা-মা সাহস করে ওকে আর স্কুলে পাঠায়নি। সারাদিন আমুর বাড়িতে খেলার করে, ব‍্যাঙাচি, মাছি, ফড়িং ধরে ধরে ডানা কেটে সেটা নিয়ে খেলা, ছোট কুকুরে বাচ্চা নিয়ে খেলা, বড় মোটা লাল পিঁপড়ে গুলোকে মুঠোই ভরে এক জায়গায় থেকে অন্য জায়গায় ছাড়া ইত্যাদি তো আছে। একদিন দেখে ঠানমা জিজ্ঞাসা করল―আমু কি করছিস এই পিঁপড়ে যদি কামড়ায় হাত লাল হয়ে যাবে। আমু বলল―ঠানমা আমি ওদের হারিয়ে দিচ্ছি, ওদের বাড়ি থেকে দূরে। ঠানমা(বিরক্তসহ) বলল―হারিয়ে দিচ্ছিস মানে! কি খেলা জানি না বাবা। খেলা ছেড়ে দৌড়ে এসে আমু বলল―ঠানমা পিঁপড়েগুলো লাইন থেকে নিয়ে অন্য জায়গায় রাখলে, দেখবে ওদের বাবা-মা কেমন ব‍্যস্ত হয়ে খুঁজবে। চলো দেখবে এসো….। ঠানমা বলল―পরে দেখবো, এখন কাজ আছে। এক সকালে আমু দেখলো সবাই খুব ব‍্যস্ত না কি দিদা আসবে। কিন্তু দিদা-আমুকে আর আমু-দিদাকে সহ‍্য করতে পারে না। কারণ একটায় দিদা আমুর দস‍্যিপনা, অবাধ্যতা একদম পছন্দ করে না। বাবা স্টেশনে যাওয়া আগে আমুকে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল―কয়টা দিন শান্ত হয়ে থাকিস মা, তোর দিদা আসছে আর দিদা তো হাইপ্রেশার তুই একটু চুপচাপ থাকিস্। আমুও খুব বাধ্য মানুষের মতো মাথা নাড়িয়ে বলল―হুম। পরে আমু ঠানমাকে জিজ্ঞাসা করল―হাইপ্রেশার কি ঠানমা? ঠানমা বলল―একটা রোগ। আমু―কি হয়? ঠানমা (ফিসফিস) করে বলল―বেশি রেগে গেলে মারা যাবে। আমু বলল―মারা যাওয়া বলতে কি হয় ঠানমা। ঠানমা বলল―পরে বলবো তুই খেল গা যা। আমু―না তুমি বলো। ঠানমা(একটু ভেবে) বলল―তুই যে ফড়িং, ব‍্যাঙ,পিঁপড়ে নিয়ে খেলিস্ দুই দিন বাদে, যে এগুলো শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায়; ওকে মারা যাওয়া বলে। শুনে আমু একটু চিহ্নিত হয়ে বলল―আমি তো ওদের ফেলে দি্,ওরা আর উঠে না, আর উড়েও বেড়ায় না ঠানমা। ঠানমা বলল―না ওরা তো মরে গেলো, তাহলে আর কি করে করবে। আমুর শিশু মনে এই কথা গুলির সঠিক বিশ্লেষণ করতে পারলো না। একদিকে যথাসময় দিদা এলো এবং ঘরে ঢুকেই দেখলো ঘরের সিঁড়ি উপর আমু প্রিয় পোষ‍্য শুয়ে লেজ নাড়াচ্ছে আর আমু একখন্ড চক নিয়ে খালি গায়ে মেঝের উপর উবুড় হয়ে শুয়ে খুব মনোযোগসহ কি লিখচ্ছে। দিদা(ঠোঁট উল্টে) বলে উঠলো―একি দশা,এ কাদের ঘরের?? গায়ে জামা নেই, মাথা ভর্তি চুল,হাত-পায় কি ছিরি্ । মা ইতস্ততঃ হয়ে বলল―ঘামাচি হয়েছে তো তাই জামাটা পরাই নি। দিদা ভেংচি কাটা সুরে বলে―অভ‍্যাস করা, নইলে বাঁদর হয়ে যাবে। তারপর আমুর কান ধরে বলে―মেয়ে হয়ে গায়ে একটা জামা পরতে পারচ্ছিস্ না। রাতদিন ফড়িং-এর মতো নাচলেই হবে। ত্রুমশ দিন-দিন আমুর উপর শাসন ও বিভিন্ন মেয়েলি সুলভ আদব-কায়দা দিদা শেখোনো প্রচেষ্টা করতে থাকে। আমুও একপ্রকার অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলো। তার একদিন কি মনে করে বুদ্ধি এলো দিদা যে প্রতিদিন পান খায় এবং সেই পানও বেশ পরিপাটি করে সাজতে বসেন, সারাদিনে 10-15 পান খেয়ে থাকেন। আমু করল কি চুপিচুপি পানের মধ্যে বালি-ছাই মিশিয়ে দিলো। পানের মধ্যে চুন,সুপারি,খয়ের মৌরী ইত্যাদি সাথে বালি-কাঁকড়াও যেন শোভা বাড়াচ্ছে। দিদা পান চিবুতে গিয়ে বুঝতে পারে, আলাদা কিছু যুক্ত হয়েছে এবং বাকি পানগুলি খুলে দেখে, এই ব‍্যাপার, কার কান্ড বুঝবার অপেক্ষা রইল না। দিদা কান্না-কাটি, শাপ-শাপান্ত করে ও আমুর জন্য যে কপালে দুঃখ আছে, তা নিজের মেয়েকে বারবার বলে যায় এবং আমুর বাবাকে বলে কাল সকালে সে এখন থেকে রওনা হতে চায়। এই ব‍্যাপারটা আমুর ছেলেমানুষীর মধ্যে সীমা রইল না। বাবা-মা বেশ চিন্তা পড়ে গেলে। সত্যি তো মেয়ের দুষ্টুমি লাগাম ছাড়া, জেদ অবাধ‍্যতা জোরে সে কিছু শুনতে চায় না।কিন্তু বলে না সময় যখন তোমাকে শেখাবে, তুমি কোনো প্রকারে বেঁচে পালাতে পারবে না। হঠাৎতেই কয়েক দিনের ম‍্যালেরিয়ার জ্বরে আমুর মা মারা গেলে। কি হলো, কি করে হলো কেউ বুঝতে পারলো না, আর এই ছোট প্রানীটি বুঝতে পারলো মারা যাওয়া মানে, মারা যে যায় সে আর ফিরে না, কোনোদিন, কোনোভাবেই না। তিনটি মানুষের জীবনে সময় যেন থেমে গেলো, শুধু দিনগুলো। ছুটে পেরোতে লাগলো। শোকের ছাপ সময়ই ঢেকে দিলো। আমু এখন আঠেরো পেরিয়ে উনিশে-পা দিয়েছে। অনেক শান্ত স্বভাবে, আগে মতো আর অবাধ‍্যতা নেই, অনুশাসিত জীবন, লম্বা কোঁকড়ানো চুল, সেই উসুক দুষ্টু চোখে এক শান্ত ধীরস্থিরতা এসেছে এবং এক লাবণ্যময়ী কিশোরীতে পরিনত হয়েছে। যে আমগাছ চারা আকারে ছিলো; সেই গাছ ছাদের উপরে ডালপালা বিস্তার করেছে। গাছের তলা সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো, সেখানে আমুকে বেশির ভাগ সময় দেখা যায়। আমু দেখে পুরানো পাতাগুলো হাওয়াতে ঝরে্-ঝরে্ পড়ছে, শুকনো আম পাতার উপর চলে কি সুন্দর মরমর শব্দ হয়, কি স্নিগ্ধ সুন্দর সব কিছু, প্রকৃতি কিছু না বলেও, কত কথা বলে আর নিঃশ্চুপ হয়ে সব বোঝে। মায়ের মৃত্যুর পরে এই একাকিত্বা প্রকৃতির মাঝে ভাগ করে, আমু অনেক কিছু বুঝতে, দেখতে শিখেছে আর সবচেয়ে বড় যে শিক্ষা হয়েছে, সেটা হলো কোনো প্রানীর, সেই হোক না ছোট থেকে ছোট তাকে হত্যা করা উচিত নয়। খেলা ছলে, তুচ্ছ জ্ঞান করে, অহেতুক মেরে ফেলা একদমই ঠিক নয়। এখন আমু নিজেও কোনো প্রানীকে মারে না এবং ঠানমা, বাবাকেও কোনো প্রানী হত্যা করতে দেয় না।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।